ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

রক্তাক্ত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সন্তানকে ফেরাতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২২ জুলাই ২০১৬

রক্তাক্ত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সন্তানকে ফেরাতে হবে

বঙ্গমাতা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল- পুণ্যে পাপে দুঃখ সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে। হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে চিরশিশু করে আর রাখিও না ধরে। বাঙালী থেকে মানুষ হবার জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তশিষ্ট কোটি কোটি বঙ্গ সন্তানকে ঘরের ক্ষুদ্রতর গ-িকে অতিক্রম করে বৃহত্তর বহিরাঙ্গনে পা রাখার উদাত্ত আবেদন জানান। দেশের সীমাবদ্ধ অঙ্গনকে পার করে বিশ্ব পরিসরে মুক্ত হওয়ার তাগিদ যেমন ছিল নিজের মধ্যে একইভাবে সব মানুষের মাঝে তা প্রত্যক্ষ করার আকুতিও তেমন ছিল। কিন্তু তখন বৈশ্বিক আঙ্গিনায় ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা, নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তির নব আবিষ্কার এবং সার্বজনীন সংস্কৃতির মিলনযজ্ঞ। যার কারণে সব সময়ই মিলতে আর মেলাতে চেয়েছেন। কিন্তু বিশ্ব পরিম-লে যুদ্ধের যে উন্মত্ততা ১৯১৪ সাল থেকে হিংসার বিষবাষ্প ছড়ায় তা রবীন্দ্রনাথকে যে কতখানি উদ্বিগ্ন আর ক্ষুব্ধ করেছে এর বিশদ বিবরণ তাঁর সৃষ্টিযজ্ঞে ছড়িয়ে আছে।উপরন্তু তিনি রক্তক্ষয়ী সম্পদ লুণ্ঠণ ও আতœঘাতী স্বদেশী আন্দোলনকে পছন্দ করেননি।এতে বাংলার অনেক সূর্যসন্তান ব্রিটিশ রাজশক্তির অবিচারের শিকার হয়,যা তাঁকে দারুনভাবে মর্মাহত করে।জীবনের ক্রান্তিলগ্নে প্রত্যক্ষ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভিক মহড়াও। আর এখন? একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে অমানবিক পৈশাচিক উন্মত্ততায় দিক, ভ্রান্ত, বিপন্নœ, উদীয়মান তরুণদের নিঃসঙ্কোচে রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার নতুন এক ধ্বংসযজ্ঞের করুণ ইতিহাস। যে বিশ্ব একদিন রবীন্দ্রনাথকে উদাত্ত আহ্বানে আপ্লুত করেছিল সে জায়গায় সমগ্র বিশ্বকে আজ দাবানলের মতো দগ্ধ করছে বিশ্ব সন্ত্রাস। ধর্মীয় মৌলবাদের নৃশংস থাবায় দেশ থেকে দেশান্তরের মানুষ আজ হতভম্ব, প্রকম্পিত এবং সমস্যাসঙ্কুল। নিজের সে, বিশ্বের সে, বিশ্ব দেবতার, সন্তান নহে গো মাত: সম্পত্তি তোমার। সন্তানকে বিশ্বের দরবারে জায়গা নিতে যাওয়া তো দূরের কথা পরিবারের গ-ির বাইরে পাঠাতেও আজ মা-বাবা শঙ্কিত এবং ভীতসন্ত্রস্ত নিজের দেশ ও বহির্বিশ্ব আজ জঙ্গীবাদ এবং নৃশংসতার হিংস্র দাপটে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত তথ্যপ্রযুক্তির এমন সমৃদ্ধির যুগে, জ্ঞান চর্চার চরম উৎকর্ষতার যুগসন্ধিক্ষণে মানবসভ্যতা আজ ভয়ঙ্কর পশুশক্তির আগ্রাসনেও নিপীড়িত, নির্যাতিত। এক পৈশাচিক অন্ধ উন্মাদনায় নতুন প্রজন্ম তরুণদের জীবন আজ সঙ্কটাপন্ন বিপদগ্রস্ত এবং অসহায়। এই অবধারিত অশনিসঙ্কেত এবং শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য