ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজুল এহসান

নাটক ঘোচাক অন্ধকার

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২২ জুলাই ২০১৬

নাটক ঘোচাক অন্ধকার

মূল লেখায় প্রবেশের আগে বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’টি পথ নাটকের দু’টি দৃশ্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। পাঠকের সুবিধার্থে একটু ব্যাখ্যারও প্রয়োজন। প্রথম নাটকটি মামুনুর রশীদের ‘আগুনের ডালপালা’ থেকে নেয়া হয়েছে। নাটকের চরিত্রগুলো সচেতন পাঠকমাত্রই চিনবেন। এরা একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে দ-িত। এ বিষয়টি সাম্প্রতিক। তবে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু বা দ- কার্যকরের অনেক আগে রচিত এ নাটক। নাটকের চরিত্রগুলোর বয়ান ও সংলাপ থেকেই ধারণা পাওয়া যাবে এদের অতীত-বর্তমান সম্পর্কে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা (অর্থাৎ আজ যে জঙ্গী আমরা দেখছি) কী ছিল তা অনুধাবন করা সহজ হবে। নাটকের মূল বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে আদালতের দৃশ্যে। এবার দেখা যাক দৃশ্যটি। ...‘কাদের : (চিৎকার করে ওঠে) ফুটাই দে শুক্কুইজা-ফুটাই দে জজ : কী ব্যাপার? কী বলছেন তিনি- রহমত : হ্যাঁ আমারও প্রশ্ন কী বলছেন তিনি- জজ : হ্যাঁ আপনার মক্কেল কী বলছেন? রহমত : আমার একটা অনুমানের কথা বলতে পারি। শুক্কুইজা ফুটাই দে, এই আসামির বংশানুক্রমিকভাবে এক দুর্ধর্ষ মাস্তান আছে যার নাম শুক্কুইজা, ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে তার পিতার কণ্ঠেও শোনা গিয়েছিল শুক্কুইজা কডে?... ....রহমত : ঈড়হঃবসঢ়ঃ ড়ভ ঈড়ঁৎঃ ণড়ঁৎ ঐড়হড়ঁৎ. জজ : ঠিক আছে, ঈড়হঃবসঢ়ঃ ড়ভ ঈড়ঁৎঃ. কাদের : হান্দাইয়া দিয়ুম। (ফোন আসে। রহমত মেসেজটা দেখে।) রহমত : ঙয এড়ফ! ণড়ঁৎ ঐড়হড়ঁৎ, আজকের মতো আদালত অফলড়ঁৎহ করার ঐঁসনষব ঝঁনসরংংরড়হ করছি। কাদের : ডরাইয়া গেছে হালার পুত। জজ : এই নিয়ে আপনি তিনবার আদালত অবমাননা করলেন। রহমত : ইওর অনার! এই মাত্র ম্যাসেজ পেলাম আমার একমাত্র পুত্রকে ইউনিভার্সিটি থেকে আসার পথে কিডন্যাপ করা হয়েছে। জজ : ঠিক আছে। আগামীকাল সকাল দশটা পর্যন্ত আদালত মুলতবি করা হলো। (দ্রুত বেরিয়ে যায় রহমত)। মান্নান : আপনার সাথে মিয়া চলাফেরাই মুশকিল। সব জায়গায় আচানক একটা ভেজাল লাগাইয়া দেন। এইডা আদালত, আপনি নাকি আইন নিয়া লড়াচড়া করছেন। সোবহান : আর আমরা এখন কী রকম ফাপড়ে আছি, বোঝেন না। কাদের : আরে রাখেন মিয়া ‘৭২ থেকে ’৭৫ নগদ ফাপড়ে ছিলাম না। কী অইছে? কী করতে পারছে। আমি বুঝি মারদাঙ্গার ওপর ওষুধ নাই। মান্নান : হেইডা তো বুঝছি। ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালাকে বাদ- সোবহান : আপনে উল্টা পাল্টা করবেন, মোহতারেমা ঝামেলা করবে আর আমরা গুছাইয়া দেবো সারাজীবন। আমার জঙ্গি ক্যাডাররা জান দিচ্ছে, আর উনারা টেকা পয়সা নিয়া ফুর্তি করবেন। আব্দুুর রেজ্জাক সাহেব গোস্বা হইলেন নি?....’ দ্বিতীয় পথ নাকটির অংশ বিশেষ নেয়া হচ্ছে মাসুম রোজা’র ‘আদম টেস্ট’ থেকে। এখানে রাজাকার চূড়ামণি রাচু তার তিন অনুচরকে স্বপ্নে পাওয়া অলৌকিক আতশকাচ দিয়ে পাঠিয়েছে মানুষের মধ্যে যাকে দেখতে পাবে গলাছিলা শকুন তাকে কতল করতে। সেই গলাছিলা শকুন তাদের দৃষ্টিতে বেধর্মী নাস্তিক, কাফের, অমানুষ। এটা চিহ্নিত করা যাবে ওই আতশকাচ দিয়ে। শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখা যাক নাটকের শেষ দৃশ্যে। ‘... রাচু : নালায়েকের মতন কী বলতেছো তুমি? দেশ ভরতি