ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ফজলুল হক তুহিন

জীবনশিল্পের অর্কেস্ট্রা

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২২ জুলাই ২০১৬

জীবনশিল্পের অর্কেস্ট্রা

বাংলা ছোট গল্পের ঐতিহ্যের ধারায় একজন মেধাবী ও শক্তিমান গল্পকার নাজিব ওয়াদুদ (জন্ম ২০ জুলাই, ১৯৬১)। তিনি জীবনশিল্পের কোন পর্যায়ের রূপকার, সেই উত্তর তাঁর চারটি গল্পের বই : কাক ও কারফিউ (১৯৯৮), নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ (২০০৮), কমরেড ও কিরিচ (২০১০) এবং পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা (২০১১)। এই বইগুলোর প্রতিটি স্বতন্ত্র গন্ধের, প্রতিটি গল্প আলাদা স্বাদের, প্রতিটি গ্রন্থে গল্পকারের গল্পভাষ্য ও গল্পবয়নের বাঁকবদল ও বিবর্তন সুস্পষ্ট। কাক ও কারফিউ নাজিব ওয়াদুদের প্রথম গল্পগ্রন্থ। এ বই তাঁকে ‘গল্পকার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রবল আর্থ-সামাজিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা-চরিত্রহীনতা-সংঘাত, প্রান্তিক বিত্তহীন মানুষের যন্ত্রণা-আর্তি, ব্যক্তিক অন্তর্দ্বন্দ্বের আখ্যানে নতুন এক গল্পভাষায় লেখক জীবনের বিশ্বাসযোগ্য কথা শিল্প নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় গ্রন্থ নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ-এ গল্পকারের উত্তরণ ঘটেছে নানা মাত্রিক ও ব্যাপক। প্লট-বর্ণনা-পরিবেশ-চরিত্র-সংলাপ-নাটকীয়তা-ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টি, উল্লম্ফন, বিষয়ের গভীরতা, দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ, অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি, আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার ও ভাষারীতি ইত্যাদি বিবেচনায় এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে অনেক পরিণত ও মননশীল, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ। অনেক শিল্পোত্তীর্ণ গল্পের সংকলন এটি। প্রথমে ‘শৈলী’তে প্রকাশিত ‘আবাদ’ নানা দিক থেকে বাংলা ছোট গল্পের জগতে তাৎপর্যপূর্ণ। গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় মানব জমিনের আবাদÑজমিন যেমন কোনোভাবেই নিষ্ফলা হতে পারে না, তেমনি জীবনও কোনো রকমেই বন্ধ্যা হতে পারে না, যদি ঠিকমতো চাষাবাদ করা যায়। গল্পে প্রচ্ছন্ন আছেÑকাক্সিক্ষত ফল লাভের জন্য মানুষ-সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতার আবাদ প্রয়োজন। গল্পে লেখক জমিন ও জীবনের সমান্তরাল কর্ষণ ও জন্মের ব্যাপারে শতভাগ আস্থাশীল। লোক ঐতিহ্যের একটা আদি বৈশিষ্ট্য এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। লোকপ্রধান চরিত্র জগলু ও নায়িকা রূপার জীবন অর্থাৎ নারী-পুরুষের জীবন-আবাদের সংকট, আয়োজন ও সম্ভাবনাকে নিয়ে জমিন চাষাবাদের প্রেক্ষিতে গল্পটি নির্মিত হয়েছে: ‘মাটি ক্যানে বাঞ্জা হবে? চষো, উল্টায়ে-পাল্টায়ে চষো। সার দ্যাও, পাঁউশ দ্যাও, জো মুতোন বীজ ফ্যালো, যত্তন ল্যাও। তা-ও যদিল না হয় তে জো বদলাও, অন্য বীজ ছিটাও। এ্যারই নাম আবাদ। তে মানুষও তো জমির লাহান।’ গল্পের আরো কয়েকটি দিক বিশেষত্বপূর্ণ : ক. রাজশাহী অঞ্চলের নকশাল আন্দোলনের প্রভাব- সিরাজ ও জগলুর নকশাল আন্দোলনে যোগদান ও করুণ পরিণতি; খ. বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক প্রকৃতি ও আবাদের চিত্রাবলী অঙ্কন- কল্পনানির্ভর ও সৌন্দর্যময় প্রকৃতি বর্ণনা থেকে সরে এসে বাস্তব দৃষ্টিতে কৃষি ও কৃষকের চাষাবাদের অসাধারণ চিত্রকল্প সৃষ্টি করেন। গ. আঞ্চলিক ভাষার সংলাপে দক্ষতা এবং গল্পের দিকনির্ণয়ে সংলাপ প্রয়োগে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন লেখক। এছাড়া প্লটের নির্মাণশৈলীও বেশ উপভোগ্য। সবমিলিয়ে একটি গল্প হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন তার সবই প্রায় আছে এতে। চিন্তা-দার্শনিকতা-লোকসংস্কৃতি-প্রকৃতিবর্ণনা-রাজনীতি ইত্যাদি উপাদানের রসায়নে সৃষ্ট ‘আবাদ’ পাঠে উপন্যাসের স্বাদ পাওয়া যায়। নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ-এর সম্প্রসারিত শিল্পরূপ কমরেড ও কিরিচ। জীবনের বহিরাঙ্গন ও মনস্তত্ত্ব পরস্পর মিলেমিশে উভয় গল্পগ্রন্থে গুরুত্ব পেয়েছে। এই গ্রন্থে বড় গল্পের আদলে উপন্যাসের আয়োজন উপভোগ্য। পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা নাজিব ওয়াদুদের বাঁকবদলের স্মারক। এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি গল্পই অত্যন্ত পরিকল্পিত ও যতœলালিত। অধিকাংশ গল্পেই মনস্তত্ত্ব প্রাধান্য পেয়েছে, যেমন প্রথম গ্রন্থ কাক ও কারফিউ-এর অধিকাংশ গল্পেই জীবনের বহিরাঙ্গনের সংকট প্রধান। এ ক্ষেত্রে গল্পকারের স্পষ্ট বিবর্তন ঘটেছে। গল্পের উপাদানিক ও মাত্রিক উন্নতি লক্ষণীয়। ‘কালি ও কলমে’ (‘বালির চড়া’ নামে ছাপা হয়েছিল) প্রকাশিত ও আলোচিত ‘পদ্মাবতী’র মূল কাহিনী ছোট; কিন্তু পদ্মানদী কেন্দ্রিক জীবন ও প্রকৃতির রূপ-রূপান্তর, পরিপ্রেক্ষিত, নিসর্গনির্ভর গ্রামসমাজের বিবর্তনের ধারা এবং মূল চরিত্র আমেনার ‘জলকেলি’ যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে। পদ্মানদী এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে কীভাবে প্রভাবিত করে আসছে তার বিবর্তিত রূপের মাঝেই জীবনসংগ্রাম, একাকীত্ব, মানসিক ও শারীরিক সংবেদনা, জীবিকার অবৈধ অবলম্বন, ব্যবসায় সঙ্গীর সাহায্য, ঘোরের মধ্যে হোসেনের সাথে যৌনসঙ্গ, স্বামীর গুপ্তঘাতকের পরিচয় এবং অভিনব প্রতিশোধের মাধ্যমে আমেনা দেহ-মনের জ্বালা মেটায় পদ্মার পানিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে। গল্পে স্বামীর হন্তারক হননে আমেনার বুদ্ধিমত্তা, প্রতিশোধপরায়ণতা, স্বামীর আশ্রয়ের স্মারকের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালবাসা আমেনা চরিত্রকে অনেক উঁচুতে স্থাপন করে; সঙ্গে সঙ্গে আমেনার ‘পদ্মাবতী’ হয়ে ওঠার চিত্রকল্প শিল্পকুশলতার চিহ্নবাহী। উত্তরণের প্রত্যাশা ও প্রগতির দিক বিবেচনা করলে বলা যায়- লেখকের শৈল্পিকসত্তার সামগ্রিক অগ্রগতি হয়েছে এ গল্পগ্রন্থে। আখ্যান-প্লট-পটভূমি-পরিপার্শ্ব-চরিত্র-সংলাপ সৃষ্টি, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ, বর্ণনা, ভাষা, সমাপ্তি এবং চিন্তা-চেতনা-দর্শনের যোগান ইত্যাদির মননশীল সমন্বয়-অন্তর্বয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মনস্তাত্ত্বিক দিকের প্রাধান্য গল্পকারের বৃত্তকে বড় করেছে। ২ বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান জীবন, জীবনের বহিরাঙ্গন, বহিরাঙ্গনের সংকট, অন্তর্জগতের কথা, প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্ন জীবনের রূপ-রূপান্তর, সমাজের অন্তর্দেশে বয়েচলা মানবহৃদয়ের ফল্গুধারা, মানুষের স্খলন-পতন, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, মনস্তাত্ত্বিক দোলাচল-দ্বন্দ্ব-সংশয়, নি¤œবর্গীয় মানুষের চিরকালীন দুর্দশা, গ্রাম ও শহরের সমাজ ও মানুষের পরিবর্তন, সর্বোপরি মানবিক সংকট নাজিব ওয়াদুদের গল্পে জীবনশিল্প হয়ে উঠেছে। জীবনের বৈচিত্র্য তাঁর গল্পের সাধারণ বৈশিষ্ট্য : তাঁর অধিকাংশ গল্প গ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা কিন্তু প্রসঙ্গ ভিন্ন, সংকট আলাদা, চরিত্রগুলো স্বতন্ত্র। নাগরিক প্রেক্ষিত থেকে লেখা গল্পেরও সাধারণ প্রকৃতি এই বৈচিত্র্যে প্রাণবন্ত। হাল্কা মেজাজে শুরু হয়ে গল্প প্রবেশ করে জীবনের গভীর এক সংকটে, লেখক শেষ পর্যন্ত গল্পের উত্তরণ ঘটান জীবনকেন্দ্রিক প্রাসঙ্গিকতায় ও ব্যঞ্জনাময় সমাপ্তিতে। অন্যদিকে প্রকৃতির অবারিত উপাদানের অঙ্কন ও জীবনের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটিয়ে লেখক মূলত জীবনের অর্থময়তা বা অনর্থময়তার ব্যাপ্তি ঘটান সযতনে ও সচেতনে। এসবের মাঝে গল্পকারের জীবনকেন্দ্রিক বোধ ও উপলব্ধির এক বিস্তৃত ও গভীর পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সে কারণে তাঁর জীবনদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির নিজস্ব ধারা পাঠককে ভাবায়, আনন্দ-বেদনা দেয় ও শিল্পভুবনে টেনে নিয়ে যায়। নাজিব ওয়াদুদের গল্পের চরিত্রাবলী আমাদের অতি চেনা-জানা। বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহরে বা কোনো শহরতলীতে এসব চরিত্রকে দেখা যায়, তারা ক্রীড়া করে, সময় ও যাপিত জীবনের প্রকাশ ঘটায়। তাঁর