জনৈক সাহিত্য সম্পাদকের জন্য
(‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা’: জীবনানন্দ দাশ)
জাহিদ হায়দার
চোখে প্লাস-মাইনাস কাচের চশমা।
অর্ধ চাঁদের ভেতর দিয়ে ঝানু সম্পাদক অক্ষর পড়েন।
আমার আড়ালে ‘যাচ্ছেতাই’ বলে
কবিতাটি মুচড়ে ফেলে দিলেন
আবর্জনার সংসারে।
আড়ালের নৈঃশব্দ আর সৌন্দর্য আমরা ভালবাসি।
কবিতাটি আমি অন্য এক ঝানু সম্পাদককে দিলাম।
খুব যতেœ ছাপা হলো। আমাকে বললেন,
‘মৃত্যু আর প্রেমের গভীর সম্পর্কের
এ রকম কবিতা তাঁকে আরও দিতে হবে।’
রাত্রির কলকাতায় জীবনানন্দের
একা একা হাঁটাহাঁটি থেকে
আমরা বুঝতে পারি যতেœর আত্মচরিত।
ভাবের ঝানুরা মুখোমুখি বসে
কখনো চুপচাপ দেখেন দু’জনের ঘোলা চোখ।
কখনো মৃদু হাসেন ঘর ফেরা বুড়ো মহিষের মতো।
আমরা জানি, অমনোনয়নের সাথে
কোনো এক শুভক্ষণে
নয়নের দেখা হলে
শীতেও বৃষ্টি নামে পড়শির বারান্দায়।
আমার কিছু খ্যাতি হওয়ার এক বছর পর
প্রথম ঝানু , তাঁরই অমনোনীত আমার কবিতা
শিকারি মানুষ আর একটি লাফ দেয়া হরিণের
ইলাস্ট্রেশনসহ ছাপলেন।
ওই কবিতায় নিঃসঙ্গ বেড়ালের শুকনো স্তনের কথা ছিল।
[২৬.০৫.২০১৬]
এলিয়ন
আলমগীর রেজা চৌধুরী
স্পেসশিপে ঘুরে বেড়ায়, গ্রহান্তরের কিম্ভূত মুখাবয়ব-
প্রজাতি মানুষ।
আত্মীয়ের বাড়িতে এসে শনাক্ত করে
কী সুন্দর! মাধবীলতা ঝুলে আছে,
ঝালরকাটা আলোয় বীথিকার মুখ
জল অবধি হাওয়ায় দুলছে ঢেউ
দূরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
স্পেসশিপের বাসিন্দা, শুধু বীথিকে দেখে,
সর্ষেক্ষেতে হলুদের হাট
স্কুল থেকে ফিরছে মল্লিকাদের দল।
আলো নিভে যাচ্ছে,
অন্ধকার পৃথিবীর ছায়ার জন্য বসে থাকে সে...
পুনরায় ফিরে আসা পৃথিবীর ছায়ায় বীথিকা থাকবে তো?
