ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

‘রিস্ট্রাকচার্ড লোন’ ব্যবস্থা কতটুকু কাজে লাগবে?

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২২ জুলাই ২০১৬

‘রিস্ট্রাকচার্ড লোন’ ব্যবস্থা কতটুকু কাজে লাগবে?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (বাংলাদেশ ব্যাংক) হাতে আগুন লাগে লাগে অবস্থা। অবশ্য পুনর্তফসিলকৃত অথবা পুনর্গঠনকৃত (রিস্ট্রাকচার্ড) ঋণের আগুন প্রথমে লাগবে তফসিলী ব্যাংকগুলোতে। পরে সেই আগুনে দগ্ধ হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। কারণ পুনর্তফসিলই বলি আর পুনর্গঠিত ঋণই বলি সবই শেষ বিচারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোঝা হিসাবে চিহ্নিত হবে। শত হোক কোন্্টা পুনর্তফসিলকৃত ঋণ (রিসিডিউলড লোন) আর কোন্্টা পুনর্গঠিত ঋণ (রিস্ট্রাকচার্ড লোন) তার সংজ্ঞা তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুনর্তফসিলকরণের নিয়মাবলী অনেকটা অঙ্কের মতো। ফর্মুলা দেয়া আছে। সেই মোতাবেক ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণগুলোকে শ্রেণীবিন্যাসিত করতে হয়। আবার বিধিমোতাবেক পুনর্তফসিল করতে হয় যদি ঋণ গ্রাহক তার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারে। কোন্ ঋণের টাকা কখন কীভাবে পরিশোধ করতে হবে কত দিনের মধ্যে তার একটা শর্ত করা থাকে। সেই মোতাবেক গ্রাহককে ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত দিতে হয়। না পারলেই পুনর্তফসিলের (রিসিডিউলিং) কথা ওঠে। আবার পুনর্তফসিলে না কুলালে পুনর্গঠন করতে হয় ঋণ। এটা আগে ছিল না। আগে পুনর্তফসিল করা যেত যতবার ইচ্ছা। দশবার-পনেরোবারও পুনর্তফসিল হয়েছে ঋণ। এই নীতির অপব্যবহারও হয়েছে। ব্যাংক ও গ্রাহক দুজন মিলে একটা ভাল ব্যবস্থাকে কীভাবে নষ্ট করেছে তার অনেক উদাহরণ আছে। একটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে পুনর্তফসিল নীতি। এই অপব্যবহার রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ করে নিয়ম করে তিনবারের বেশি পুনর্তফসিল করা যাবে না ঋণ। এখানেই বেধেছে গোল। ‘লুজ’ ব্যবস্থাকে ‘টাইট’ দিতে গিয়ে এমন অবস্থা হয় যে, শেষ পর্যন্ত নতুন পন্থা আবিষ্কার করতে হয় গ্রাহককে ‘বাঁচানোর’ জন্য। সেই ব্যবস্থাটির নাম ‘রিস্ট্রাকচারিং অব লোন’। এর অধীনে ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করার ব্যবস্থা হয়। ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ নামমাত্র করা হয়। ঋণ পরিশোধের সময়সীমা দীর্ঘায়িত করা হয়। পরিশোধের ওপর ‘মরেটরিয়াম’ দেয়া হয়। আরও কত কী? তাও আবার এই সুবিধা সবার জন্য নয়। যাদের ঋণের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা ও তার উপর তাদের জন্যই এই সুবিধা দেয়া হয়। কে দেয় এই সুবিধা? কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফল কী? ফল মনে হচ্ছে অম্ল মধুর। কাগজে দেখলাম একটি ব্যাংকের খবর। সেই ব্যাংকের বড় বড় গ্রাহকরা ‘রিস্ট্রাকচার’ সুবিধা নেয়ার পর যখন ঋণ পরিশোধের সময় হয়েছে, তখন তারা আর টাকা ফেরত দিতে পারছে না। যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় অধিকাংশ বড় গ্রাহকই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে। এটা এক বড় বিপদের সঙ্কেত। আমি এর আগে এই কলামেই উল্লেখ করেছিলাম আমাদের দেশের বড় বড় গ্রাহক ‘রিস্ট্রাকচার’-এর সুবিধা নিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু মনে হয় তারা এর পরেও ব্যাংকের টাকা নতুন শর্ত মোতাবেক পরিশোধ করতে পারবেন না। আমি খুব খুশি হতাম যদি তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারতেন। কিন্তু আলামত দেখে মনে হয় তারা তা করতে পারবেন না অথবা করবেন না অথবা করার কোন ক্ষমতা তাদের নেই। এর কারণ কী? প্রথম কারণ আমাদের ‘কর্পোরেট সেক্টর’ যত প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতা যেমন কাজ করেছে তেমনি ‘টার্গেট’ অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করার তাগিদও কাজ করেছে, যাতে ব্যাংকের মুনাফা বাড়ানো যায়। এছাড়া আমাদের কর্পোরেট সেক্টর অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যাংক ঋণ নির্ভরশীল। তারা শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে উৎসাহী নয়। তারা মুনাফা ভাগাভাগি করতে উৎসাহী নয়। চীন ও ভারতের মতো আমাদের উন্নয়ন ব্যাংক ঋণ নির্ভর হওয়ায় তাদের সুবিধা হয়েছে আরও বেশি। তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ব্যাংক ঋণকে করে ফেলেছেন অতি সুলভ ও