ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২২ জুলাই ২০১৬

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

(বৃহস্পতিবারের সম্পাদকীয় পাতার পর) সেই ১৯৬৯ সালেই আমরা বুঝতে পারি সিরাজ শিকদার একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহসী বিপ্লবী হলেও তিনি ছিলেন একজন আত্মকেন্দ্রিক ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তি। গণতান্ত্রিকতা ও যৌথ নেতৃত্বের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল নন। সে সময়ে হাস্যকর এই যুক্তি তিনি হাজির করেন যে, তাহের যেহেতু একজন পেটিবুর্জোয়া সামরিক অফিসার, তাই তার কাছ থেকে কোন সামরিক শিক্ষা নেয়া যায় না। তাঁর এই ভ্রান্ত মতের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। ১৯৬৯ সালেই সিরাজ শিকদারের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতি ঘটে আমাদের। পুনরায় লেখাপড়ায় ফিরে আসি আমি। এক পর্যায়ে আমার সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ওই অংশটির সঙ্গে যারা সেই ১৯৬২ সাল থেকে আমাদের পরিবারের মতো স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথা তারা ভাবছেন। ১৯৭১। তাহের তখন পশ্চিম পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলছে তখন দেশে। ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগের আমার বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছি সূর্যসেন স্কোয়াড। গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা ইতোমধ্যেই বন্ধুরা জেনে গেছে। জেনেছে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সম্পর্কের শুরু এবং তা ছিন্ন হওয়ার কথাও। সূর্যসেন স্কোয়াড নামটি আমার দেয়া। তবে আমাকে এ স্কোয়াডের অধিনায়ক মনোনীত করে ছাত্রলীগের বন্ধুরা। সে কঠিন সময়ে এদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক ঐক্য ও বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তারই পথ বেয়ে স্বাধীনতার পর আবারও তাদের সঙ্গে গড়ে উঠল যোগাযোগ। মাঝখানে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে ২৭ মার্চের সকাল পর্যন্ত সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের। ফজলুল হক হলে আমি ও আমার স্কোয়াডের কয়েক সদস্য অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাত থেকে। ২৭ মার্চ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা এই দুই ঘণ্টার জন্য যখন কার্ফু শিথিল করা হয়, তখন আমরা নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা করি। তার পূর্বে প্রতিজ্ঞা করি, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করব। আমাদের পরিবারের বড় বড় দুর্ভাগ্যের একটি হলো, ১৯৭১-এর যুগসন্ধিক্ষণে তাহের ছিলেন সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে। আজ দ্বিধাহীনচিত্তে এ কথা বলতে পারি, সে সময় যদি তাহের এ দেশে থাকতেন, তাহলে একদিকে যেমন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রবক্তা ‘নিউক্লিয়াসের’ সঙ্গে তার সংযোগ ঘটে যেত আমার মাধ্যমে। অন্যদিকে এই বিপ্লবী ধারার পেছনের মানুষটি যার আহ্বানে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার মন্ত্রে জেগে উঠেছিল, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাহেরের সংযোগ হতো আবশ্যিকভাবেই। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানী আক্রমণের পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালী জাতি। কিন্তু তার গ্রেফতার এবং সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টি অন্তরীণ থাকার ফলে জাতি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল অর্থাৎ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। যে কর্নেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু তাঁর সামরিক পরামর্শদাতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন (স্মরণযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনী মোশতাকের ডিফেন্স এ্যাডভাইজার হয়েছিলেন এই ব্যক্তিটি), বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া অরাজনৈতিক ও প্রচলিত সেনাবাহিনীর ধ্যান-ধারণার অফিসারগণ মুক্তিযুদ্ধের নীতি-কৌশল প্রণয়নে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সে সময় তাহের বাংলাদেশে থাকলে ভ্রান্ত সমরনীতির কারণে ভবিষ্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে অপূরণীয় ক্ষতিটি হয়েছিল, তা হয়ত হতো না। ১৯৭১ সালের ২০ জুলাই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আগস্ট মাসে তাহের যখন ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন ইতোমধ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে নিয়মিত বাহিনীর ব্রিগেডের আদলে জিয়াউর রহমানের নামে ‘জেড ফোর্স’, খালেদ মোশাররফের নামে ‘কে ফোর্স’ এবং শফিউল্লার নামে ‘এস ফোর্স’। বাংলাদেশের মাটিতে নয়, ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে গড়ে তোলা জনগণ-বিচ্ছিন্ন এই তিনটি ব্রিগেড নিয়েই পরবর্তীতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়। সেই ষাটের দশক থেকে এ দেশকে স্বাধীন করার জন্য তাহেরের সঠিক চিন্তা– জনযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণের বাহিনী গড়ে তোলা, যা হবে স্বাধীন দেশের জনগণের সেনাবাহিনীর ভিত্তি– তা কর্নেল ওসমানী ও উল্লিখিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচলিত ভাবনার সেনানায়করা গ্রহণ করতে পারেননি। একমাত্র তাহের সচেতনভাবে তাঁর সেক্টরে নিম্নবিত্ত কৃষক ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। নবেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ১৭ হাজার গেরিলা বাহিনীর একাংশকে (যাদের অধিকাংশ ছিল কৃষক) নিয়মিত বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ব্রিগেড গঠনের অনুমতি চাইলেও তাহেরের আবেদন কর্নেল ওসমানী ও মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সে সময় থেকেই তাহের স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত কতটা সঙ্কটাপূর্ণ হয়ে গেছে। আমাদের পরিবারের আরও একটি দুর্ভাগ্য আছে। তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে ১৪ নবেম্বর তারিখে ঢাকার প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত কামালপুর শত্রুঘাঁটি দখলের সম্মুখযুদ্ধে মারাত্মকভাবে তাহেরের আহত হওয়া এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে চিকিৎসাধীন থাকা। মুক্তিযুদ্ধে আমি ১১ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে অধিনায়ক তাহেরের একজন স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সেই সূত্রে তাহেরের যুদ্ধ পরিকল্পনা জানবার বিরল সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তাহের জানতেন, ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রলম্বিত হতে দেবে না। একটি স্বল্পস্থায়ী নির্ধারক যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অতিদ্রুত স্বাধীন করতে চাইবে তারা। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ময়মনসিংহ ও রংপুরের একাংশ নিয়ে বিস্তৃত ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব তাহের এ কারণে গ্রহণ করেছিলেন যে, এই সীমান্তের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য কামালপুর শত্রুঘাঁটির পতনের পর শেরপুর-জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করা যাবে দ্রুততম সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভারতীয় পরিকল্পনার কথা তাহের জানতেন বলে তিনি ঠিক করেছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দলগুলোকে রাজধানী ঢাকার দিকে আগেভাগে পাঠিয়ে দেয়ার। অন্যদিকে যোগাযোগ রাখছিলেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা যুদ্ধ নেতাদের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে ছিলেন রংপুরের রৌমারী মুক্তাঞ্চলের সুবেদার আফতাব, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী এবং ভালুকার মেজর আফসার। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন ভারতীয় মিত্র বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করার আগেই ১১ নম্বর সেক্টর ও উল্লিখিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবেন। আহত হয়ে গৌহাটি, লক্ষনৌ এবং পুনা সামরিক হাসপাতালে তাহেরের সাহায্যকারী হিসেবে আমাকে সেক্টর থেকে পাঠানো হয়েছিল। সে সময়ে যুদ্ধের ডামাডোলের বাইরে তার কাছ থেকে সেসব পরিকল্পনা শুনবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্সে জেনারেল নিয়াজী যখন মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করছেন, তখন পুনা হাসপাতালে শয্যাশায়ী তাহের আক্ষেপ করে বলছেন, তিনি আহত না হলে পরাজিত পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হতো যৌথ বাহিনীর কাছে নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তার নিজস্ব বাহিনী এবং ঢাকার চারপাশ থেকে ও বিভিন্ন সেক্টর থেকে আগুয়ান মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ঢাকায় সেই অবস্থার সৃষ্টি করতে পারতেন, যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া পরাজিত পাকিস্তান ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় কোন্ পথ খোলা থাকত না। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে নকল পা লাগিয়ে তাহের বাংলাদেশে ফিরে এলে কর্নেল ওসমানী তাঁকে নিয়োগ দেন এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে। ওসমানীর ইচ্ছা ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে থেকে পুরো নয় মাস আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এমন একজন সিনিয়র অফিসার কর্নেল মাসুদকে এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল করে তার অধীনে ডেপুটি হিসেবে তাহেরকে দায়িত্ব দেয়া। তাহের তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বাধ্য হয়ে ওসমানীকে তার মত পরিবর্তন করতে হয়েছিল এবং তাহের হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল। কিন্তু ইতোমধ্যেই স্বাধীন দেশে নতুন সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে গুরুতর ভুলগুলো হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভুলের কথা আগেই বলেছি। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশে এমন সেনাবাহিনীর গোড়াপত্তন করা হলো, যা অবিকল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি বাংলাদেশ কপি মাত্র। এ সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার বেসামরিক গেরিলাদের নেয়া হলো না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার বাহিনীর যারা সহযোগিতা করেছে, সে সব বাঙালী সামরিক অফিসারকে নেয়া হলো। তাহেরের ভাষায় যাদের স্থান হওয়ার কথা ছিল শ্রম শিবিরে বা কারাগারে। স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করার তাহেরের স্বপ্ন এবং লাখো কোটি মানুষের স্বপ্ন এভাবেই একেবারে গোড়া থেকে দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে শুরু করে। এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে থাকাকালেই আমার মাধ্যমে তাহের জানতে শুরু করেন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ধারাটির কথা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাহের প্রথমে একটি বেলুচ ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন এবং পরে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ হিসেবে পরিচিত দুর্ধর্ষ কমান্ডো বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তিনি চেয়েছিলেন সক্রিয় অধিনায়কত্ব। সে সুযোগটিও তিনি পেয়েছিলেন। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত ৪৪তম ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব দেয়া হয় তাহেরকে। অন্যদিকে ঢাকায় অবস্থিত ৪৬তম ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক হয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে তাহেরের সঙ্গে পালিয়ে আসা তাঁর বিপ্লবী চিন্তার অনুসারী কর্নেল জিয়াউদ্দিন। কুমিল্লাতে সক্রিয় অধিনায়কত্ব গ্রহণের পূর্বে এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হয় তাহেরকে। আসামির কাঠগড়ায় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এমএ জলিল। কথিত আছে, বাংলাদেশ থেকে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী বাহিনীর ভারি অস্ত্রশস্ত্র ভারতে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মেজর জলিল। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়েছিল ওই সব ব্যক্তিকে, যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কারাগারেও ছিল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে তাহের মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর তারিখে যখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠা হলো, তখন সে দলের সভাপতি হয়েছিলেন মেজর এমএ জলিল। কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার থাকাকালে তাহের তাঁর অধীনস্থ ৪৪তম ব্রিগেডের অফিসার ও সিপাহীদের নিয়োজিত করেছিলেন নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার নানা উদ্যোগে। এ সময়ের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে অবস্থানকালে তাহের এবং ঢাকার ৪৬তম ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সম্মিলিত চেষ্টায় একটি সামরিক অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করে দেয়া। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে তাহেরকে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে ডিরেক্টর ডিফেন্স পার্চেজ পদে নিয়োগ দেন। তাহের স্পষ্ট বুঝেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আদলে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে, তা থেকে কি ভয়াবহ বিপদ ধেয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারকদের প্রতি। সক্রিয় অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে তাহের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধুর কাছে লেখা তাঁর ঐতিহাসিক পদত্যাগপত্রে তাহের তাঁর সব শঙ্কার কথা লেখেন। আজ ভাবতে অবাক লাগে, কি নির্মম সত্য উচ্চারণ করেছিলেন তাহের সেদিন। ৪৪তম এবং ৪৬তম এই দুটি ব্রিগেডের দুজন প্রগতিশীল সেনানায়ক যথাক্রমে, কর্নেল তাহের ও কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে সেনাবাহিনী ছেড়ে যেতে হলো। অন্যদিকে তাহেরের পদত্যাগপত্রে উল্লিখিত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের রেখে দেয়া হলো সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে। স্মরণ করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যখন সেনাবাহিনীর ভেতরে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করছে, তখন এসব অফিসার যথাক্রমে চীফ অব স্টাফ শফিউল্লাহ, ডেপুটি চীফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান এবং চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ, যারা সেই মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের নামে তিনটি ব্রিগেড গড়ে তুলেছিলেন, তাদের কেউ সেদিন জাতির জনককে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। শুধু তাই নয়, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী ও ইতোপূর্বে অজানা ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র বিষয়ে এরা কম-বেশি জানতেন। কিন্তু তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার কোন উদ্যোগ তারা নেননি। সেনাবাহিনীতে স্বল্পকালীন সময়ে অবস্থানকালে তাহের এ ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের কোন ষড়যন্ত্র করার ইচ্ছা থাকলে তাহের কিংবা জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনীতে তাঁদের উচ্চপদ থেকে কখনই পদত্যাগ করতেন না। এঁরা উভয়ে সেনাবাহিনী ছেড়ে বিপ্লবী রাজনীতিতে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন। জিয়াউদ্দিন যুক্ত হয়েছিলেন সিরাজ শিকদারের সর্বহারা দলের সঙ্গে এবং তাহের জাসদের সঙ্গে। জাসদে যোগদানের পূর্বেই তাহের বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ব্যাপক মতবিনিময় করেছিলেন। এ সব বৈঠকে আমি নিজেও অংশ নিয়েছি। তাহের যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন জনাব বদরুদ্দিন উমর, কমরেড তোয়াহা, মনজুরুল আহসান খান, আবুল বাশার, সিরাজুল হোসেন খান, দেবেন শিকদার ছাড়াও অন্যান্য বামপন্থী নেতৃবৃন্দ। পূর্বে উল্লেখ করেছি আমার মাধ্যমে তাহের জেনেছিলেন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিপ্লবী ধারাটি সম্পর্কে যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। এ ধারাটি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটিকে প্রবলভাবে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। স্বায়ত্তশাসন বা পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন দাবির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধকালে এরাই গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) যা মুজিব বাহিনী নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছিল। বাম বিপ্লবী রাজনীতির ধারকদের সঙ্গে তাহেরের মতবিনিময়কালে আমি জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে এসেছিলাম তাঁর কাছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ‘ফরিদপুর হাউজ’ নামে পরিচিত বাড়ির একটি ফ্ল্যাট যেখানে আমার মেজভাই আবু ইউসুফ বীরবিক্রম থাকতেন, সেখানে অনুষ্ঠিত হয় সে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সমাজ বদলের লড়াইয়ের রূপরেখা প্রশ্নে সাধারণ মতৈক্যে পৌঁছালেন তারা। আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য পরে আরও বহু বৈঠক হয়েছে। ড. আখলাকুর রহমান, মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু, কামরুজ্জামান টুকু ও এবিএম শাহজাহানসহ সে সময়ের তরুণ বিপ্লবীরা এসেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁরা আলোচনা করেছেন বিপ্লবের নীতি ও কৌশল নিয়ে। তাহের আমাকে বলতেন, তার মনে হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে তাঁর সহযোগীদের তিনি পেয়ে গেছেন। রাজনৈতিক বিতর্কের ধারায় সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থার রূপটির কথা তাহের জানলেন এবং তাঁর ভিত্তিতে বিপ্লবের স্তর কি হবে তা জ্ঞাত হলেন। তাঁর কাছে মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য থেকে উঠে আসা এই দারুণ প্রতিবাদি তরুণ বিপ্লবী শক্তি সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবচেয়ে যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত কথা বলছেন। চলবে...
×