গল্পে নারী-পুরুষ উভয় চরিত্রই সমান গুরুত্ব পেয়েছে। তবে লেখক গ্রামীণ জনগণের প্রতিনিধিস্থানীয় কুশীলবদের প্রকৃতি-প্রবণতা-প্রেষণার চিত্রকল্প আঁকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘কাক’ গল্পের বুড়ি, ‘কারফিউ’-এর সখিনা, ‘আবাদে’র রূপা, ‘কসাই’-এর সায়রা বানু, ‘আরো দুটি খুনে’র শিরিন, ‘গ্রীনহাউস উপকথা’র মেরী, ‘দখলে’র লুৎফা, ‘কমরেড ও কিরিচে’র হামিদা-রওশন, ‘কান্না-হাসির উপাখ্যান’র রফিজা ও ছুরাতন, ‘ভালো ও মন্দে’র সেলিনা, ‘নোনা প্রেমে’র সেরেনা, ‘পদ্মাবতী’র আমেনা, ‘অন্তর্গত’ গল্পের মা, ‘ইদু কানার বউ’ এর জরিনা, ‘নাকফুলে’র ময়না চরিত্রগুলো আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশের কণ্ঠস্বর। নারীসত্তা ও সমাজসত্তার মিথষ্ক্রিয়া, সংঘাত ও দ্বন্দ্বের ফলে জীবনের রক্তক্ষরণ হওয়া বা পোড় খাওয়া এই মানবীদের লেখক সৃষ্টি করেছেন শিল্প কুশলতায়। জীবনে তারা বঞ্চনা-ছলনা-আঘাত বা মৃত্যুর শিকার বা সংকটে আবর্তিত হয়েছে সংসার, সমাজ বা রাজনৈতিক শক্তির নখরে। এদেশের নারীরা জীবনের অন্তরঙ্গে ও বহিরাঙ্গনে কতটা অসহায় তার শিল্পায়ন করেছেন লেখক। অন্যদিকে পুরুষ চরিত্রের মধ্যে ‘কাক’ গল্পের জফির, ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদে’র রমিজ, ‘পিছুটানে’র মহি, ‘ভগ্নযাত্রা’র নোয়াব আলী, ‘বাঁচামরা’র হামেদ আলী, ‘আবাদে’র জগলু, ‘আরো দু’টি খুনে’র প্রফেসর, ‘কসাই’য়ের হারেজুদ্দিন ও লালমন, ‘খননে’র বনেদি লোকজন, ‘গ্রীনহাউস উপকথা’র জন, ‘নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ’র উত্তম পুরুষ, ‘দখলে’র আক্কাস ও মাহবুব, ‘কমরেড ও কিরিচ’র কমরেড শাকু ও ডাক্তার জাফর, ‘নোনা প্রেমে’র বাদশা, ‘কান্না-হাসির উপাখ্যানে’র হাফেজ ম-ল ও মফেজ, ‘ভালো ও মন্দ’র প্রফেসর হারুন, ‘পদ্মাবতী’র হোসেন, ‘শহীদ ইদু কানার বউ’য়ের সেন্টু মিয়া, ‘নাকফুল’র আলেক মেম্বার, ‘অন্তর্গত’র বাবা, ‘একজন প্রতিবন্ধী ও একটি মহাসড়কের গল্প’র শরীফ ও প্রতিবন্ধী আরমান, ‘সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’র উত্তম পুরুষ যার-যার জায়গায় নিজস্ব চারিত্র্যে প্রোজ্জ্বল। দারিদ্র্যে, সুখে-দুঃখে-সংকটে, দাম্পত্যযাপনে, নেতৃত্বে-ক্ষমতায়, কলহে, কামে-বাসনায়-লিপ্সায়, আত্মপ্রতিষ্ঠায়, অস্তিত্বের লড়াইয়ে, প্রেম-মমতা-¯েœহ-ভালাবাসায়, আত্মদ্বন্দ্বে, হিস্রতা-খুন-আত্মহননে প্রতিটি চরিত্র আপন আলোয় উজ্জ্বল। সমাজবাস্তবতা ও মানসিক বাস্তবতার যৌথ ক্রিয়ায় নাজিব ওয়াদুদের চরিত্ররা কথা বলে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে : উঁচু-নিচু-মধ্য-নিম্নœমধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভেতর থেকে; নগরে, গ্রামে ও শহরতলীতে। কাক ও কারফিউ গ্রন্থের শহরে-আগন্তুক