শানঘাটে সকালের রোদ্দুর পোহায় যে নারী, ওর আদল-
মেমরি চিপে পৃথক ফাইলের নাম দেয়- প্রেম।
তরুণ জঙ্গীর প্রতি
জাফর ওয়াজেদ
ফিরে আয়, এখনো সময় আছে ওই ভুল পথ ছেড়ে
ফিরে আয় খোকা, ওটা কোনো পথ নয়, অন্ধ গহবর
তোকে কুঁরে কুঁরে খাবে, নিয়ে যাবে মানুষ থেকে দূরে
খোকা জঙ্গী কোনো সত্য- ন্যায়ের পথ নয়, ওরা বর্বর।
কারা তোকে নিয়ে গেছে, কারা তোকে দিয়েছে মন্ত্র
দেশমাতৃকার ডাক ভোলানো গানে বেঁধেছে তোকে
কারা তোর হাতে তুলে দেয় মুক্ত মানুষ মারার যন্ত্র
বাংলার নদী মাঠ ঘাট প্রান্তর সব ভুরিয়ে দেয় কে।
খুনের রক্ত মাখা ওইসব নরকের কীট পতঙ্গের দল
তোকেও নামায় আরও এক ভন্ড কুৎসিত নরকে
ভুলে যাবি কেন, ওরাই দেশের শত্রু হানাদারের দল
ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরেছে, লাঞ্ছিত লাখো মা বোনকে।
ওদের সঙ্গে কোথায় যাবি, ওরা হার্মাদ ধর্ম ব্যভিচারী
হবি মুক্তমনা মানুষ হবি দেশকে ভালোবেসে দিশারী
এই দেশটা তোরই দেশ- লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া
ওরা যে সব খুনির দল, ওদের কাছে নেই কোন চাওয়া।
ফিরে আয় খোকা ওই জঙ্গীবাদ তোর নয়- বাঙালিরও নয়
কেন তুই জল্লাদ জানোয়ারের সঙ্গে করবি গভীর প্রণয়।
নচিকেতা
রেজাউদ্দিন স্টালিন
বেদনার বেলাভূমি- আইলান ফেরাতো হলো না,
পেছনে স্বদেশ ডাকে অদূরেই মিথ্যে প্রণোদনা।
একবার এই ডাক শুনেছিল সফোক্লিস কবি,
আর যত অভিবাসী হেরাক্লাস ট্রয়ের বিপ্লবী।
পিতা মাতা পোতাশ্রয় ভেঙ্গে দেয় ভূমধ্যসাগর,
ফেনার রাজ্য থেকে ফিরে আসে হেডিসের স্বর।
ফরাসী তাঁবুর নিচে সুপ্ত ছিল স্বপ্ন বহুদিন,
সন্ত্রাসের চিৎকারে জেগে ওঠে জনমানবহীন-
চরাচর; আইলান দাঁড়িয়েছে গোধূলি ছায়ায়,
সামনে পেছনে তার মৃত্যুকলা চূর্ণ হয়ে যায়।
এজিয়ান চেয়েছিল-ফিরে যাক আইলান-সোনা,
ক্ষুব্ধ প্রতিধ্বনি-সবাইকে ফেলে একা ফিরব না।
পৃথিবীর শেষতম শিশুটির শোণিত প্রবাহ,
ঘরহীন মানুষের আর্তস্বর খা-বদাহ-
ফুঁসে ওঠে শীর্ষনাগ-তরঙ্গিত শিখার ভিতরে;
আর কত অকাতর আত্মাহুতি সমুদ্র জঠরে?
উপরে আকাশ নিচে পিতৃভূমি পূর্বপুরুষের,
যমের দুয়ার থেকে ফিরে এসে আইলান ফের-
ত্রাতা হবে, সব মানুষের মনে আগুন প্রণেতা;
মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ-এশিয়ার শ্রেষ্ঠ নচিকেতা।
প্রাণহারী
গোলাম কিবরিয়া পিনু
ফুলবাগান থাকবেÑলতাগৃহ থাকবে
মানুষ থাকবে না!
কুঞ্জবনে প্রবেশ করতে পারবে না কেউ!
অরণ্যচারীরা থাকবেÑঅন্ধকার নিয়ে
ফুল ফুটবেÑএর মাহাত্ম বুঝবে না
অরণ্যপুষ্প অবহেলায় ঝরে যাবে।
অরণ্যরক্ষক হবে বুনো জংলীরাÑ
যাদের মস্তিষ্ক থাকবে না!
চোরাশিকারে আততায়ী হয়ে ওঠে ওরা
প্রাণসংহারে নাচেÑ
ইতরপ্রাণীর চেয়েও তারা জিঘাংসু!
তারা কীভাবে বুঝবেÑ
কিংশুকের কথা?
কীভাবে অনুভব করবেÑ
স্বর্ণপুষ্প ও পঞ্চমুখী জবার সৌন্দর্য!
