ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিম্ন আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে এই দণ্ড, সেই সঙ্গে ২০ কোটি টাকা জরিমানা ;###;বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুনের ৭ বছরের কারাদণ্ড বহাল ;###;আইনী প্রক্রিয়া শেষে তারেককে লন্ডন থেকে দেশে ধরে আনা হবে- বললেন আইনমন্ত্রী

তারেকের ৭ বছর জেল ॥ অর্থ পাচার মামলায় হাইকোর্টের রায়

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২২ জুলাই ২০১৬

তারেকের ৭ বছর জেল ॥ অর্থ পাচার মামলায় হাইকোর্টের রায়

বিকাশ দত্ত ॥ অর্থ পাচারের মামলায় নিম্ন আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছর কারাদণ্ড প্রদান ও ২০ কোটি জরিমানা করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তারেকের বন্ধু ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদণ্ডও বহাল রাখা হয়েছে। তবে তাকে বিচারিক আদালতের দেয়া ৪০ কোটি টাকার অর্থদণ্ড কমিয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ পিনপতন নীরবতার মধ্যে আলোচিত এই রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতে তারেক রহমানের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আপীল ও দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে মামুনের করা আপীলের ওপর শুনানি শেষে ১৬ জুন একই বেঞ্চ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন। বুধবার প্রকাশিত হাইকোর্টের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় বৃহস্পতিবারের তারিখে ৪ নম্বরে মামলাটি রায়ের জন্য রাখা হয়। রায় ঘোষণার সময় সাংবাদিক, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনজীবীদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। রায়কে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্টে বাড়তি নিরাপত্তা নেয়া হয়। উল্লেখ্য, ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫০টি মুদ্রা পাচার মামলা দুদক পরিচালনা করে আসছে, যার মধ্যে এই প্রথম হাইকোর্টে কোন মামলার সাজার রায়। রায়ে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছে বিচারিক আদালতকে। পলাতক তারেক রহমান আত্মসমর্পণ করলে বা তাকে গ্রেফতার করা গেলে সেই সময় থেকে তার দণ্ড কার্যকর হবে বলে হাইকোর্ট জানিয়েছেন। অন্যদিকে অর্থ পাচারে সহায়তা করায় হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন ও নির্মাণ কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলাম, মেরিনা জামান ও মায়েট থাইরিসহ চারজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দেয় আদালত। হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ‘রাজনৈতিক ঢাল’ ব্যবহার করে ‘সচেতনভাবে’ আর্থিক অপরাধে জড়িয়েছিলেন। তিনি তার রাজনৈতিক উচ্চ শ্রেণীর অবস্থান ব্যবহার করে ‘কনসালটেশন ফির’ নামে তার সহযোগীর (গিয়াসউদ্দিন আল মামুন) মাধ্যমে ‘ডার্টি মানি’ অর্জন করেছেন। ‘রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে’ সংঘটিত এ ধরনের দুর্নীতি সুশাসন, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ‘হুমকি’। তারেক রহমান ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের এ ঘটনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থ পাচারের অন্যতম উদাহরণ। তাই সরকারকে নতুন করে এ ধরনের অর্থ পাচারের ঘটনা রোধে চিন্তা-ভাবনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশের অর্থ পাচারের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অর্থ পাচারসংক্রান্ত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আর এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধির ফলে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে রায়ের পর দুদকের আইনজীবী বলেছেন, ‘উনি আপীল করতে পারবেন, যদি সারেন্ডার করে জেলে যান। সেটা ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, ‘আমরা স্তম্ভিত, হতবাক। তারেক রহমান দেশের বাইরে থাকায় তিনি আপীল করবেন কিনা, সে সিদ্ধান্ত জানানো হবে পরে। গিয়াসউদ্দিন আল মামুন আপীল করবেন। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, মুদ্রা পাচার মামলায় বিচারককে ‘প্রভাবিত করে’ বিএনপি নেতা তারেক রহমান নিম্ন আদালতে খালাস পেয়েছিলেন। ‘লন্ডনে বসে আপীল হবে না। আমরা যদি উনাকে ধরে আনতে পারি অথবা তিনি যদি এসে আত্মসমর্পণ করেন, তাহলে আপীল করতে পারবেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) ধারা মতে, দ- হওয়ার পর তিনি আর কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তারেক যদি নির্বাচন করতে চান তা হলে তাকে খালাস হয়ে আসতে হবে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শুরু করেন, পৌনে ১১টার মধ্যে রায় শেষ করেন। ঘুষ হিসেবে আদায়ের পর ২০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে করা এ মামলার রায়ে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মোঃ মোতাহার হোসেন ২০১৩ সালের ১৭ নবেম্বর