দুশমন আর তোমরা একটারেও কতল করতে পারো নাই? কী আশ্চর্য! অনুচর-২ : আপনি যে খুয়াবি আতশ দিছেন ওস্তাদজি, তাতে একজনেরও গলছিলা শকুন দেখা যায় নাই। অনুচর-৩ : (অনু-১-এর কাছ থেকে আতশকাচটা নিয়ে) এইটা দুই নম্বর আতশ ওস্তাদজি। আপনার খুয়াবের মধ্যে ভেজাল ছিল। কপি অ্যান্ড পেস্ট মারা খুয়াব ছিল আপনার। রাচু : (রাগে) বাখোয়াজ বন্ধ করো। মিয়া খুনকার! স্বপ্নে আবার কপি পেস্ট কীভাবে হয়? অনু-৩ : গুস্তাকি মাফ করবেন। (বলে আতশকাচটা নিয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে)। রাচু : (অনু-১ এবং অনু-২ কে) আমার মনে হয় তোমাদের ভাবিসাব মানে আমার পয়লা স্ত্রী কোনো শয়তানি করেছে। এই অসভ্য মেয়লোকের উপর বিশ্বাস নাই। সে হয়তো খুয়াবি আতশ রেখে বাতিল আতশ দিয়ে দিয়েছে। যাও তার বাড়িতে অ্যাটাক দাও। আসল আতশ নিয়া আসো। (অনু-৩ আতশকাচ দিয়ে এদিক ওদিক দেখছিল এমন সময় আতশটা রাচুর দিকে ঘুরিয়ে দেখেই চিৎকার করে ওঠে)। অনু-৩ : এ আল্লা এ আমি কী দেখলাম! দুজন : কী দেখেছেন? অনু-৩ : আসেন আপনারাও দেখেন। (রাচুর দিকে আতশ ধরে রাখে। ওরা এসে দেখে)। রাচু : কী দেখা যায়? কী দেখে চিৎকার দিয়া উঠলা? (আতশে দেখতে দেখতেই তিনজন বলে) তিনজন : গলাছিলা শকুন!!? রাচু : কোথায় গলাছিলা শকুন! কে গলাছিলা শকুন? অনু-৩ : আপনে, ওস্তাদজি আপনে গলাছিলা শকুন। রাচু : আমি গলাছিলা শকুন!!? অনু-১ : হ্যাঁ আপনে!...’ দু’টি নাটকের দৃশ্য, বিষয়বস্তু বা বক্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় সাংস্কৃতিক জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সময় ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ আমরা অতীতে পেয়েছি বহুবার। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের সময়জুড়ে জাতিকে সচেতন ও স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষত ১৯৫২ সালের পরবর্তী সময় ১৯৭১ পর্যন্ত অনন্য ভূমিকার জন্য জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে এ অঙ্গনকে। রাজনীতির হাত ধরে সমান্তরালভাবে যে সংস্কৃতি চলে তা ১৯৭১-এ আমরা দেখেছি। ১৯৭১-এ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা অনন্য সাধারণ। সে অনেক বড় ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশেও এ অঙ্গনের ভূমিকা উজ্জ্বল। বিশেষ করে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে চির ভাস্বর হয়ে আছে এ অঙ্গনের ভূমিকা। তারপর আমাদের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে পাশে পেয়েছি। গণতন্ত্রের শত্রু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশকারী শক্তি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি এমন মহলের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় কূপম-ূকতা, অমানবিক সব অপশক্তির বিরুদ্ধে এ অঙ্গন জাতির অন্যতম দিশারী হিসেবে পাশে থেকেছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বড় অংশজুড়ে নাট্যসাহিত্যের চর্চা এগিয়ে দিয়েছে উদ্দেশ্যের মিছিলের এক ধাপ। বিশেষত মঞ্চ নাটক ও পথ নাটকের ভূমিকা তো অনস্বীকার্য। মঞ্চ ও পথ নাটক গণমানুষের কথা এতটাই বলেছে যে, আগামী প্রজন্ম এই দুই মাধ্যমকে স্মরণ করবে কৃতজ্ঞচিত্তে। মানুষের কাছে সরাসরি মেসেজ পৌঁছানোর মাধ্যম সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মঞ্চ ও পথ নাটক অত্যন্ত শক্তিশালী। এই দুই মাধ্যম অতীতে যেমন উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে বর্তমানেও রাখছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ধর্মের