ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ‘কোড ডি কোডে’ গোয়েন্দা ব্যর্থতা

সাঙ্কেতিক ভাষা বুঝতে না পারায় জঙ্গী হামলা রোখা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২১ জুলাই ২০১৬

সাঙ্কেতিক ভাষা বুঝতে না পারায় জঙ্গী হামলা রোখা যাচ্ছে না

আজাদ সুলায়মান ॥ নাশকতায় জঙ্গীদের ব্যবহৃত প্রযুক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না গোয়েন্দারা। আবার জঙ্গীদের সাঙ্কেতিক ভাষা বুঝতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। মোবাইল ফোনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করলেও সাঙ্কেতিক ভাষা বুঝতে না পারায় হামলার প্রকৃত টার্গেট অজানাই থেকে যাচ্ছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। এ কারণে আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থান করে জঙ্গীরা একের পর এক হুমকি ও হামলা চালানোর মতো কাজ করলেও পুলিশ ও গোয়েন্দারা হিমশিম খাচ্ছে। যদিও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করছে- জঙ্গীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। কারা তাদের মদদ দিচ্ছে সেটাও নিশ্চিত হওয়া গেছে। খুব শীঘ্রই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকা জঙ্গীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। বেশি নয় মাত্র অর্ধশতাধিক দুর্ধর্ষ জঙ্গীই ঘুরেফিরে রাজধানীসহ দেশব্যাপী আত্মগোপনে রয়েছে। এরাই গোটা দেশকে অস্থির করার জন্য একের পর এক হামলার চক্রান্ত করছে। হামলার পর আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ আইএস এর দায়িত্ব স্বীকার করছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে। ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীরা এমন অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে যে, সেটা সরকারের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা শনাক্ত করতে পারলেও তাদের সাংস্কৃতিক ভাষার প্রকৃত অর্থ বোঝা যাচ্ছে না। যেমন গুলশানে হামলার ক’দিন আগেই ঢাকা মহানগর পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে খবর পৌঁছে যায়Ñ রাজধানীতে বড় ধরনের হামলা হবে। তাতে বিদেশীদের হত্যা করা হবে। ...হামলার পরপরই ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকায় হামলা করে কেউ পার পেয়ে যেতে পারবে না। ওই হুমকির পর পুলিশ কিছুটা সতর্ক হয়ে নড়েচড়ে বসে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই জঙ্গীরা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় ভযাবহ তা-ব ও হামলা চালায়। চরম নৃশংসতার ওই হামলায় জড়িতদের পাঁচ জঙ্গী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ডে’ই নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে বা আত্মগোপনে যেতে সক্ষম হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ওই হামলার হুমকি কোথা থেকে দেয়া হয়েছিল, কী ধরনের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলÑ এখনও সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জঙ্গীরা গুলশানের কোন প্রতিষ্ঠান বা বাড়িতে হামলা করবে সেটাও সাঙ্কেতিক ভাষায় প্রকাশ করেছিল। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে পারছিল না। যদি গোয়েন্দারা সাঙ্কেতিক ভাষা বা কোড সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতেন তাহলে ওই হত্যাকা- ঠেকানো যেত বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান। এক পুলিশ কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, গুলশান হামলার পর শোলাকিয়ার মাঠে হামলার দু’দিন আগে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের সময় গোয়েন্দা ইথারে বিষয়টি ধরা পড়ে। কিন্তু কোথায় বসে কারা হুমকি দিয়েছে সে স্থান শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তকারীরা। তিনি বলেন, হুমকি দেয়ার সময় যে সঙ্কেত ব্যবহার করা হয়েছিল তাতে গুলশান বা শোলাকিয়ার কোন নাম হুমকিদাতা জঙ্গীরা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেনি। শুধু উচ্চারণ করেছে একটা সাঙ্কেতিক চিহ্ন, যা শুধু এই দুটো হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীরাই বুঝতে পারে। এ সম্পর্কে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, জঙ্গীরা যে প্রযুুক্তি ব্যবহার করছে তার কাউন্টার প্রযুক্তি গোয়েন্দাদের কাছে থাকলেও কোড জানার উপায় নেই। যে কারণে জঙ্গীদের কোড ডি কোড করা যাচ্ছে না। আর এটাই জঙ্গীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কৌশল বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। একটি গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, জঙ্গীরা দেশে ব্যবহৃত সরকারী-বেসরকারী যে কোন ফোনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে। বিভিন্ন এ্যাপসও ব্যবহার করেছে। কিন্তু তারা কথা বলছে সাঙ্কেতিক ভাষায়। যে কারণে কথা বলার সময় তারা যে স্থানে অবস্থান করছিল পরবর্তীতে তারা সেই ফোন সেখানে ফেলে রেখেই অন্যত্র আত্মগোপনে চলে যায়। এতে তাদের ধরাটাও দুরূহ হয়ে উঠছে। জঙ্গীরাও এটা ভাল করেই জানেÑ কথা বলার জায়গায় অবস্থান করা মানে নিশ্চিত ধরা পড়া। সেজন্য মোবাইল ফোনের পরিবর্তে এমন এক ধরনের স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা শনাক্ত করা যাচ্ছে না। আর যে সাঙ্কেতিক ভাষা ব্যবহার করছে, তা হামলার সম্ভাব্য স্থান সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত দিলেও সুনিশ্চিত হওয়ার মতো নয়। যেমন গুলশান হামলার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিয়ে তিন দিন আগে জঙ্গীদের মধ্যে সংলাপ চলাকালে বিষয়টি পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে ধরা পড়ে। ওই সংলাপ থেকে গোয়েন্দারা শুধু নিশ্চিত হতে পারে রাজধানীর যে কোন স্থানে একটা বড় হামলা হতে যাচ্ছে। সেটা যে গুলশান হতে পারে তা ওই হুমকির সংলাপ শুনে বুঝা যায়নি। একইভাবে ঈদের দিন দেশের যে কোন একটা বড় জামাতে হামলার তথ্য ফাঁস হয়েছিল। ওই হামলা চালানো হবে জামাতের দক্ষিণ দিক দিয়ে। এতে গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে দেশে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেয়। আর রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ, বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও শোলাকিয়াসহ কয়েকটি জামাতের দক্ষিণ দিকের অংশে নিরাপত্তা কর্মীরা থাকেন সর্বাত্মক রণসজ্জায়। আশ্চর্যের বিষয়Ñ ওই হুমকির ছকেই শোলাকিয়ার মাঠে দক্ষিণ দিকের গ্রামে পুলিশ রণকৌশল গ্রহণ করে। তাতে দুই পুলিশ প্রাণ হারালেও জঙ্গীদের মোকাবেলা করা সম্ভব হয়। যারা এসেছিল শোলাকিয়া মাঠে গিয়ে কুরুক্ষেত্র তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে, ওই জঙ্গীরা যদি পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে শোলাকিয়ার মাঠে ঢুকতে পারত তার পরিণতি হতো ভয়াবহ। একটি বোমার শব্দেই মাঠে জঙ্গী ঢুকেছে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ত। তাতে লাখ লাখ মুসল্লির মধ্যে যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হতো তাতেই পদদলিত হয়ে মারা যেত হাজার হাজার মুসল্লি।
×