তারেককে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। আর গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে দেয়া হয়েছিল সাত বছর কারাদ- এবং ৪০ কোটি টাকা জরিমানা। ঐ রায় ঘোষণার পর ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মোঃ মোতাহার হোসেন মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টাসহ দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে কয়েক ডজন মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বড় ভাই সাবেক এমপি হাফিজ ইব্রাহিম বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য। জরুরী অবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে মামুন কারাগারেই আছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোও মুদ্রা পাচারের আরেকটি মামলায় দ-িত হয়েছিলেন। কারাদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত অবস্থায় গতবছর তার মৃত্যু হয়। রায়ে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছে বিচারিক আদালতকে। পলাতক তারেক রহমান আত্মসমর্পণ করলে বা তাকে গ্রেফতার করা গেলে সেই সময় থেকে তার দ-কার্যকর হবে বলে হাইকোর্ট জানিয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণ ॥ হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ‘রাজনৈতিক ঢাল’ ব্যবহার করে ‘সচেতনভাবে’ আর্থিক অপরাধে জড়িয়েছিলেন। ‘তিনি তার রাজনৈতিক উচ্চ শ্রেণীর অবস্থান ব্যবহার করে ‘কনসালটেশন ফির’ নামে তার সহযোগীর (গিয়াসউদ্দিন আল মামুন) মাধ্যমে ‘ডার্টি মানি’ অর্জন করেছেন।’ ‘রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে’ সংঘটিত এ ধরনের দুর্নীতি সুশাসন, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ‘হুমকি’। ‘দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এখন সময় এসেছে এ ধরনের রাজনৈতিক সহানুভূতি ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে হওয়া দুর্নীতি রুখে দেয়ার।’ তারেক রহমান ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের এ ঘটনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থ পাচারের অন্যতম উদাহরণ। তাই সরকারকে নতুন করে এ ধরনের অর্থ পাচারের ঘটনা রোধে চিন্তাভাবনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে।’ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশের অর্থ পাচারের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অর্থ পাচারসংক্রান্ত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আর এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধির ফলে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পন্থায় ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের হিসাবে পাচার করা হয়। যার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা তারেক খরচ করেন বলে এ মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়। অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জজ আদালতের রায়ে মামুনকে কারাদ- দেয়া হলেও তারেককে খালাস দিয়ে বলা হয়, ওই টাকা খরচ করার কথা তারেক রহমান অস্বীকার করেননি। ২০০৭ সালে দুদকে দাখিল করা তারেকের হিসাব বিবরণীতে তার উল্লেখ রয়েছে। তিনি যে মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন তা প্রমাণ হয়নি। ওই রায় বাতিল করে হাইকোর্ট বলেছে, ‘এটা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম।’ দুর্নীতির উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে এ ধরনের অর্থ পাচার টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা। ‘সময় এসেছে এসব অপরাধ বন্ধ করার।’ অর্থ যখন সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়, তখন তারেক রহমানের মা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ওই সময় তারেক নিয়ন্ত্রিত হাওয়া ভবন সরকার পরিচালনার ‘দ্বিতীয় কেন্দ্র’ হয়ে উঠেছিল এবং তখন হাওয়া ভবনের ইশারা ছাড়া কোন কাজ হতো না বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ। ধরে আনা হবে ॥ আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আইনী প্রক্রিয়া শেষে লন্ডন থেকে দেশে ধরে নিয়ে আসা হবে। তিনি বলেন, যেহেতু লন্ডনের সঙ্গে আমাদের বন্দীবিনিময় চুক্তি নেই, তাই তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে আনা হবে। পাশাপাশি লন্ডনের সঙ্গে তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও প্রচেষ্টা চালাবে সরকার। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের নিজ কক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এ্যান্টি মানি লন্ডারিং এ্যাক্ট মামলায় তারেক রহমানের সাত বছরের সাজার পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে চাইলে তিনি এ সব কথা বলেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, লন্ডনে বসে এ মামলায় আপীলের কোন সুযোগ নেই। আপীল করতে চাইলে তাকে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আত্মসমর্পণ করে আদালতের মাধ্যমে আপীল করার সুযোগ নিতে হবে নতুবা সরকার তাকে ধরে আনার পর সে আপীল করতে পারে। তিনি আরও বলেন, এতদিন এ মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকায় কোন কথা বলেনি। আজ (বৃহস্পতিবার) মামলার রায়ে সে দোষী প্রমাণিত হয়েছে। এর আগে এক বিচারক তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে এ মামলায় সাত বছরের কারাদ- দিলেও সেই বিচারক আদালতকে প্রভাবিত করে তারেক রহমানকে খালাস করিয়েছিলেন। খালাসের রায় ঘোষণার দুই দিন পর সেই বিচারক পরিবারসহ মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান। তিনি আর ফিরে আসেননি। সেই মামলার রায়ে স্পষ্ট বলা আছে মামুন স্বীকার করেছে একটি বিদেশী কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের কাছ থেকে কনসালটেনসি ফি-এর নামে তারা অর্থ ঘুষ হিসেবে নিয়েছিলেন এবং সেই টাকা বিদেশে রাখেন। সেই মামলায় তারেক রহমানকে আজ (বৃহস্পতিবার) সাত বছরের জেল ও ২০ কোটি টাকা জরিমানার সাজা দিয়েছে উচ্চ আদালত। তারেক রহমানের সাজা ঘোষণার পর পরবর্তী কাজ রায়ের সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করা। রায় কার্যকর করার জন্য দুদক কর্মকর্তারা দ্রুত সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠালে তাকে বিদেশ থেকে ধরে আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না ॥ সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, তাকে আপীল করতে হবে দেশে এসে আত্মসমর্পণ করে জেলে ঢুকে। নিম্ন আদালত প্রভাবিত হয়ে রায় দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট সঠিক রায় দিয়েছেন। এই দ- দেয়ার পর তার কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসে না। হাইকোর্ট সবকিছু বিচার বিশ্নেষণ করে সঠিক রায় দিয়েছেন। সংবিধানের ৬৬(২) (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে অন্যূন দুই বছরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর ৫ বছর কাল অতিবাহিত না হলে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তারেক রহমানকে অর্থ পাচার মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তিনি কোনভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। নির্বাচন করতে হলে তাকে খালাস হয়ে আসতে হবে। মামুন আপীল করবেন ॥ রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারেকের অন্যতম আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আমরা স্তম্ভিত, হতবাক।’ তিনি জানান, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন আপীল করবেন। আপীলে ‘পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার’ মিলবে বলে তারা আশা করছেন। অপর আইনজীবী জয়নাল আবেদীন বলেন, রায়ে আমরা খুশি হইনি। তারেক রহমান ন্যায়বিচার পাননি। উনি অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। রাষ্ট্র, দুদক তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। আসামিপক্ষের অপর কৌঁসুলি জালালউদ্দিন বলেছেন, তারেক রহমান দেশের বাইরে থাকায় তিনি আপীল করবেন কিনা, সে সিদ্ধান্ত জানানো হবে পরে। ‘আমরা আইন দেখব, তার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেব। কেউই আইনের উর্ধে নন ॥ রায়ের পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই রায়ে প্রমাণিত হলোÑ কেউ আইনের উর্ধে নয়। যে যত বড়ই হোক না কেন, আইন অমান্য করলে তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে।’ আদালত বলেছে, এখন সময় এসেছে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও অর্থ পাচার অঙ্গাঙ্গি দুটি ব্যাপার। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তারেক-মামুন যে অপরাধ করেছেন, তা ঘটানো হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫০টি মুদ্রাপাচার মামলা দুদক পরিচালনা করে আসছে, যার মধ্যে এই প্রথম হাইকোর্টে কোন মামলায় সাজার রায় হলো বলে জানান এই আইনজীবী। তিনি আরও বলেন, ‘সে পলাতক, আপীল করতে হলে আগে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আপীল করার জন্য ৩০ দিন সময় পাবেন।’ এটাই আইনের বিধান। আইনে পলাতক ব্যক্তির আপীলের সুযোগ নেই। তারেক রহমানকে আপীল করতে হলে তাকে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এরপর কারাগার থেকে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে পারবেন তারেক রহমান। বিতাড়িত করতেই দণ্ড ॥ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে হেয় করতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে এই দণ্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা মামলা দিয়ে তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। বৃহস্পতিবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণার পর তারেকের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, রাজনৈতিকভাবে হেয় করতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। একইসঙ্গে বৃহস্পতিবার ওই মামলায় তাকে দণ্ড দেয়া হয়েছে, যেন তাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করা যায়। কিন্তু মিথ্যা মামলা দিয়ে তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। তিনি বলেন, নিম্ন আদালতে এই মামলায় খালাস পেলেও হাইকোর্ট তারেক রহমানকে সাজা দিয়েছেন। আমরা আশা করি আপীলে ন্যায়বিচার পাব। যেভাবে মামলা শুরু ॥ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর দায়ের করা এ মামলায় তারেক-মামুনের বিচার শুরু হয় ২০১১ সালের ৬ জুলাই। মামলায় অভিযোগ করা হয়, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের কাজ নির্মাণ কনস্ট্রাকশনস নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন মামুন। ওই টাকা পরে সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের হিসাবে পাচার করা হয়, যার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেন তারেক। ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মোঃ মোতাহার হোসেন ২০১৩ সালের ১৭ নবেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করে তারেককে বেকসুর খালাস দেন। আর তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে দেয়া হয় সাত বছর কারাদ- এবং ৪০ কোটি টাকা জরিমানা। তারেকের রায়ের বিরুদ্ধে দুদক ওই বছর ৫ ডিসেম্বর আপীলের আবেদন করে। শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট দুদকের আপীল গ্রহণ করে আসামি তারেককে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়। পরে তাকে পলাতক দেখিয়েই আপীল শুনানি চলে। তারেকের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দুদক ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর আপীলের আবেদন করে। শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট দুদকের আপীল গ্রহণ করে আসামি তারেককে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়। লন্ডনপ্রবাসী তারেক না ফেরায় তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে তা তার লন্ডনের ঠিকানায় পাঠানো হয়। কিন্তু তাতেও খালেদা জিয়ার বড় ছেলের সাড়া মেলেনি। দুদকের করা ওই আপীলের সঙ্গে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে মামুনের করা আপীলও শুনানির জন্য তালিকায় আসে। এরপর হাইকোর্টে ৪ মে আপীলের ওপর শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় ১৬ জুন। মামলাটি দায়ের থেকে শুরু করে পুরো বিচার প্রক্রিয়ার সময় তারেক রহমান ‘পলাতক’ থাকায় তার পক্ষে কোন আইনজীবী ছিলেন না বলে খুরশীদ আলম খান জানান। শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলায় হুলিয়া জারির পর তারেকের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিসও জারি করা হয়েছিল। তবে পরে ইন্টারপোল তা সরিয়ে নেয়। অবশ্য তারেকের দল বিএনপির দাবি, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তারেকের বিরুদ্ধে মামলাটি ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’। বিচারিক আদালত ॥ জজ আদালতের রায়ে বলা হয়, ওই টাকা খরচ করার কথা তারেক রহমান অস্বীকার করেননি। ২০০৭ সালে দুদকে দাখিল করা তারেকের হিসাব বিবরণীতে তার উল্লেখ রয়ছে। কিন্তু তিনি যে মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন তা প্রমাণ হয়নি। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন- ২০০২ এর ২ (ঠ), (অ), (আ) ও ১৩ ধারায় ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোঃ মোতাহার হোসেন দুদকের দায়ের করা মামলার রায়টি দিয়েছিলেন। রায়ে বিচারক বলেন, মামলার প্রধান সাক্ষী নির্মাণ কন্সট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদিজা ইসলাম মামুনকে দেয়া টাকা কনসালটেন্সি ফি হিসেবে দিয়েছেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন, মামুনও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে ওই টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু ওই পরিমাণ টাকা ফি হিসাবে নেয়ার মতো কনসালটেন্সি ফার্ম মামুনের ছিল না। ওই টাকা অনৈতিকভাবে চাপ দিয়ে নেয়া হয়েছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জনকণ্ঠকে বলেছেন মানিলন্ডারিং মামলায় রায় ঘোষণার পর বিচারক দেশ থেকে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি এ আপীল শুনানির জন্য গ্রহণ করে তারেক রহমানকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন বিচারপতি নিজামুল হক ও বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ। নিরাপত্তা জোরদার ॥ তারেক রহমান ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের মুদ্রা পাচার রায়কে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্টের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সুপ্রীমকোর্টের ৪টি প্রবেশ পথে পুলিশের পাশাপাশি ডিবি পুলিশ অবস্থান নেয়। কাউকে সন্দেহ হলেই তাকে তল্লাশি করা হয়েছে। কোর্টে এজলাসে প্রবেশের সময়ও তল্লাশি করা হয়। উল্লেখ্য, দেশে সন্ত্রাসী হামলার পর আদালত প্রাঙ্গনে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
×