ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খুরশীদ আলম পাটওয়ারী

পুত্রের জবানীতে পিতৃস্মৃতি আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২২ জুলাই ২০১৬

পুত্রের জবানীতে পিতৃস্মৃতি আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রজীবনীর গুরুত্ব স্বীকার করে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন : একজন অমৃত পুত্রকে আমরা তখনই আবার সহজভাবে তাঁর মর্ত্যরূপে ভাবতে পারি, যখন সময়ের ব্যবধানে অনেক অবান্তর সঞ্চয় ঝরে পড়ে, আবার সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হবারও বাধা থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে তাই অপেক্ষা করতে হবে হয়তো, দীর্ঘকালÑ অন্তত যতদিন না ‘রবীন্দ্রজীবনী’ পরিবর্ধিত হবার পরেও নতুনতর তথ্য নিয়ে অনুরূপ গ্রন্থ আরও বেরোয়।’ প্রকৃত প্রস্তাবেই প্রভাত কুমার মজুমদারের চার খ-ে রবীন্দ্রজীবনী প্রশান্ত কুমার পালের প্রায় এগারো খ-ের জীবনী আর অসংখ্য লেখকের নানা অবয়বে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মকে ছুঁয়ে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টার পরও প্রতিনিয়তই এই কিংবদন্তি পুরুষকে নিয়ে রচিত হচ্ছে অজস্র শব্দমালা। রবি জীবনীকার প্রশান্ত কুমার পাল তাঁর বৃহৎ কলেবরের গ্রস্থমালার শুরুতে বলেছেনÑ ‘কোথাও কোথাও পুনরুক্তি ঘটলেও রবীন্দ্রজীবনের প্রধান ঘটনাগুলোকে মোটামুটি তারিখের দ্বারা চিহ্নিত করার সুযোগ পাওয়া গেছে, যার ফলে তাঁর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে অনেক বিচার বিভ্রাট এড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করি’। এত ডিটেইল্স এ প্রায় বছরওয়ারী রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণ থাকার পরও রবীন্দ্রনাথের জীবৎকাল থেকেই তাঁর ওপর কোন ঘনিষ্ঠজনের কোন লেখাজোকা বিদগ্ধজনদের কাছে ছিল পরম আকাক্সিক্ষত। এই ক্ষুধা নিবৃত্তির কিছুটা উপলক্ষ সৃষ্টি হলো যখন কবিপুত্র নিজে কলম ধরলেন বাবাকে উন্মোচনের লক্ষ্যে। রথীন্দ্রনাথ রায় মূল গ্রন্থ ঙহ ঃযব বফমবং ড়ভ ঃরসব নামক স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তাঁর জীবনের শেষভাগে। অতঃপর তাঁর মৃত্যুর পর পিতৃস্মৃতি নামে তা বাংলায় প্রকাশিতও হয়েছে। মূল বইয়ের কিছু তথ্য/ঘটনার বর্ণনা অনুবাদকৃত পিতৃস্মৃতিতে নেই। সম্প্রতি কবির চান্দ ঙহ ঃযব বফমবং ড়ভ ঃরসব নামক স্মৃতি কথাটির অনুবাদ করেছেন ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’ নামে। একটি গ্রন্থ প্রদর্শনীতে গ্রন্থটি দেখেই চমৎকৃত হওয়া। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনীতে অনেক কিছুই পাওয়া যাবে কিন্তু পিতার জবানীতে রবীন্দ্রনাথ যখন উপস্থাপিত হবেন তখন এমন অনেক অজানা ঘটনা বা তথ্য জানার সুযোগ হবে যা আনুষ্ঠানিক জীবনীকারগণ উঠিয়ে আনতে সক্ষম হবেন না। এমত ধারণা আর ইচ্ছা থেকেই গ্রন্থটি সংগ্রহ করা। এর ভেতরের কভারে উল্লিখিত আছেÑ বিখ্যাত বাবাদের নিয়ে সন্তানদের স্মৃতিকথা দুর্লভ নয়। কিন্তু রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথ যত দীর্ঘকালব্যাপী পিতাকে কাছ থেকে দেখেছেন, এমনটি আর কোনো সন্তানের ক্ষেত্রে ঘটেনি। প্রায় ৫০ বছর তিনি পিতার সঙ্গেই ছিলেন, সময়ের দাবিতে এ বই কেবল পুত্রের স্মৃতিকথা নয়, বরং খুব কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের মতো মহীরুহের অবয়ব উন্মোচন। রবিজীবনের অনেক অনুন্মোচিত দিক অনেক অজ্ঞাতপূর্ণ তথ্য জানা যাবে এ রকম কৌতূহল থেকেই গ্রন্থটি সংগৃহীত হবে। সারাজীবন মৃত্যুর পর মৃত্যুর ঘা সওয়ার পরও কবি কেমন করে স্থির থাকলেন, এত বিপুল রচনা রেখে যেতে পারলেন? ১৯১২ সালের ইংল্যান্ড