থেকে উদীয়মান তরুণদের অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে উদ্দেশ্যহীন ভুল পথ আর মূল্যবান জীবন কখনও এক সুতায় গাঁথা হতে পারে না। কোন মানবিক এবং শান্তির ধর্ম যা কেবলমাত্র মানুষের মঙ্গলের জন্য তা কখনও দুর্যোগের কালো অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারে না। জীবন দেয়া এবং নেয়া কোনটাই ধর্মীয় অনুশাসনের আওতার মধ্যেই পড়ে না। কবি গুরু একদা নিজের সন্তানদের ঘর থেকে বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেখানে পরিস্থিতির কারণে আজ বড় বেশি দরকার পরিবারের সুদৃঢ় বন্ধন। ছেলেমেয়েদের জীবনযাত্রায় সর্বক্ষণিক নজরদারি। পারিবারিক শৃঙ্খলার মধ্যে সন্তানকে গড়ে তোলা বাবা-মার এখন সবচেয়ে বড় দায় হয়ে পড়েছে। মায়ের দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। প্রকৃতিগত কারণে মায়েরা সন্তান বাৎসল্য হয় এবং সন্তানের সঙ্গে একাত্মতাও গড়ে ওঠে। নেপোলিয়ানকে স্মরণ করে বলতে হয় একজন যোগ্য মাই একটি সুস্থ’ জাতি উপহার দিতে পারেন। পরিবার এবং শিক্ষা দুটোই একজন সন্তানের জীবনে অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। পিতামাতার আদর্শ যেমন সন্তানকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের পথ দেখায় একইভাবে একজন নীতিনিষ্ঠ শিক্ষক ও তাঁর ছাত্রদের চলার পথের দিশারী হতে পারেন। প্রতিটি মানুষ জন্মগত কারণেই কোন না কোন ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকেন। আর তাই ধর্মীয় শিক্ষাও যে কোন সন্তান তার পরিবার থেকেই অর্জন করে। ধর্মীয় শৃঙ্খলাবোধকে ধারণ করেই একটি শিশু বড় হতে থাকে। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই সুষ্ঠুভাবেই তার অনুসারীদের জন্য দিকনির্দেশনা দেয়া থাকে। সে আলোকেই পরিবার থেকেই একজন সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষায় গড়ে তোলা হয়। ধর্মীয় শিক্ষার যথার্থ বাহন একজন সন্তানের কাছে তার বাবা মা, স্নেহ, ভালবাসা আর মায়ামমতা দিয়ে যে বাবা-মা তাকে বড় করে তোলে। বাবা-মার সততা, আদর্শ, নিষ্ঠতা, নীতি নৈতিকতায় যদি কোন সন্তান আলোকিত হতে পারে তাহলে তাকে কোন অন্ধকার জগত স্পর্শ করতেই পারবে না। এই বোধে বাবা-মা যেমন তার সন্তানকে বড় করবেন পাশাপাশি সন্তানকেও অনুভব করতে হবে মা-বাবার চাইতে বড় হিতাকাক্সক্ষী আর কেউ হতে পারে না। কখনও কোন বিষয়ে কিছু জানার থাকলে সেটাও বাবা-মার সঙ্গেই ভাগ করে নিতে হবে। আর কারও কাছে নয়। কোথাও নয়। সুতরাং বিশেষ করে মাকে আরও যতœবান হতে হবে, অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে সন্তান বড় করার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্তগুলোতে। মা-বাবার অসঙ্গত আচরণ সন্তানদের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে না। বাবা-মার কোন ব্যাপারে সন্তানরা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। সন্তানদের জন্য তাদের সময় যেন অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে । কোনভাবেই সন্তানকে বিপথগামী হতে দেয়া যাবে না।
×