নামে যে নারকীয় হত্যকা- হয়ে গেল সমাজের আর দশটা সেক্টরের মতো সাংস্কৃতিক তথা নাট্যজগতও যে আলোড়িত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের অন্যতম পুরোধা প্রতিনিধিত্বশীল, নাট্যদল, নাট্যব্যক্তিত্ব নির্দেশকদের কাছে এ বাস্তবতায় আমরা কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম। প্রশ্নগুলো ছিল এমনÑ হ উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের জঙ্গী সম্পৃক্ততাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? হ তারুণ্যের এ অবক্ষয়ে নানা কারণের মধ্যে সুস্থ ও সুষ্ঠু সাংস্কৃতি চর্চার অভাব বলে অনেকেই মনে করেন। এই অভাবটা সৃষ্টি হলো কীভাবে? রাজনৈতিক দৈন্য কতটুকু? হ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মকে ব্যবহার করে জঙ্গীবাদের দৌরাত্ম্য কতদূর যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? হ মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এ জঙ্গীবাদে মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও সাম্রাজ্যবাদ। এর প্রতিরোধে ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ হতে পারে কীভাবে? হ ধর্মীয় মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ নিয়ে আপনার নাট্য সংগঠন বা আপনি কী ভাবছেন? হ আপনার বা সংগঠনের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাই। হ এসব প্রশ্নের ব্যাপারে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। মন খুলে অনেকে কথা বলেছেন। তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। এখানে তাদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো। রামেন্দু মজুমদার সাম্মানিক সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উচ্চশিক্ষিত তরুণরা জঙ্গীবাদে সম্পৃক্ত হওয়া মানেই সমাজের অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ ক্ষত চিত্র। এটা একদিনে হয়নি। দেশ-সমাজ-জাতি যাদের ওপর নির্ভর করবে তাদের যদি এমন পরিণতি হয় তা শুধু দুঃখজনকই নয় বেদনাদায়ক। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যের কারণে এটা হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনৈতিক দৈন্য থাকলে সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। যে তরুণরা জঙ্গী হামলায় সম্পৃক্ত আমরা দেখছি তাদের অনেকেরই শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই অর্থাৎ বাঙালী সংস্কৃতিচর্চা তারা করে না। গান, নাটক, সাহিত্য মনকে মানবিক করে তোলে। এদের মধ্যে সেই চর্চা নেই। এই শূন্যতা পূরণ করে সন্ত্রাসবাদীরা। তাদের মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট করে। মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে যায় তারুণ্য। পরকালে স্বর্গের লোভ দেখিয়ে মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করে। মানুষ হত্যা বা জঙ্গী কর্মকা-কে এরা এ্যাডভেঞ্চার মনে করে; অথচ ইসলাম কেন, কোন ধর্মেই মানুষ হত্যা অনুমোদন করে না। এ অবস্থা একদিনে হয়নি তা বলেছি। এর আলামত অনেক আগেই পাওয়া গিয়েছিল। গোপনে জঙ্গী প্রশিক্ষণ হচ্ছে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে আমরা অনেকবার বলেছি। কোন সরকারই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়নি। ভোটের রাজনীতি এর জন্য দায়ী। এরা সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে এমনভাবে জেঁকে বসেছে সহসা থামবে বলে মনে হয় না। জঙ্গীরা অনেক দূর যেতে পারে। আরও হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। তবে