সখিনা; নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ-এর কৃষক ও জেলেরূপী জগলু, গৃহস্থ হারেজুদ্দিন ও প্রফেসর; কমরেড ও কিরিচ গ্রন্থের গ্রাম্য তরুণ-তরুণী আক্কাস-মাহবুব-লুৎফা, রফিজা এবং পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’র আমেনা, জরিনা ও আরমান চরিত্রগুলো প্রাণবন্ত, বাস্তব, মানবিক ও মর্মস্পর্শী অবয়বে গল্পকারের শ্রেষ্ঠ চরিত্রাবলী হয়ে উঠেছে। জীবন ও জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, মানবিক উপলব্ধি ও চেহারার প্রতিচ্ছবি এইসব চরিত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে-চিনতে পারি। গল্পের প্লট ও আখ্যান নির্মাণে গল্পকার আগাগোড়া সিদ্ধহস্ত। গল্পহীন গল্প তিনি লেখেন না। ছোট হলেও একটা গল্প তাঁর গল্পের কেন্দ্রে থাকবেই। রয়ে-সয়ে গল্প বলেন তিনি, একটা সাধারণ ঘটনার সূত্র ধরে ধীরে ধীরে গল্পের ডালপালা বিস্তৃত করেন। গভীরে চালিত করেন চিন্তার স্র্রোত, বইয়ে দেন কার্যকারণের হাওয়া। সাধারণত আকস্মিক সূচনা তাঁর গল্পে থাকে না; পরম্পরা অনুসারে একটার পর একটা ঘটনা তিনি ঘটান এবং মূল সংকটে প্রবেশ করেন; অতঃপর গল্প শেষ করেন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বা জীবনের গভীরতর এক উপলব্ধিতে বা চেতনায়। আকস্মিক শুরু হলেও আখ্যানের শৈলীতে তার চমৎকার সমাপ্তি ঘটে। অপ্রয়োজনীয় মেদবহুল কোনো ঘটনা বা বর্ণনা তাঁর গল্পে স্থান পায় না। কোনো ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও সমাপ্তির পর তার কার্যকারিতা বা যৌক্তিকতা উপলব্ধি করা যায়। নাজিব ওয়াদুদের চারটি গল্পের বইয়ে প্লট ও আখ্যানের বিবর্তন সহজেই নজরে পড়ে। নাজিব ওয়াদুদের গল্পের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় প্রাকৃতিক চিত্রকল্প জীবনকে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে বা পরিবেশ চিনতে পাঠককে সাহায্য করে; কখনো জীবনের মর্মমূল ছুঁয়ে যায়। উত্তরবাংলার গ্রাম-জনপদ, পদ্মানদী, নদীতীরবর্তী কৃষিক্ষেত্র, ভাঙন, খরা, ফারাক্কার মরণ কামড় এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক রূপরঙ অঙ্কন তাঁর গল্পে কাব্যময় ভাষা পেয়েছে। নৈসর্গিক বর্ণনার কাব্যময় উপস্থাপন পাঠককে আনন্দ ও স্বাদ যোগায় ভিন্ন মাত্রায়। তাই বলে তাঁর গল্প কবিতাক্রান্ত নয় মোটেই। তিনি কলোনিয়াল ল্যান্ডস্কেপ আঁকেন না, অঙ্কন করেন জীবন-জীবিকার ও সৌন্দর্যের প্রকৃতি। ছোট ছোট বাক্যে উপস্থাপিত তাঁর গল্পভাষা স্বচ্ছ, সাবলীল ও ব্যঞ্জনাধর্মী। গল্পের নির্মাণশৈলী ছকেবাঁধা কোনো নিয়ম-কানুন মেনে চলে না, তাই বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। গল্পকার কোনো তত্ত্বীয় ব্যাপার বা অস্বচ্ছ প্রসঙ্গ বা গূঢ় রহস্যময় বিষয় নিয়ে জটিল-কুটিল ভাষা প্রয়োগ করেন না। অনুষঙ্গের প্রয়োজনে প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য শব্দমালা তিনি সৃষ্টি করেন; গন্তব্য অনুযায়ী শব্দের গতিস্রোত নিয়ে এগিয়ে যান। উপমা বা রূপক বা উৎপ্রেক্ষা নির্মাণে লেখকের দক্ষতা ও নতুনত্ব চোখে পড়ার মতো। তবে চিত্রকল্প তৈরিতে সবচেয়ে সিদ্ধহস্ত তিনি। যেমন : ‘কাক’ গল্পে বুড়ির বাস থেকে নামার দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে : ঝাঁকড়া ডালপালা ফুঁড়ে বোটা ছেঁড়া কাঁঠাল পড়লো যেন। অন্যদিকে ‘আবাদ’ গল্পে বরিন্দের মাটির বর্ণনা আসে জগলুর মুখের ভাষা থেকে : Ñভীষণ নিষ্ফলা জমিন গো। শুখালে ইটের চাতাল, ভিজলে মানুষের গুয়ের লাহান। কিচ্ছুটি হয় নাখো। ‘পদ্মাবতী’তে পদ্মার ছবি বাস্তবের চোখে অক্ষরবন্দি করেন : শূন্যতায় খা খা করছে বিশাল পদ্মার উদোম বুক। ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে, কেবল ধূ-ধূ বালুচর। বালুর সমুদ্রে দৃষ্টি হারিয়ে যায়। তার শেষ খুঁজে না পেয়ে নজর ফিরে আসে পায়ের কাছে। তখন চোখ দুটো সরু করে সামনে তাকালে পোয়া মাইলটাক্ দূরে দেখা যায় শাদা ফিতার মতো সরু এক চিলতে চিকচিকে রুপোলি ধারা। সেটাই পদ্মা নদী। শুকিয়ে শুকিয়ে এমনই শীর্ণ। তিন. নাজিব ওয়াদুদ নানান ধরনের, মেজাজের, আঙ্গিকের, বিষয়ের গল্প লেখেন বিচিত্র শৈলীতে। তিনি জীবনকে আঁকেন বাস্তব, পরাবাস্তব ও কল্পনার অন্তর্বয়নে; প্রকৃতির আবহে সৃষ্টি করেন জীবনের অন্যতর অর্থ, গভীরতর তাৎপর্য, যে জীবন এদেশের গ্রামে-শহরতলীতে-শহরে-জীবনের অভ্যন্তরে আবর্তিত, যাপিত; কখনো বঞ্চিত, লাঞ্ছিত; কখনো শক্তিমত্ত, লিপ্সিত। বাংলা ছোটগল্পের ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে তিনি ধারণ করেছেন নিজের গল্পে। সমকালীন বাংলা গল্পে নাজিব ওয়াদুদ অবশ্যই একজন মৌলিক, শক্তিমান ও অপরিহার্য গল্পকার। তাঁর গল্পে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই বলে নাজিব ওয়াদুদের মৌলিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের গল্পসাহিত্যে তিনি একটা অপরিহার্য জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর স্বতন্ত্র স্বর ইতোমধ্যে স্বীকৃত ও নন্দিত। বৃহত্তর বাংলার লৌকিক জীবনের কথাশিল্প সৃষ্টিতে তিনি যে সক্ষমতা, কুশলতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সেখানে তিনি অনন্য ও অসামান্য; বাংলাদেশের সমকালীন ছোটগল্পের প্রেক্ষিত সামনে রেখে বলা যায় অন্তত। জীবনের বিচিত্র রঙ-রেখা-রূপের সমাবেশ ও বহুবিধ শৈলী নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তিনি গল্পে এমন একটা ঐকতান সৃষ্টি করেছেন যে তাঁর গল্পগুচ্ছকে জীবনশিল্পের অর্কেস্ট্রা বলাই সঙ্গত। এই অর্কেস্ট্রার সুর আমাদেরকে মুগ্ধ, আনন্দিত ও স্পন্দিত করে। এখানেই কথাশিল্পীর সার্থকতা।
×