ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুন নাহার

ফেরাউনের গ্রাম এক আধুনিক পর্যটকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২২ জুলাই ২০১৬

ফেরাউনের গ্রাম এক আধুনিক পর্যটকের বয়ান

২০১৬ সালের একুশের বইমেলায় হঠাৎ চোখে পড়ল ‘ফেরাউনের গ্রাম’ নামক একটি ঝকঝকে বই। লেখক অচেনা। ভাবলাম, মিশর সম্পর্কে অনেক অখাদ্য লেখা পড়ে রেখেছি, এটা না হয় আরেকটা যোগ হবে। কী আর হবে! অচেনা লেখক শাকুর মজিদের লেখা পড়তে বসলাম বেশ আগ্রহ নিয়ে এবং যত এগুতে লাগলাম ততই মুগ্ধতায় ভর করতে লাগলাম। পুরো মিশর যেন চোখের সামনে সশরীরে উপস্থিত। বর্ণনায়, আলোকচিত্রে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকলাম। পড়তে পড়তে বুঝলাম এত অনুসন্ধানী তথ্যআহরণ করেও ক্লান্ত হইনি বইটির বর্ণনার কারণে- ঝরঝরে, প্রাঞ্জল বর্ণনা। লেখক স্থাপত্যের ছাত্র বলে গিজার পিরামিড, লুক্সরের মন্দির ও অন্যান্য স্থাপত্যিক নিদর্শনের খুব চমৎকার সরল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যা যেকোন পাঠকই পড়ে বুঝতে পারবেন। যিনি লেখেন তিনি যে দেশ বা অঞ্চল ভ্রমণ করেন তার প্রকৃতি, পরিচিতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাপন এবং সর্বোপরি নিজের অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান। বইটি পড়ে জানা গেল তিনি খুব প্রস্তুতি নিয়ে ভ্রমণ করেন। বিষয়বস্তুকে বোঝা ও ধারণ করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকে তার। ভিডিও ক্যামেরা, স্টিল ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডার, নোটবুক, একজোড়া সতর্ক চোখ এবং একটি অনুসন্ধানী মন; সব নিয়ে তিনি যাত্রা করেন। মিশরকে তিনি দেখেছেন একজন মুসলমানের চোখ দিয়ে। ফেরাউন ও মুসার কথা আছে প্রধান তিনটি ধর্মে; ইসলাম ধর্ম, খৃস্টধর্ম ও ইহুদী ধর্ম। আবার মিশরতাত্ত্বিক গবেষণার সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বের কোথাও মিল আছে আর কোথাও অমিল। মিশরতাত্ত্বিক গবেষণার সঙ্গে কোরানতত্ত্বেরও কোথাও মিল আবার কোথাও অমিল আছে। লেখক খুব সূক্ষ্মভাবে এগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। মুসা (আঃ) ও ফেরাউন সম্পর্কে আমরা যা জানি তার সঙ্গে বর্তমান নিদর্শনগুলোর সামঞ্জস্য খুঁজে বেড়িয়েছেন। তিনি আমাদের চিনিয়েছেন এই সেই ফেরাউন যিনি আমাদের পবিত্র কোরান শরীফে আছেন। আবার নাও হতে পারেন, কারণ - এক জায়গায় লেখক বলেছেন, “এখানে যে ফেরাউন শুয়ে আছেন বলা হচ্ছে যে তিনি দাঁতের ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। তাহলে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার কথা যে আমরা জানি, তিনি কে? এ কথাটি জানবার জন্য আশপাশে কোন গাইড কে পাওয়া গেল না”। অর্থাৎ ওখানে কোন গাইড কাজ করে না । শাকুর মজিদ একজন আধুনিক পর্যটক। আধুনিকতা তাকে পেয়ে বসবে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে। আর সে কারণেই রোধহয় তিনি তার সমগ্র ভ্রমণে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন ‘ফারাউনিক ভিলেজ’ কে নিয়ে। যার প্রভাব পড়েছে বইয়ের নামের ওপর। এই ভিলেজ পুরোটাই একটি নাট্যমঞ্চ। সেখানে মঞ্চায়িত হয় তিন সহস্রাধিক বছর আগেকার ফারাউনিক জীবনযাপন। আর দর্শকরা ঘুরে ঘুরে এ নাটক উপভোগ করেন। যেখানে দর্শক সরে যায় সেখানে নাটকও থেমে যায়। আরও একটি বিষয় হলো, কোন কোন ভ্রমণ কাহিনীতে ব্যক্তিগত ঘটনা ও ছবিতে ভরা থাকে। সেখান থেকে প্রকৃত তথ্য আহরণ করা কঠিন। আবার, কিছু ভ্রমণ কাহিনীতে অযাচিতভাবে ইতিহাস আরোপিত থাকে। ফলে রচনাটি অত্যন্ত নিরস ও কাঠখোট্টা হয়ে যায়। ‘ফেরাউনের গ্রাম’ বইটিতে লেখক দুটো বিষয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে সমন্বয় করেছেন। রচনাটি হয়ে উঠেছে একাধারে সরস ও তথ্যবহুল ভ্রমণ কাহিনী। বইটিতে কিছু মুদ্রণপ্রমাদ রয়েছে। ছাপার অক্ষরে ভুল চোখে পড়লে তা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়। আশা করছি পরবর্তী সংস্করণে তো শুধরে নেয়া হবে। ফেরাউনের গ্রাম নিছক একটি ভ্রমণ কাহিনীই নয়, এটি একজন আধুনিক পর্যটকের বয়ান দিয়ে শোনা মিশরীয় পুরাণের সঙ্গে আধুনিক যুগের মিশরতাত্ত্বিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের গল্প।
×