সফর কীভাবে বদলে দিয়েছিল কবির জীবন ? গীতাঞ্জলির পা-ুলিপি কেমন করে হারিয়ে গিয়েছিল, আবার সেটা পাওয়াই বা গেল কেমন করে? কেমন ছিল ঠাকুরবাড়ির প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্র আর গগনেন্দ্রদের শিল্পীজীবন। এমনকি আমরা জানতে পারব এ বই থেকে রবীন্দ্রনাথের কেমন প্রিয় ছিল পতিসর, শিলাইদহ, সাজাদপুরের নৈসর্গিক দৃশ্য, পদ্মার পৌরুষজাত উদ্দামতা আর রুপালি ইলিশ। বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব, কর্ম, আবেগ, নিরাভরণ জীবনের অম্লমধুর অনেক বাঁক উন্মোচিত হয়েছে এ গ্রন্থের পরতে পরতে, যা নাও দেখা যেতে পারে এমনকি নিবিড়ভাবে লিখিত আত্মজীবনীতেও। যথারীতি গ্রন্থটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশ পরিচিতি দিয়ে এরপর ঠাকুর পরিবারের নতুন শিশু, জোড়াসাঁকোর সেই বিখ্যাত বাড়ি দিয়ে তরতর করে ছোট ছোট অধ্যায়ে এগিয়ে যায় গ্রন্থের কলেবর। কিন্তু এরপর আর বিবর্তনের সূত্র না মেনে নানারকম ছোট ছোট ঘটনা, বর্ণনা, বাবার লেখালেখি, পদ্মা নদী, হিমালয় যাত্রা, আমেরিকা দর্শন, ইউরোপ ভ্রমণ, পতিসর, শান্তি নিকেতনে এসে থিতু হওয়া ইত্যাদি যথাযথই জীবনীকারগণের মতো রবীন্দ্রনাথের বছরওয়ারী দিনপঞ্জি রচিত হয়নি যা এই গ্রন্থের চিত্তাকর্ষক দিক। বেশ অনেকগুলো চিত্রাবলি ও আলোকচিত্র গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে। মূল বইয়ের অন্তর্ভুক্ত চিত্রাবলির সঙ্গে অনুবাদগ্রন্থেও সংযোজিত হয়েছে অনেকগুলো ছবি। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বয়সী ছবি, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ, অবনীন্দ্র, গগনেন্দ্রসহ রবীন্দ্রনাথের বিদেশী প্রখ্যাত লেখক আর ব্যক্তিত্বদের ছবি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাইজার লিং সুলোলিনি ও গান্ধীজীর সঙ্গে তোলা আলোকচিত্রগুলো মূল বইয়ে ছিল, সংযোজিত ছবিতে স্থান পেয়েছে স্ত্রী প্রতিমা দেবী অঙ্কিত রবীন্দ্রনাথের স্কোচ, প্রথম সন্তান মাধুরীলতাকে কোলে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবী শান্তিনিকেতনের পাঠদানের চিত্র, মঞ্চায়িত বিভিন্ন নাটকের দৃশ্য, নোবেল পুরস্কারের মেডেল, প্রশংসাপত্র ইত্যাদি। অনুবাদক কবির চান্দ অনুবাদের পরিপ্রেক্ষিত শীর্ষক একটি প্রারম্ভিক অধ্যায়ে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বিষয়ে বেশ আলোকপাত করেছেন। এছাড়াও রথীন্দ্রনাথের মূল গ্রন্থেও পিতার বিশাল, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর নিজ (রথিন্দ্রনাথ) অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তিও অনেকখানি উঠে এসেছে। অনুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এর এক জায়গায় পাওয়া যায় মৃণালিনী দেবী মারা যাবার বছর খানেকের মধ্যে স্বর্ণলতা নামের এক অপরূপ বিধবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। শোনা যায় যে এ বিয়েতে রবীন্দ্রনাথের সম্মতি ছিল। তবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনও বেঁচে। তাঁর বিরোধিতায় বিষয়টি আর এগোয়নি। শিলাইদহে প্রায়ই অনেক মেহমান আসতেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তখন কুষ্টিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি অবসর পেলেই আসতেন, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, নাটোরের মহারাজও শিলাইদহে আসতেন। বাবার লেখালেখি উল্লেখ করতে গিয়ে রথীন্দ্রনাথ লেখেনÑ টানা তিনদিন প্রায় কোন কিছু না খেয়ে বিরতিহীনভাবে লিখে রবীন্দ্রনাথ চিরকুমার সভা লিখলেন, তিনি যখনই কোন লেখা শেষ করতেন তা বন্ধু-বান্ধবকে পড়ে শোনানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। শান্তিনিকেতনের শুরুর দিনগুলো নিয়ে অধিকতর বড় একটি লেখা আছে এ গ্রন্থে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিন্তাভাবনার একটি উপযুক্ত স্থান ছিল এই শান্তিনিকেতন। ছিন্নপত্রাবলির অধিকাংশ পত্রই লিখিত হয়েছিল শিলাইদহ ও পতিসরে অবস্থানকালীন। এই অঞ্চলগুলোর নৈসর্গিক দৃশ্য, পদ্মার দুপাড়ের দৈনন্দিন জীবননাট্যের চালচিত্র ইত্যাদি ছিল ছিন্নপত্রাবলির উপজীব্য। রথীন্দ্রনাথকে ৭৩ বছরের জীবনের প্রায় ৫৩ বছর জগতবিখ্যাত পিতার বিশাল ব্যক্তিত্বের চাপ বহন করতে হয়েছে। আলোচ্য গ্রন্থেও তাই বাবাকে তুলে ধরতে গিয়ে অনিবার্যভাবে রথীন্দ্রনাথের নিজের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশও রচিত হয়েছে। এ রকমই একটি ঘটনার উল্লেখে তিনি লেখেনÑ শিলাইদহের কাজ আমার ভাললাগত। এখানকার দায়িত্ব নিয়ে যখন ব্যস্ত আছি, বাবা ডেকে পাঠালেন। খুড়তুতো ভাই গগনেন্দ্রের ভাগ্নি প্রতিমাকে বিয়ে করতে হবে। আমাদের বংশে এটাই ছিল প্রথম বিধবা বিবাহ। তিন ভাই তিনটি ইজিচেয়ারে বসে গগনেন্দ্র, সমরেন্দ্র, আর অবনীন্দ্র ছবি আঁকতেন। বাংলাদেশে শিল্প আন্দোলন ও বিচিত্রা ক্লাবের প্রভাব এ অধ্যায়ে বিধৃত হয়েছে। শিল্পীত্রয়ের সান্নিধ্য, শিল্পচর্চা, শিল্প সমালোচনাই হয়তো রবীন্দ্রনাথকে শেষ জীবনে চিত্রশিল্পী করে তুলেছিল। ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’ অনুবাদ গ্রস্থিটির অন্যতম মূল্যবান অধ্যায় হলো বাবাকে যেমন দেখেছি। এই অধ্যায়ের পরতে পরতে মণি-মাণিক্যের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সুনিবিড় সব ঘটনা, তাঁর মানবিক বৈশিষ্টাবলি, তাঁর রুচিবোধ, পছন্দ অপছন্দের পসরা। এখান থেকেই আমরা জানতে পারিÑ বাবা সবসময়ই তাঁর পরিপার্শ্ব বদলাতে ভালবাসতেন। তিনি একটানা বেশিদিন একই ঘরে বা একই বাড়িতে থাকতে পারতেন না। শান্তি নিকেতনের কুড়িটিরও অধিক ঘর তাঁর স্পর্শে ধন্য হয়েছে। বাবা কখনোই সন্তানদের সঙ্গে কর্কশ ভাষা ব্যবহার করতে না, আবার স্নেহের অতিশয্যও দেখাতেন না, এমন একটি ঘটনার কথাও আমার মনে পড়ে না যে তিনি আমাদের প্রহার করেছেন। প্রশান্ত কুমার পাল রবীন্দ্রনাথের জীবনী লিখেছেন দীর্ঘতর করে। উক্ত গ্রন্থে বছরওয়ারী রবীন্দ্র কর্মযজ্ঞ উঠে এসেছে। এতদসত্ত্বেও রথীন্দ্রনাথের জবানীতে পিতৃস্মৃতি যেভাবে বিবৃত হয়েছে তা অনবদ্য। এতে এমন অনেক অনুভূতি আর আবেগ লিখিত হয়েছে যা পিতা-পুত্রের ভাব বিনিময়েই সম্ভব। এ জন্যেই অনুবাদকৃত গ্রন্থটিতে একেবারে শেষভাগে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ যথার্থই উল্লেখ করেছেনÑ যত পরিশ্রম করেই কোনো জীবনী লেখা হোক না কেন, তা বাবার মতো একজন মানুষের পূর্ণ চিত্র আঁকতে পারবে না। এমন সূক্ষ্ম দ্যোতনা আর লালিত্যে যাপিত একটি জীবন যথাযথভাবে বর্ণনা করা কেবল তাঁর মতো মহান লেখকের দ্বারাই সম্ভব। সত্যি বলতে কি, তাঁর জীবন সবচেয়ে ভালভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর নিজের লেখাতেই, আর কিছুইতেই তাঁকে এর চেয়ে ভালভাবে জানা যাবে না। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘কবিরে পাবে না কবির জীবনীতে।’ সত্যিই তাই। তাঁর রচনাবলি-ই তাঁর সবচেয়ে বড় জীবনী। সবশেষে বলা যায় রবীন্দ্রনাথই লিখেছিলেন ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।’ প্রকৃত পক্ষে তাঁকে জানা আমাদেরও ফুরাবে না। তবু তাঁর জীবনের বহুমাত্রিকতা ধরার জন্য যুগে যুগে প্রচেষ্টা থাকবে। অনাগত প্রজন্মও তাঁর এবং তাঁর রচনার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অধিকতর নিবিষ্ট হবেন। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আগ্রহীদের নিকট এ স্মৃতিকথা উপকারী হবে বলে বিশ্বাস।
×