নন্দনকানন থাকবেÑ
ফুলও ফুটবে।
ফুলের গন্ধ নেয়ার কেউ থাকবে না!
ফুলের গৌরব কী?
তা প্রাণহারী টাট্টুঘোড়ায় চড়া
লোকেরা জানবে না!
ফুল ও অন্ধকার তারা একভাবে দেখে!
ওদের চোখেই অন্ধকারÑ
এর আগে যারা বাগানে প্রবেশ করেছিল
তারাÑতাদেরও হত্যা করেছে!
হলি আর্টিজান
জোবায়ের মিলন
শোকগুলো বিছিয়ে রাখলাম লনের ঘাসে
দেয়ালে, কাঠের ফ্রেমে, ইটে, পাথরে,
কিছু রক্তে। পাশেই কাচের দেয়ালের ওপারে
যে তুমি ধারন করছিলে সেক্ষণের চলমান ছবি
সে তুমি ভুলে যেও না কয়েক দিন পরেই-
বি. শ. টি. মৃতদেহ!
তখনও হট-ডগের গন্ধ বাতাসে মিলায়নি
ফ্রেঞ্চফ্রাই, বেকারির নানা পদ
উবে যায়নি চকচকে কাঠের টেবিল থেকে
কোকের গ্লাসটা ফাঁকা হয়নি তখনও
তার আগেই ব্রাশ ফায়ার... তার আগেই কাঁধব্যাগ থেকে
পোনা মাছের মতো বের করে আনা ছোট ছোট স্পাত ছোরা
আল্লা হু-আকবর বলে,...
ফিরে এলো কয়েকজন
ফিরে এলো না অনেকজন
মেঝেতে রক্ত, মেঝেতে হটডগ, মেঝেতে কোক
মেঝেতে চিলিফিস! ওরা বললো-
আল্লা হু-আকবর...
দেবদারু, ইউক্যালিপটাস আঁধারে দাঁড়িয়ে কাঁপল,
পাতার ফোকর দিয়ে দেখল, বাগানে কীটের কামুড়
একটার পর একটা...
শোকগুলো বিছিয়ে রাখলাম বুকের ছাতিমে
শার্টের আস্তিনে, কলারের ভাজে
ভালো থেকো আষাঢ়, বি. শ. টি মৃতদেহ।
১৯ আষাঢ় ১৪২৩
বাড়ি ফেরার পর
মাসুদ মুস্তাফিজ
রাতে বাড়ি ফেরার আগে দোকানে যাই-প্রতিদিনের ফর্দি মাফিক কেনাকাটা আর ফোনালাপ শেষে পকেটে পড়ে থাকে কিছু খুচরো সস্তা বাতাস বেদনাবহনের আপন কাগজ-পত্তর
রাতে বাড়ি ফেরার আগে অসংখ্য মানুষের ঘষামাজা মুখ দ্যাখি-দ্যাখি দোতলা জীবন সংহারের দুর্বৃত্ত পোকা স্বপ্নের নির্জন হেঁটে যাওয়া মেঘের সঙ্গী পায়ের ধুলোয় পথের রোদ লেগে থাকে
রাতে বাড়ি ফেরার আগে কামরাঙা রাতের দোকানে স্বভাবের পয়সা দিয়ে কিনি জরুরী ওষুধপত্রর আর বোধের মননে এন্তাজ ছুঁয়ে আঙ্গুল প্রতিম হয়ে উঠি
রাতে বাড়ি ফেরার আগে রাতপাতারা জেগে ওঠে সম্পর্কের রঙিন রঙে ভেজা শরীরের শব্দে বাতাসে প্রার্থনার ঘোর কেটে বিচ্ছিন্ন আলোর পৃথিবী দ্যাখেÑ
মনে পড়ে যায় কিছু কেনা হলো না আমার-বোধহয় ফেলে এসেছি সব আপন সুখ-দুঃখ মিহি বাতাসের মন... তোমাকে শব্দকলি তোমাকেই
শীর্ষ সংবাদ: