ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. অজয় রায়

একে একে নিভিছে দেউটি ললিত মোহন নাথের তিরোধান

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২২ জুলাই ২০১৬

একে একে নিভিছে দেউটি ললিত মোহন নাথের তিরোধান

আমি নিজে অতি সাধারণ মানুষ। কিন্তু আমি বন্ধুভাগ্যে সৌভাগ্যবান, আর সে কারণে গৌরবান্বিত এবং সেজন্য হয়তবা অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। উদাহরণ দিই দু’একটি : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এ বছরই ৮০ বছর পূর্ণ করলেন। ভুলে যাওয়ার আগে আমার এই সহৃদয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটিকে সবিনয় ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তিনি সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে আলোকিত করে রাখুন তাঁর ৮০তম জন্মদিনে আমার অন্তরতম অন্তর থেকে এই কামনা। তিনি আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্যকে উচ্চমার্গে নিয়ে গেছেনÑ বিষয়বস্তুতে, বিশ্লেষণে ও লেখনশৈলিতে-উপস্থাপনায়। সিরাজের সঙ্গে আমার পরিচয় আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনের প্রথম থেকেই। ছাত্র রাজনীতিতে ও সংশ্লিষ্ট ছিল তমুদ্দুন মজলিসের সঙ্গে, আর আমি ছিলাম মিটিং মিছিলে মাঠে সেøাগান দেয়া-চিকা মারা ছাত্র, ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের মেঠো কর্মী। সে সময় আমাদের আদর্শগত ভিন্নতা ছিল, তবে একটি বিষয়ে মিল ছিল তাহলো উভয় সংগঠনই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনকারী। অধ্যাপক চৌধুরীর আর একটি প্রশংসনীয় দিক যা আমাকে আকৃষ্ট করে তার সাধাসিধে পোশাক আশাক, শার্ট আর ট্রাউজার পড়তেন, শার্ট থাকতো ট্রাউজারের ওপর। অন্য উদাহরণটি হলো আমাদের সাহিত্যে, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে আমার অশেষ প্রিয় লেখিকা, অতিপ্রিয় ও ¯েœহভাজন বান্ধবী সেলিনা হোসেন; মাত্র কয়েক মাস আগে ৭৫ বছর পূর্ণ করেছেন। ‘রাজশাহী কন্যা’ তাকেও এই সুযোগে ¯েœহসিক্ত ভালোবাসা জানাই। তার লেখা উপন্যাস ’হাঙর-গ্রেনেড-নদী’ (?) আমি বার বার পড়ি।’ জয়তু সেলিনা, আপনার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতি হোক অপনার ৭৫ বছর পূর্তিতে আমার কামনা।’ অনেকেই সেলিনাকে পশ্চিমবঙ্গের খাতনামা ঔপন্যাসিক মহশে^তা দেবীর সঙ্গে তুলনা করেন। আমি এ ধরনের তুলনার বিরোধী। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বা সেলিনা হোসেনÑ এদের দু’জনের কেউই আমার আজকের লেখ্য বিষয় নয়। আমার আজকের উপজীব্য বিষয় সম্প্রতি প্রয়াত আমার অকৃত্রিম বন্ধু, সহকর্মী, বিশিষ্ট ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ললিতমোহন নাথ। তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে তার জগতে সুপরিচিত হলেও দেশবাসী তাকে খুব বেশি চেনেন না বলে আমার ধারণা। অধ্যাপক নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে আবসর নেবার পর অবসর জীবন যাপন করছিলেন অনেকটা নিভৃতে লোক চক্ষুর আড়ালে। অনেক দিন থেকে নানা অসুখে-বিসুখে ও বার্ধক্যজনিত সমস্যায় একটি জর্জরিত জীবন যাপন করছিলেন, চলচ্ছক্তিহীন হুইলচেয়ারে বাঁধা জীবন। প্রিয়তমা স্ত্রী আরতি ছিলেন তার বন্ধু ও সেবিকা। আমাদের দুর্ভাগ্য এমন একটি উচ্চমেধার মানুষটি গত ২ জুলাই, ২০১৬ তারিখে সকাল ৭ টায় ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের সকলকে শোকাচ্ছন্ন করে বিদায় নেন চিরতরে। কোন লোকে তিনি চলে গেছেন আমার জানা নেই, বিশ^াসও নেই। বারান্তরে যাবার আগে বলে রাখি, অধ্যাপক নাথ ও শ্রীমতী নাথ দুটি রতœ-সন্তানের জনক : বড় ছেলে উপল ও কন্যা-জামাতা যুক্তরাষ্ট্রবাসী এবং সেখানে উচ্চপদের চাকুরিতে আসীন। এবার আমি আমার তাৎক্ষণিক ম্মৃতি রোমন্থন করে এই বরেণ্য ও কৃতবিদ্য শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও প্রশাসক অধ্যাপক নাথের কিঞ্চিৎ পরিচয় আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছি। অধ্যাপক নাথ চট্টগ্রামের রাউজান এলাকার পটিয়ায় একটি সচ্ছল মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান, আমার পরিচয় হয়েছিল তার ছোটভাই শশাঙ্ক ও একটি বোন-জামাতার সঙ্গে। শশাঙ্ক শুনেছি মারা গেছে। তার বোন-জামাতার সম্পর্কও সে সময় ভাল যাচ্ছিল না। এ নিয়ে অধ্যাপক নাথ মনোকষ্টে ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ছিলেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে উপনীত হতে। আগেই বলেছি, কিশোর ললিত নাথ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কৃতিত্বের সঙ্গে পটিয়া স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় (১৯৫২) পাস করে ১৯৫৪ সালে ’কানুনগো পাড়া কলেজ’ থেকে ৪র্থ স্থান অধিকার করে আইএসসি পাস করেন। সে বছরই অক্টোবর মাসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হন জগন্নাথ হলের ছাত্র হিসেবে। এরপর নিয়মিত কোর্স শেষ করে ১৯৫৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএসসি এবং পরের বছর ১৯৫৮ সালে এমএসসি (পদার্থবিজ্ঞান-থিসিস গ্রুপ) পাস করেন ১ম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। তিনি এমএসসিতে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ইন্নাস আলীর অধীনে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করেন। ঐ তার গবেষণা জীবনের সূত্রপাত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমিও তার আগের বছর (১৯৫৭) পদার্থবিদ্যায় এমএসসির স্তরে অধ্যাপক আলীর অধীনে পরীক্ষণ পদার্থ বিদ্যায় কাজ করেছিলাম। আমার গবেণার শিরোনাম ছিল, যতদূর মনে পড়ে, ‘উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ চযড়ঃড়সঁষঃরঢ়ষরবৎ ঞঁনব ঈরৎপঁরঃ ভড়ৎ ঃযব ফবঃবপঃরড়হ ড়ভ ভববনষব ৎধফরধঃরড়হ পড়সরহম ভৎড়স ঃযব ড়ঁঃবৎ ংশু’। আর ললিত নাথের গবেষণা ছিল নিউক্লিয় বিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। বলাবাহুল্য ললিত নাথ এমএসসিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বেরিয়ে আসেন ১৯৫৮ সালে। এর পরপরই ললিত নাথ সম্ভবত ১৯৬০ সালের দিকে ঢাকা আণবিক শক্তি কেন্দ্রে জুনিয়র গবেষক বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন এবং ৬১-৬২ সেশনে বিলেতে চলে যান উচ্চতর গবেষণা ও ডিগ্রীর জন্য। বছর চারেক পরে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ^বিদ্যলয় থেকে অধ্যাপক ক্রেমারের অধীনে গবেষণা করে পিএইচডি উপাধি অর্জন করেন। তিনি ষাটের দশকের শেষে বা সত্তরের দশকের প্রথমে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রে বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। যতদূর মনে পড়ে দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ড. নাথ সপরিবারে লন্ডনে চলে যান ইম্পিরিয়াল কলেজে একটি পোস্ট-গ্রাজুয়েট ফেলেশিপ নিয়ে এবং অধ্যাপক আবদুস সালামের তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হলে, আমি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিলে যুদ্ধের এক পর্যায়ে সম্ভবত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে মুজিবনগর সরকারের আদেশে আমাকে সে সময় প্রতিষ্ঠিত পরিকল্পনা সেলের অনারারি সদস্য হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যানের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার নির্দেশ পাই। চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রিডার ড. মোজাফফর আহমেদ। সে সময় ড. আহমেদ বলেন, যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে ’আমরা বিশ^বিদ্যালয়ে যে যার পদে যোগ দেব।’ ড. আহমদকে অবশ্য বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করা হয়েছিল প্রত্যাবর্তনের পরপরই। আমরা দু’জনে একটি উদ্যোগ নেই আমাদের যে সব শিক্ষক বিদেশে আছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার। বিস্তারে না গিয়ে বলি সেই উদ্যোগের ফসল হলো ড. লতিফ চৌধুরী, অধ্যাপক কাইয়ুম সরকার, অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, ড. বিলায়েৎ হোসেন, ড. ললিত মোহন নাথ প্রমুখদের আমাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান। এর পর ঢাকা বিশ^বিদ্যলয়ের দীর্ঘ শিক্ষকতা করেছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। নানা শৃঙ্খলায় পাঠদান করেছেন, কোয়ন্টাম মেকানিক্স, ক্লাসিকাল মেকানিক্স ও ইলেকট্রোডাইনামিক্স তার ছিল প্রিয় বিষয়। হয়েছেন বিভাগের চেয়ারম্যান। অধ্যাপক নাথ পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ করে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা ও অবদানের জন্য প্রদান করা হয় ‘জধুুধশ ঝযধসং খরভবঃরসব অধিৎফ রহ চযুংরপং ২০১১’, ২০১১ সালে। এটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো: ঐবৎব রং ঃযব ড়ভভরপরধষ ষবঃঃবৎ ৎিরঃঃবহ রহ ইবহমধষর ঃড় চৎড়ভবংংড়ৎ খ. গ. ঘধঃয নু ঃযব জবমরংঃৎধৎ, উট. উট গড়হড়মৎধস রেজিস্ট্রারের অফিস ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ঢাকা ১০০ তারিখ ২০/১০/২০১১ ইং ইং রেজি:/শিক্ষা-৪/১১/১৪৭১৫ অধ্যাপক ললিত মোহন নাথ (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ^বিদ্যলয় ঢাকা-১০০০ এবং ১২/এ, মনিপুরী পাড়া, গেট নং-৪ হোসেন টাওয়ার, ফ্ল্যাট নং-২বি তেজগাঁও, ঢাকা-১২১৫ বিষয় :- ‘জধুুধশ ঝযধসং খরভবঃরসব অধিৎফ রহ চযুংরপং ২০১১’ প্রিয় মহোদয় উপরোক্ত ‘অধিৎফ’ এর বিষয়ে রাজ্জাক-শামসুন গবেষণা বৃত্তি/পুরস্কার তহবিলের দাত্রী ড. সুলতানা নরুন নাহার-এর মনোনয়ন এবং অধ্যাপক এ. এম. হারুর-অর-রশীদ (বিষয় অধ্যাপক) কর্তৃক সমর্থিত, রাজ্জাক শামসুন গবেষণা বৃত্তি/পুরস্কার তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ডেও (২৬/০৭/২০১১) সুপারিশ ও সিন্ডিকেটের (১০/গ৮/২০১১) সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী জানাচ্ছি যে, পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে অবদানের জন্য আজীবন স্বীকৃতিস্বরূপ আপনাকে উপরোক্ত তহবিল থেকে নগদ ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র) টাকা মূল্যের ‘জধুুধশ ঝযধসং খরভবঃরসব অপযরবাবসবহঃ অধিৎফ রহ চযুংরপং ২০১১’ মঞ্জুর করা হয়েছে। একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আপনাকে উক্ত নগদ পুরস্কার ও সাইটেশন প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানের তারিখ পরবর্তী সময়ে আপনাকে অবহিত করা হবে। আপনার বিশ^স্ত স্বাক্ষর অস্পষ্ট রেজিস্ট্রার ঢাকা বিশ^বিদ্যলয় ১০/১০/২০১১ ইং এই কৃতবিদ্য পদার্থবিজ্ঞানী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনেও অবদান রেখেছিলেন নানা কমিটির সদস্য হিসেবে। পাশাপাশি জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হিসেবেও দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনে অবদান রাখেন। অধ্যাপক নাথ ছিলেন সমাজ সচেতন মানুষ। রমনা কালী মন্দির, ঢাকেশ^রী মন্দির .. .. প্রভৃতি নানা ধর্মস্থান ও উপসনালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা মহানগর পূজা পরিষদ, জাতীয় পূজা পরিষদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ.. ..সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। সম্ভবত ২০০১ সালে অবসর নেন বিশ^বিদ্যালয় থেকে। জয়তু অধ্যাপক নাথ। আমার স্মৃতিতে আপনি চির অম্লান।
×