ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রয়োজনে ট্রেড লাইসেন্স ও হোটেল ব্যবসার অনুমোদন বাতিল ॥ ৬৪ ডিসিকে চিঠি

সারাদেশে ১৩ হাজার অবৈধ প্রতিষ্ঠানকে সরানোর নোটিস

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২১ জুলাই ২০১৬

সারাদেশে ১৩ হাজার অবৈধ প্রতিষ্ঠানকে সরানোর নোটিস

মশিউর রহমান খান ॥ সারাদেশের শহর এলাকার আবাসিক প্লট ও ভবনে থাকা ১২ হাজার ৯শ’ ৫৭ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে নোটিস দিয়েছে সরকার। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থ্রি স্টার, ফোর স্টার ও ফাইভ স্টার মানের সকল হোটেলকে নোটিস পাঠিয়েছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কোন আবাসিক এলাকায় এসব হোটেল গড়ে তোলা হয়েছে কি না তা জানাতে দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসক ও সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছে বিমান মন্ত্রণালয়। এর উত্তরের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনে এসব হোটেলের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে হোটেল ব্যবসার অনুমোদনও বাতিল করা হবে বলে জানা গেছে। নোটিস দেয়া এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নোটিসের জবাব পর্যালোচনা করে সেসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা হবে কি না সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। সেই সঙ্গে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করার এবং সারাদেশের সকল আবাসিক এলাকায় এলাকায় নতুন করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ট্রেড লাইসেন্স না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বুধবার সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেক এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় বারের লাইসেন্স বাতিল করে সেগুলো অপসারণ করতে হবে। নতুন করে কোন বারের লাইসেন্স দেয়া যাবে না। সব গেস্ট হাউস ও আবাসিক হোটেল বন্ধ করতে হবে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। ওই কমিটিই এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। নোটিস দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) আবাসিক এলাকায় থাকা তিন হাজার ১৫, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এক হাজার ১শ’ ৩৭টি এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) দুই হাজার ৪০০ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে নোটিস করেছে। এর মধ্যে রাজউক এসব প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে নিতে নোটিস প্রদান ছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দৈনিক পত্রিকায় কয়েকদিন যাবত গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে। অপরদিকে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ তাদের আবাসিক এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স না নিয়ে বা লাইসেন্স নিয়ে ঠিকানায় দেয়া বাণিজ্যিক এলাকা ছেড়ে গিয়ে আবাসিক এলাকায় স্থাপিত অবৈধভাবে গড়ে তোলা বাণিজ্যিক স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানকে নোটিস প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নিতে নোটিস করেছে। অন্যথায় কর্তৃপক্ষ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেবাদানকারী সংস্থাটি। নোটিসপ্রাপ্তদের মধ্যে রাজধানীর বাইরে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকার ২৬ প্রতিষ্ঠান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৩শ’ ৭৬, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ৪০টি প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১৫০, বরিশাল ৫৮, সিলেট ২৬ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন পাঁচটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া রাজশাহী সিটি করপোরেশনের আবাসিক প্লট ও ভবনে থাকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিস পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। অপরদিকে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) পাঁচ হাজার ৫শ’ ৩৪ প্রতিষ্ঠানকে নোটিস প্রদান করেছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ১শ’ ১২ প্রতিষ্ঠানকে এবং ফায়ার সার্ভিস ১৩ প্রতিষ্ঠানকে নোটিস করেছে। এর বাইরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা ৫১ বার, ক্লাব ও রেস্তরাঁকে নোটিস দিয়েছে। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ৩৪টি তিন, চার ও পাঁচ তারকা হোটেল কোন আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে কি না তা জানতে সকল জেলা প্রশাসক ও সিটি কর্পোরেশনকে মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে। এসব চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছে কোন আবাসিক এলাকায় এসব হোটেল গড়ে তোলা হয়েছে কি না। যদিও দেশের প্রায় সকল তারকাসম্পন্ন হোটেল বাণিজ্যিক এলাকায়ই গড়ে তোলা হয়েছে। এর বাইরেও কোন হোটেল আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হলে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে মন্ত্রণালয়কে জানাতে অনুরোধ করে চিঠি দেয়া হয়েছে। এরপর মন্ত্রণালয় প্রয়োজনে এসব তারকা মানের হোটেলের ব্যবসার অনুমোদন বাতিল করবে। মূলত দেশের যে কোন প্রান্তে কোন আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা না রাখার সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তের কারণেই বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বুধবার সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেকের সভাপতিত্বে সারাদেশের নগর এলাকার রাস্তার পাশে আবাসিক প্লট ও ভবনে রেস্তোরাঁ-বারসহ নানাবিধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা জনিত সমস্যা নিরসনে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিষয়ক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্থানীয় সরকার সচিব মালেক বলেন, শুধু গুলশান নয়, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের সব বিষয়ই আমরা এ্যাড্রেস করব। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অপরিহার্য ও কর্তব্য। উল্লেখ্য, শহর এলাকায় আবাসিক প্লট ও ভবন থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরাতে গত ৪ এপ্রিল ছয় মাস সময় বেঁধে দেয় মন্ত্রিসভা। এই সময়ে বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো না সরালে সেগুলো উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় সচিব বলেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ছয় মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চাই। তবে এখনই ভাংচুর শুরু করতে চাই না। নোটিসের জবাবে তারা কী বলছেন তা শুনতে হবে, শুনানির প্রয়োজন আছে কি না তাও দেখতে হবে। এরপর তিনি আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করার অনুরোধ জানান। আবাসিক এলাকায় স্থাপিত তারকা মান সম্পন্ন হোটেল সম্পর্কে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের (সহকারী নিয়ন্ত্রক) উপসচিব শামীম হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দেশের কোথাও কোন আবাসিক এলাকায় কোন প্রকার তারকা মানসম্পন্ন হোটেল রাখব না। সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বিষয়ে নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যেই দেশের সকল জেলা প্রশাসককে ৩৪ থ্রি, ফোর ও ফাইভ স্টার মানের হোটেলের অবস্থান জানাতে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর বাইরে সকল সিটি কর্পোরেশনকেও এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে রাজধানীর কোন তারকা মানের হোটেলের আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হলে সিটি কর্পোরেশনের দেয়া ট্রেড লাইসেন্স সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাতিল করলে আমরাও তাদের হোটেল ব্যবসার অনুমতি বাতিল করব। তবে উচ্ছেদ বা অপসারণের ব্যাপারে রাজউকের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মূলক আবাসিক এলাকাকে বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ করতেই এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা স্থাপনা সরাতে নোটিস প্রদান করা শুরু করেছে। এর বাইরে পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দেয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, এসব স্থাপনা না সরালে আগামী সপ্তাহের শুরু থেকেই গুলশান বনানী বারিধারার প্রাথমিকভাবে তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবে। কোনক্রমেই এসব স্থাপনা রাখতে দেয়া হবে না বলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ঘোষণা দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, রাজউক ও রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন সমন্বয়ের মাধ্যমেই এ উচ্ছেদ অভিযান বাস্তবায়ন করবেন। তবে রাজউকের অবৈধ স্থাপনার তালিকা আরও বাড়বে। প্রাথমিকভাবে তৈরি তালিকার অনুমোদনবিহীন ও আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। যেসব স্থাপনার সাথে অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গ জড়িত। তবে সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজউক এবার প্রথমবারের মতো স্থায়ীভাবে এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান অপসারণের মাধ্যমে উচ্ছেদ কাজ শুরু করবে। এ বিষয়ে রাজউকের মহাখালী জোনের পরিচালক উপসচিব ওলিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে তোলা তালিকাকৃত স্থাপনা সরাতে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। এসব উদ্যোগের অংশ হিসেবে আগামী সপ্তাহের যে কোন সময় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করব। গণপূর্তমন্ত্রী এসব স্থাপনা সরাতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমাদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে এসব স্থাপনা অবৈধ ব্যবসায়ীদের আবাসিক এলাকা থেকে সরাতেই হবে। তবে প্রাথমিকভাবে তালিকা করা হলেও অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা আরও বাড়বে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা উপসচিব গোলাম মোস্তফা জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে যত্রতত্র বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোন প্রকার ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত নেয়নি। অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব প্রতিষ্ঠান আমরা বন্ধ করে দিতে বদ্ধ পরিকর। ইতোমধ্যেই শুধুমাত্র ধানম-ি আবাসিক এলাকার এক হাজার ১শ’ ৩৭ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে এসব প্রতিষ্ঠান আবাসিক এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে নোটিস প্রদান করা হয়েছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেয়া না হলে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোরতার সাথে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
×