সস্তা। এমতাবস্থায় আমাদের কর্পোরেট সেক্টর তাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে। বর্তমান সরকারের প্রথম এক-দুই-তিন বছর ঋণ প্রবাহ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। তার ফল ছিল মাত্রাতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি। সুলভে ঋণ পেয়ে অনেকেই ঋণের টাকা ‘ডাইভার্ট’ করেছে শেয়ারবাজারে। ফলে শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন দেখা দেয় এবং এই সুযোগে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেন। অবস্থা এমন হয় যে, কোম্পানিতে মালিকদের শেয়ার বলতে কিছু থাকেনি। সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়া হয়। সেই টাকা মালিকরা কী করেছেন তার হিসাব আজও কেউ নেয়নি। একটা হিসাব পাওয়া যায়। অনেক কর্পোরেট মালিক সারাদেশে বহু জমি কিনেছেন। বলাবাহুল্য, এর মধ্যে ব্যাংকের ঋণের টাকা যেমন আছে তেমনি আছে শেয়ারবাজার থেকে তোলা টাকা। এখন অবস্থা হয়েছে এমন যে, সেই জমির দাম আর নেই। ক্রেতা নেই। বিক্রি করলে লোকসান। কিন্তু তারা জমি ধরে রেখেছেন। ফল হচ্ছে এখন তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। এদিকে ব্যবসা তারা এমনভাবে বাড়াতে পারেননি তার দ্বারা যথেষ্ট ‘ক্যাশ’ জেনারেট করতে পারেন। ৫০০ কোটি ঋণ নিলে দশ শতাংশ হারে সুদ গুনলে সুদের পরিমাণ হয় ৫০ কোটি টাকা। তার ওপর আছে প্রিন্সিপালের টাকা। এই হিসাবে প্রতি মাসে একজন ৫০০ কোটি টাকা ঋণী ব্যবসায়ীকে ছয়-সাত কোটি টাকা ব্যাংককে পরিশোধ করতে হয়। বড়ই কঠিন ব্যাপার যদি না এই মুহূর্তের চিনির ব্যবসা হয়। ত্রিশ টাকার চিনি ৭০-৮০ টাকা এখন বিক্রি হচ্ছে। এই ব্যবসা সকল ক্ষেত্রে সব সময় হবে না। ফলে দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট ক্যাশের অভাবে ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা শর্ত মোতাবেক দিতে অপারগ হচ্ছেন। আরেকটা ঘটনা আছে। আর সেটা হচ্ছে বিদেশে টাকা পাচার। আমার ধারণা বহু ব্যবসায়ী/শিল্পপতি ব্যাংকের টাকার একটা অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে হিসাবে তারা আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের আশ্রয় নিয়েছেন। এই বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। বড় বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করলেই বোঝা যায় কার কত সম্পদ অথবা বিনিয়োগ কোথায় আছে। এর জন্য বড় ধরনের ইনভেস্টিগেশন দরকার হয় না। কানাডার বেগম নগরে কার বাড়িঘর- বিনিয়োগ আছে তার খরব যে কোন বাংলাদেশী-কানাডিয়ান জানে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং, চীনে কাদের বিনিয়োগ আছে তাও জানা। জুলাই মাসের ১৩ তারিখে একটি কাগজে একটি বড় হাউসের খবর ছাপা হয়েছে। তারা কত টাকার সম্পদ সিঙ্গাপুরে করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এই খবরের কোন প্রতিবাদ কোন কাগজে আমি পাইনি। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান কোন্ কোন্ বাংলাদেশীর বিদেশে টাকা আছে এই মর্মে তথ্য খোঁজে তাদের জন্য এটি একটি মোক্ষম খবর। আমি নিশ্চিত এই বিনিয়োগের মধ্যে ব্যাংকঋণের টাকাও আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার, জমি, বিদেশে বিনিয়োগ এই তিন ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের অনেক টাকা আছে। এমতাবস্থায় রিস্ট্রাকচার্ড লোনই হোক, পুনর্তফসিলকৃত ঋণই হোক তা আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফল কী? ফল হচ্ছে, আমার আশঙ্কা আগামী দিনে ব্যাংকগুলোকে এর জন্য কাফ্ফারা দিতে হবে। এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তুতি রাখা ভাল। যে ধকল বা ধস আসছে তা সামলানোর কী ব্যবস্থা দরকার হবে তার অগ্রিম চিন্তা দরকার। গবর্নর ফজলে কবীর নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সুবিধা কয়েকটা। তিনি অর্থ সচিব ছিলেন, ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন, ব্যাংকের বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ অডিট কমিটির সদস্যও ছিলেন। তার ওপর ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই পরিচালক। এত গুরুত্বপূর্ণ পদের অভিজ্ঞতা নিয়ে এর আগে কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর হয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। এমতাবস্থায় তাকে বলব অগ্রিম ভাবতে। ‘রিস্ট্রাকচার্ড লোন’ ব্যবস্থা মনে হচ্ছে খুব বেশি কাজে লাগবে না। অতএব করণীয় কী? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×