আশার কথা বর্তমান সরকার এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। এই বাস্তবতা নিরসনে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণ। এ জাগরণ না হলে সমাজের চলমান বাস্তবতা থেকে মুক্তি নেই। সমাজের কাছে দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে আমরা এবং আমাদের নাট্যদল ‘থিয়েটার’ নিয়ে অচিরেই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। আমরা নাটক মঞ্চায়ন করব। নাটকের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে চাই। মনের অন্ধকার দূর করতে চাই। করতে পারি সেমিনার। মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে চাই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। কোন ধর্মই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয় না।’ মামুনুর রশীদ নাট্যব্যক্তিত্ব, কর্ণধার, আরণ্যক নাট্য গোষ্ঠী আগে আমাদের বুঝতে হবে এই তথাকথিত শিক্ষিত তরুণরা কোথা থেকে আসছে। এরা আসছে এমন এক বলয় থেকে যেখানে কোন সাংস্কৃতিক চর্চা বা চর্চার পরিবেশ নেই। সমাজের উচ্চবিত্ত অথচ সাংস্কৃতিক দৈন্যে ভরপুর। যেখানে শিক্ষা নিচ্ছে সেখানে আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির কোন যোগ নেই। তারা ভিন্ন ভাষার ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে। যা আমাদের মূলধারার সঙ্গে সংশ্রব নেই। যে কারণে তাদের মন ও মনন বেড়ে উঠছে অন্যভাবে অর্থাৎ আমাদের জন্য নেতিবাচকভাবে। এদের সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়নির্ভর। পারিবারিক স্নেহ-মমতা, শিক্ষা থেকে বেশিরভাগই বঞ্চিত। এদের টার্গেট ও জঙ্গীবাদচর্চা চলছে অনেকদিন ধরেই। এটা অবশ্যই আমাদের শুদ্ধ ও সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার অভাব ও শূন্যতার সুযোগ নিয়েছে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। এ সমস্যা দেশের অপশক্তির সঙ্গে মিলেছে আন্তর্জাতিক কালো শক্তি। বিদেশী নাগরিক হত্যা কি প্রমাণ করে না এর সঙ্গে দেশের বাইরের শক্তিও জড়িত? জঙ্গীবাদের উত্থান হলেও আমরা আগে দেখেছি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশি একটা সুবিধা করতে পারেনি। কেননা বাঙালীর রক্তে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক ও কোন অপশক্তির কাছে মাথা না নোয়ানোর চেতনা। যে কারণে এখানে সুবিধা করতে পারবে না। মনে রাখা দরকার, বাঙালী যুদ্ধ করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তারা যে কোন কালো শক্তি রক্ত দিয়ে প্রতিরোধ করতে জানে। এর প্রতিরোধ কিংবা তরুণ সমাজকে ফিরিয়ে আনতে সবার আগে প্রয়োজন গণসচেতনতা। প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। আমরা আমাদের দল নিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে তাড়াতাড়িই নাটক নিয়ে মানুষের দুয়ারে যাব। আতাউর রহমান অভিনেতা, সাধারণ সম্পাদক, নাগরিক এই জঙ্গীদের আমি কোনভাবেই উচ্চশিক্ষিত বলব না। এরা শিক্ষাকে ধারণই করে না; করলে মানুষ হত্যা করতে পারত না। এদের মস্তিষ্কে এমনভাবে জঙ্গীবাদের সহিংস দর্শন প্রবেশ করানো হয় তা অনেকটাই ড্রাগ অ্যাডিকশনের মতো। এদের নেশাসক্ত করা হয় নিশ্চিত স্বর্গবাসের কথা বলে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করলে এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। তরুণরা এদের খপ্পরে পড়ছে। এটাতো অনেক দিন ধরেই চলছে বিভিন্ন মাত্রায়, নানা নামে। প্রকাশ্যে কিংবা ছদ্মবেশে। দেশের পার্বত্যাঞ্চলে জঙ্গী প্রশিক্ষণের কথা পুরনো। জঙ্গী প্রশিক্ষণের জন্য হেলিকপ্টারে চোখ বেঁধে গহিন অরণ্যে তরুণদের নামিয়ে দেয়ার খবর বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। সাকা চৌধুরীর ছেলে তো প্রকাশ্যে বলেছে তার পিতার ‘হত্যা’র প্রতিশোধ সে নেবেই। এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে কারা এর সঙ্গে জড়িত। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিও যোগ দিয়েছে। পৃথিবীতে অনেক আগে থেকেই জঙ্গীবাদ রয়েছে। বিভিন্নভাবে আমরা এটাকে দেখেছি। এ জঙ্গীবাদের শিকার হয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন বাংলাদেশে চলছে ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ। তরুণরা পরিবার থেকে তেমন সহযোগিতা পাচ্ছে না। মা-বাবা ব্যস্ত। পরিবারে কেউ কবিতা পড়ছে না, রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে না। আমরা আগে বলেছি সাংস্কৃতিক কর্মকা- যেন পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গান, কবিতা, নাটকের অংশ যেন চর্চিত হয়। মরমীবাদের চর্চা জোরালো করতে হবে। মরমীবাদ মানুষকে সহনশীল হতে শেখায়। ধর্মের নামে এই সহিংসতা বেশিদিন থাকবে বলে মনে হয় না। কেননা যে রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবেলায় সাংস্কৃতিক কর্মীরা এগিয়ে আসবে। সৃষ্টি হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা এ মুহূর্তে বিশেষ প্রয়োজন। আমরা সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছি। মঞ্চ থেকে অচিরেই আমরা মানুষকে সহিংসতার বিরুদ্ধে ডাক দেব। সুদীপ চক্রবর্তী নাট্যনির্দেশক, চেয়ারম্যান, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সুশিক্ষায় শিক্ষিত কোন তরুণ নাশকতায় সম্পৃক্ত হতে পারে না। জঙ্গীবাদে জড়িত তরুণদের সাংস্কৃতিক দৈন্য রয়েছে। এর মূল কারণ শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির দূরত্ব। শিক্ষায় যদি সংস্কৃতির প্রভাব না থাকে সে শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একটা সময় আমরা দেখেছি স্কুল পর্যায়ে অন্তত বছরান্তে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ হতো। এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও তা হয় না। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক জরুরী। আমরা যত এমন অবস্থা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি ততই খাদের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি। আজকের তরুণ ও সমাজের অবক্ষয়ে শুধু রাজনৈতিক দৈন্যই নয়, সবাই কমবেশি দায়ী। জঙ্গী কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এরা দেশ ও এদেশের মানুষের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে বিনষ্ট করেই তবে ক্ষান্ত হবে। যারা এসব করছে তারা সংখ্যায় কম। ভয়ের কোন কারণ দেখছি না। আমরা যদি জাগি তবে জাগরণের ধুলায় এরা চাপা পড়ে যাবে। তবে এ মুহূর্তে বড় প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তার আগে নিশ্চিত করতে হবে স্কুল, হাইস্কুলসহ শিক্ষার প্রতিটি ধাপে সাংস্কৃতিক কর্মকা-। এ দায়িত্ব সবাই কাঁদে নিলে কোন অপশক্তির বীজ আর অঙ্কুরিত হবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিনই এদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছি আমার পক্ষ থেকে। আকতারুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন জঙ্গীর মতো একটা হীন ও নোংরা কাজে তরুণরা জড়িত হচ্ছেÑ এটাকে আমি মনে করি রাজনৈতিক। শুধু রাজনৈতিক বললে কম বলা হয়Ñ সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা সৎ রাজনীতি তো দূরের কথা কোন ধর্মই প্রশ্রয় দেয় না। তরুণ সমাজের এহেন অপকর্মে জড়িত হওয়ার অন্যতম প্রধান দায় আমাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দৈন্যের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখলাম সংস্কৃতি চর্চার ভিন্নরূপ। একটা ইতিবাচক সাড়া দেখা গেল, এলো জোয়ার। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক কালজয়ী সৃষ্টি আমরা দেখলাম। কিন্তু পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন, গণতন্ত্রের শত্রু, সামরিক জান্তার সরকারগুলোর আমলে দেখা দিল সাংস্কৃতিক চর্চার দীনতা। সুস্থ ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার অভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গন হতে থাকে অবহেলিত। শিক্ষাঙ্গনে তারুণ্যের মানবিক বিকাশ ঘটাতে সহায়ক ছাত্র সংসদ। ত্রিশ বছরের অধিক কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না। তাহলে তারুণ্যের মননের বিকাশ বা পরিবর্তন হবে কীভাবে? দেশপ্রেমের নৌকায় বাতাস কম লাগছে। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তারুণ্যের ধর্মানুযায়ী নতুনের প্রতি কৌতূহল মেটাতে লাগল নানাভাবে ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে। জঙ্গীবাদ এখন শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বৈশ্বিক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। দেশে যা ঘটছে তা শুধু দেশের অভ্যন্তর থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তা নয়। এটা দেশের বাইরে থেকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যেহেতু এ জঙ্গীবাদ রাজনৈতিক সেহেতু এর মোকাবিলা হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। এর পাশাপাশি ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ না হলে তা পূর্ণতা পাবে না। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এই যুদ্ধের সৈনিক। আমরা চেষ্টা করব সকল সহিংসতা, কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে লড়াই চলিয়ে যেতে। সারাদেশে ছোট ছোট প্রযোজনার মাধ্যমে আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে প্রতিটি মানুষের কাছে। আহাম্মেদ গিয়াস সাধারণ সম্পাদক, পথ নাটক পরিষদ যেসব তরুণ জঙ্গীবাদে দীক্ষা নিয়েছে তাদের উচ্চশিক্ষিত বলতে মন চায় না। দৃশ্যত তারা উচ্চশিক্ষা নিলেও কার্যত মন ও মননে তারা শিক্ষিতই হতে পারেনি। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিশেষ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কতটুকু বাংলা ও বাঙালিত্ব ধারণ করে? একটা সময় শিক্ষাঙ্গনে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পর পর দেশ-জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার বাক্যসংবলিত শপথ পাঠ করা হতো। এখন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ রীতির প্রচলন নেই। বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহ এখন দৃশ্যমান হয় না। একটা সামাজিক দায়বদ্ধহীন প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে। একটা জিনিস নতুন প্রজন্মকে মনে রাখতে হবেÑ এই সাংস্কৃতিক দৈন্যর বীজ রোপিত হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ’৭৫-এ সপরিবারে নিহত হওয়ার পর। অনেকদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে অপসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। বর্তমান এই জঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধীদের সৃষ্টি। মাদ্রাসার গরিব শিক্ষার্থীর পর এবার ওরা টার্গেট করেছে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। যাদের অর্থমোহ ততটা নয় যতটা আছে দরিদ্র মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর। অর্থ সাশ্রয়ের এক দারুণ কৌশল এর থিঙ্ক ট্যাঙ্কারদের! এরা খুব একটা বেশি দূর যাবে বলে মনে হয় না। বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক মন তা ঠেকিয়ে দেবে। অবশ্য এর জন্য আগে প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব। সংস্কৃতির সুন্দরতা সমাজে আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সুন্দর প্রতিষ্ঠা পেলে অসুন্দর পালিয়ে যাবে দ্রুত। এর জন্য সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন সবার আগে। আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে নতুন কর্মসূচী দেব। পথ নাটক মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতাকে বহন করে। এটা যেহেতু একেবারে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় যেতে পারে সেহেতু আমরা নতুন প্রেরণাদায়ী নাটক নিয়ে যাব গণমানুষের কাছে। আমরা অচিরেই সব দলের সঙ্গে বসে কর্মসূচী নেব। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামও থাকবে। শুভাশিস সিনহা কবি-নাট্যকার সভাপতি, মণিপুরি থিয়েটার সমাজে আদর্শহীনতা, বিত্তবান জীবনের স্বাভাবিক পারিবারিক সম্পর্কের ছেদ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, স্বপ্ন ও কল্পনা থেকে বহুদূরের জীবনযাপন, শেকড়বিমুখ বাস্তবতা সবকিছুই জঙ্গী উত্থানের জন্য দায়ী। পুঁজিবাদের যে ভোগনির্ভর পণ্যবেসাতির কারবার দুনিয়াব্যাপী গড়ে উঠেছে, সেটাই মূলত তারুণ্যের সুষ্ঠু সুন্দর সংস্কৃতিচর্চার পথ রুদ্ধ করে ফেলেছে। প্রযুক্তি মানুষের যৌথ বিনোদনকে দূরে হটিয়ে একলা বিচ্ছিন্ন নিভৃত আত্মরতির চিন্তাহীন বিনোদনকে সহজলভ্য করে দিয়েছে। রাষ্ট্র তার নিয়ামক বা প্রভাবক শক্তিগুলোর মুনাফার হিসাব মেলাতে গিয়ে ভাবগত ক্ষতির এই এলাকাকে চিহ্নিত করতে পারছে না বা করতে চাচ্ছে না। এ জন্যই সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থা, মানুষের বসবাসের ধরন, নানান সম্প্রদায়ের একত্রে অবস্থানের যৌথ সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সামাজিক ঘনবদ্ধ যোগাযোগ সবকিছু মিলিয়ে মনে হয় এখানে মৌলবাদ বা জঙ্গীবাদ কোনটাই দীর্ঘকাল প্রভাব ফেলতে পারবে না। কথা হলো শুধু মানুষ মন থেকে না চাইলে তো হবে না, রাজনীতিকদের সেখানে জোরালো নেতৃত্ব দিতে হবে। আমাদের রাজনীতি সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এটাই দুঃখজনক। সাংস্কৃতিক যুদ্ধ অনেক ব্যাপক ও গভীর একটা বিষয়। বাংলাদেশ কিন্তু কেবল ভাষার জাতীয়তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশ নয়। সেটা রাজনীতির বিষয়; কিন্তু এর আত্মায় অনুরণিত হয় এক গভীর সাংস্কৃতিক ঐক্যের সুর, যা লোকসমাজে চর্চিত নানান কৃত্য লীলা গান পালার মধ্য দিয়ে সূচিত। সেখান থেকে বাংলার আত্মাকে অনুভব করতে পারলেই ঐক্যের শক্তি ও শরীর বোঝা যাবে। সেই শক্তিই এ লড়াইয়ের মূল হাতিয়ার। আমরা মণিপুরি থিয়েটার মানুষের আবহমান কালের মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে কাজ করি, যেখানে যুক্ত থাকে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ, স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, লড়াই। সে সবকিছুর মধ্য দিয়েই সমকালের সব সঙ্কট বিমূর্তভাবে উঠে আসবে।
×