ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

ঠাকুর বাড়ির তিন নারী

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২২ জুলাই ২০১৬

ঠাকুর বাড়ির তিন নারী

সারদা সুন্দরী দেবী রবীন্দ্রনাথের মা সারদা সুন্দরী দেবী ছিলেন সেকালের যশোর জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর আদরের কন্যা। তাঁর সঠিক জন্মসন জানা যায়নি। ১৮৩৪ সালে সতেরো বছর বয়সী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। সর্বশেষ সন্তান রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় তাঁর বয়স চৌত্রিশের মতো। তিনি ছিলেন পনেরো সন্তানের জননী। ঠাকুর বাড়ির একাধিক সদস্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, সারদা দেবী সন্তানদের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে পারতেন না। কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। বিভিন্ন লেখায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্কের মধুরতা ফুটে উঠেছে। ১৮৭৫ সালের ১১ মার্চ সারদা দেবী মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের যখন মৃত্যু হয় তখন কবিগুরুর বয়স মাত্র তেরো বছর। কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্র সাহিত্যে, তাঁর জীবনের যে ক’জন নারীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তার বৌদি কাদম্বরী দেবী। কাদম্বরী দেবীর আসল নাম ছিল মাতঙ্গিনি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন কবির সাহিত্যের অনুপ্রেরণাদাত্রী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর বিয়ে হয় ৫ জুলাই ১৮৬৮ সালে। কাদম্বরী ঠাকুর বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিলেন মাত্র নয় বছর বয়সে। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র সাত বছর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নানারকম কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন বলে কাদম্বরী দেবী একাকিত্বে ভুগতেন। শ্যামা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন বউ কাদম্বরীর কথা উল্লেখ করেছেন। ‘উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণ, গলায় পলার হারখানি চেয়েছি অবাক মানি তার পানে বড় বড় কাজল নয়ানে, অসঙ্কোচে ছিল চেয়ে নব কৈশরের মেয়ে।’ প্রায় সমবয়সী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী। তাই ছোটবেলা থেকেই খেলার সাথী ও ভাল বন্ধু ছিলেন তারা। রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় মাকে হারানোর শোক তিনি ততটা বুঝতে পারেননি, কারণ কাদম্বরী দেবী মায়ের অভাবটা বুঝতে দেননি। কাদম্বরী দেবী ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪ সালে আত্মহত্যা করেন। তার অকাল প্রয়াণ কবির মনে গভীর শোকের ক্ষত সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন গান ও কবিতায় কাদম্বরী দেবীকে খুঁজে পাওয়া যায়। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর কবি বলেছেন যে মৃত্যু তাঁকে মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, পরম বিচ্ছেদের বেনায় দীর্ণ করেছিলÑ তা হলো তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর অকাল প্রয়াণ। এই মৃত্যুর সম্পর্কে তিনি বলেছেনÑ ‘আমার ২৪ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইয়াছিল তা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ-শোকের সঙ্গেই মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছিল।’ মৃণালিনী দেবী ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর ২২ বছর বয়সে হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবেই বিয়ে হয় রবীন্দ্রনাথের। খুলনা জেলার ফুলতলা গ্রামের বেনী মাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারণীর বয়স তখন বারো বছর। বেনী মাধব ছিলেন ঠাকুর এস্টেটের একজন সামান্য কর্মচারী। বিয়ের পরপরই নতুন বধূর নামকে আধুনিক করার জন্য নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই গুণবতী নতুন বৌ বাড়ির সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সাংসারিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে অনেক সম্মান করতেন ও ভালবাসতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে শিক্ষিত করেছিলেন ও পত্র লেখা শিখিয়েছিলেন। নিয়মিত স্ত্রীর পত্র না পেলে মন খারাপ হতো তাঁর। মৃণালিনীকে নিয়ে তার সাহিত্যে তেমন লেখালিখি না থাকলেও তাদের নিজেদের মধ্যে নীরব ভালবাসার আদান-প্রদান হতো। সাংসারিক জীবনে নানান সময়ের ভাল থাকা ও মন্দ থাকার মাঝে মৃণালিনী দেবী সবসময়েই কবির পাশে থেকেছেন ও তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। পরবর্তীতে বেশ কয়েক মাস রোগে ভুগে ৭ অগ্রহায়ণ ১৩০৯ মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে মৃণালিনী দেবী মৃত্যুবরণ করেন। মৃণালিনী দেবীর স্মরণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘পথের পথিক করেছ আমায় সেই ভালো ওগো সেই ভালো সাথি যে আছিল নিলে কাড়ি কী ভয় লাগালে গেল ছাড়ি। একাকীর পথে চলিব জগতে, সেই ভালো মোর সেই ভালো।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে নারীকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সাহিত্যে তিনি নারীর আবেগ ও অনুভূতিকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। নারীকে তিনি শৈল্পিকভাবে তাঁর সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন। তার জীবনে যতজন নারী এসেছিলেন তারা প্রায় সকলেই তার সাহিত্যের প্রেরণার উৎস ছিলেন। তার অধিকাংশ সাহিত্যের নারী চরিত্রগুলো বাস্তব জীবনের সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণে তৈরি হয়েছে।
×