ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এফবিআই ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে

ডিএনএ টেস্টের জন্য জঙ্গীদের লাশ থেকে নমুনা সংগ্রহ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২১ জুলাই ২০১৬

ডিএনএ টেস্টের জন্য জঙ্গীদের লাশ থেকে নমুনা সংগ্রহ

শংকর কুমার দে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীরা নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও নির্মম হত্যাকা- ঘটানোর জন্য শক্তিবর্ধক ‘ক্যাপ্টাগন’ নামে কোন মাদক গ্রহণ করেছিল কিনা তা পরীক্ষার জন্য রক্ত ও চুলের নমুনা সংগ্রহ করেছে ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। জঙ্গী হামলাকারীরা নেশাজাতীয় কোন ওষুধ সেবন করেছিল কিনা নিশ্চিত হতে নিহতদের রক্ত ও চুলের নমুনা পাঠানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ল্যাবে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের মর্গে থাকা জঙ্গীদের লাশ পরিবারের কেউ নিতে চাইলে তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হবে। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সারাদেশে যে ২৬২ নিখোঁজের তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে ছাত্র, প্রকৌশলী, ডাক্তার, গানের শিল্পী, রাজমিস্ত্রি, পোশাক শ্রমিক, স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১০ পেশার লোক রয়েছে, যার মধ্যে কেবল রাজধানী ঢাকাতেই নিখোঁজ রয়েছে এমন সংখ্যা ৭২। নিখোঁজের তালিকায় জিলানী নামের একজন সিরিয়ায় নিহত হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কানাডায় অবস্থানকারী তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিখোঁজের তালিকা প্রকাশের পর জঙ্গী সংশ্লিষ্টতায় অভিযুক্ত হয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে অনেকেই ফিরতে শুরু করেছে। পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর অভিযানে নিহত জঙ্গীদের দ্বিতীয় দফায় রক্ত ও চুল নমুনা সংগ্রহ করেছে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। জঙ্গীরা হত্যাকা-ের সময় কুপিয়ে-খুঁচিয়ে যে পৈশাচিক হত্যাকা- ঘটিয়েছে সেজন্য শক্তিবর্ধক কিছু কিংবা ‘ক্যাপ্টাগন’ নামের এক মাদকের নীল নেশা গ্রহণ করেছিল কিনা তা নির্ণয়ের জন্য এই নমুনা সংগ্রহের উদ্দেশ্য। নিহত জঙ্গীদের প্রতিটি বডি থেকে ২০ মিলিলিটার রক্ত এবং অন্তত ৩০টি করে চুল সংগ্রহ করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ। এসব নমুনা সংরক্ষণ করে ও পরীক্ষার পর রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হবে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে। সন্ত্রাসী হামলাকারী ও সহযোগিতারকারী হিসেবে চিহ্নিত ছয়জনের লাশ এখনও সংরক্ষিত ঢাকা সিএমএইচের মরচুয়ারিতে। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস) জঙ্গীদের মতো গুলশানের হামলাকারী জঙ্গীরা ‘ক্যাপ্টাগন’ বা বিশেষ ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে কুপিয়ে-খুঁচিয়ে নৃশংস ও নির্মমভাবে হত্যাকা- সংঘটিত করার মতো আলামত দেখা যাচ্ছে। নৃশংস ও নির্মম কায়দায় মানুষ হত্যার মাধ্যমে সারা বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্যাপ্টাগন নামের এক মাদকের নেশায় বুঁদ হচ্ছে আইএস যোদ্ধারা। এভাবে তারা দিনের পর দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দা ও সমর বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্যাপ্টাগন পাওয়া যায়। শুরুতে বিষন্নতা কাটানোর চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হতো। এর পর এটি নেশার বড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। শুধু আইএস যোদ্ধাদের মধ্যেই নয়, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে রয়েছে ক্যাপ্টাগনের ব্যাপক ব্যবহার। ধারণা করা হয়, সৌদি আরবে প্রতিবছর ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ এই নেশার জন্য চিকিৎসা নিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাপ্টাগনের বড় উৎস হয়ে উঠেছে সিরিয়া। সেখান থেকে ইউরোপসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে এই মাদক। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন ক্যাপ্টাগন নিষিদ্ধ। চরম আনন্দে, ঘুম না আসার, জাদুকরী শক্তি ॥ ক্যাপ্টাগনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মেডস্টার ওয়াশিংটন হসপিটাল সেন্টারের চিকিৎসক রবার্ট কিসলিং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, আপনি দিনের পর দিন জেগে থাকতে পারবেন। ঘুম আসবে না। এ নেশা আপনাকে ভাললাগার অনুভূতি আর চরম আনন্দে রাখবে। আপনি নিজেকে অপরাজেয় মনে করবেন, ভাববেন কেউ আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ক্যাপ্টাগনের এই জাদুকরী প্রভাবই যুদ্ধের ময়দানে জঙ্গীদের জাগিয়ে রাখার পাশাপাশি উগ্র মতবাদ লালনের শক্তি যোগাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস) জঙ্গীদের মতো গুলশানের হামলাকারীরাও বিশেষ ধরনের মাদকে আসক্ত ছিল কিনা, সেটা পরীক্ষার জন্য প্রথমেই ময়নাতদন্তের সময়ই ঘটনাস্থলে নিহত ছয়জনের রক্ত, দাঁত ও উরুর মাংস সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ। দ্বিতীয় দফায় আবারও কেন নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে নমুনা সংগ্রহকারী চিকিৎসক জানান, আমরা মৃতদেহ থেকে পাঁচ মিলিলিটার রক্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা আরও ২০ মিলিলিটার রক্ত ও নমুনা চেয়েছে। এই কারণেই দ্বিতীয় দফায় এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গীদল আইএস গুলশান হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার বলে আসছে সন্ত্রাসী হামলাকারীরা দেশীয় জঙ্গী। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি নামের ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে হত্যা করে হামলাকারীরা। তাদের ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর সশস্ত্র বাহিনী অভিযান চালিয়ে ওই ক্যাফের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সে সময় নিহত ছয়জনের মধ্যে পঁচজনকে জেএমবি সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। ওই ছয়জনের মধ্যে সাইফুল চৌকিদার নামে একজন ছিলেন ওই বেকারির পাচক। তিনিও হামলাকারীদের সঙ্গে থেকে তাদের সহায়তা করেন বলে পুলিশের ভাষ্য। গুলশান হামলার ঘটনায় পুলিশ যে মামলা করেছে, তার আসামির তালিকায় ওই ছয়জনেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে। জঙ্গী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ১৭ বিদেশীর মৃতদেহ তাদের দেশে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশী পাঁচজনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে পরিবারের কাছে। জঙ্গী পরিবারের সদস্যদেরও ডিএনএ পরীক্ষা ॥ গুলশানে আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে নিহত জঙ্গীদের লাশ নিজেদের সন্তানের দাবি করে পরিবারের কেউ নিতে চাইলে পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। কারণ, পুলিশ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েই লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায়। তবে এখন পর্যন্ত নিহত জঙ্গীদের মরদেহ নিতে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করেনি। বুধবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, যদি কোন পরিবার তাদের সন্তানদের নিতে যোগাযোগ না করে, সে ক্ষেত্রে ডেডবডিগুলো আরও কিছুদিন সিএমএইচে রাখা হবে। তবে এগুলো আরও কতদিন রাখা হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়নি। সন্ত্রাসী হামলার সময়ে অভিযানে নিহত পাঁচ জঙ্গীর লাশ বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) মর্গে রয়েছে। তারা হচ্ছে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার সাবেক ছাত্র মীর সামিহ মোবাশ্বের, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিবরাস ইসলাম, বগুড়ার বিগিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদরাসার সাবেক ছাত্র খায়রুল ইসলাম পায়েল, বগুড়ার সরকারী আযিযুল হক কলেজের ছাত্র শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। এছাড়া হলি আর্টিজানের কর্মচারী বলে পরিচিত সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের লাশও সিএমএইচে রয়েছে। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে অভিযানের সময় যৌথবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে যে পাঁচ জঙ্গী নিহত হয় তাদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহত প্রত্যেক জঙ্গীর বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেলেও তাদের কোন স্বজনই মরদেহ নিতে সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না। এফবিআই নিহত জঙ্গীদের নমুনা চেয়েছে ॥ এদিকে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলাকারীরা নেশাজাতীয় কোন ওষুধ সেবন করেছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হতে নিহতদের রক্ত ও চুলের নমুনা চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই বুধবার সকালে ঢাকা মেড্যিাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল সিএমএইচে যায়। এফবিআই রক্ত ও চুলের নমুনা সংগ্রহের জন্য কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তের মধ্যে রয়েছে- নিহত প্রত্যেকের হার্টের কাছাকাছি থেকে ১০ মিলিলিটার, হাত-পা থেকে ১০ মিলিলিটার রক্ত নিতে হবে। এছাড়া মাথার সামনে থেকে ১০টি, পেছনে থেকে ১০টি, মাথার ডান ও বাম পাশ থেকে ১০টি করে চুল সংগ্রহ করতে হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেছেন, নিহত জঙ্গীদের বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য আদালতে আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে রাসায়নিক পরীক্ষার নির্দেশ দেয় আদালত। যে পরীক্ষাগুলো দেশে করানো সম্ভব, সেগুলো আমরা দেশেই করব। আর যেগুলো দেশে করার ব্যবস্থা নেই সেগুলোর জন্য এফবিআইর ল্যাবে আলামত পাঠানো হবে। র‌্যাব প্রকাশিত নিখোঁজের তালিকায় যারা ॥ র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সারাদেশে ২৬২ জন নিখোঁজের তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে নিখোঁজদের তালিকায় রয়েছে ছাত্র, প্রকৌশলী, ডাক্তার, গানের শিল্পী, রাজমিস্ত্রি, পোশাক শ্রমিক, স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১০ পেশার মানুষ। এদের মধ্যে প্রায় চারজন সাবেক এবং বর্তমান সেনাকর্মকর্তাদের সন্তান বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে এ তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। তালিকায় থাকা একজন ইতোমধ্যে বাড়ি ফিরে এসেছেন বলেও জানিয়েছে র‌্যাব। তালিকার তথ্য অনুযায়ী, সেনাকর্মকর্তার সন্তানদের পাশাপাশি সরকারী-বেসরকারী উর্ধতন কর্মকর্তার সন্তানসহ বিভিন্ন ধনী পরিবারের সন্তানদের নাম রয়েছে। তারা রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকার বাসিন্দা বসবাস করেন বলে জানা গেছে। আবার নিখোঁজদের অনেকেই স্বনামধন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনাসহ অনেকেই স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। আবার এই নিখোঁজের তালিকায় পেশাগত জীবনে অনেক সফল ব্যক্তিও রয়েছেন। যাদের মধ্যে কয়েকজন গুলশান হামলার পরবর্তী সময়ে কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ভিডিও বার্তার সেই হামলাকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, নিখোঁজ আহমেদ আজওয়াদ ইমতিয়াজ তালুকদার মেজর কবির আহমেদ তালুকদারের ছেলে। তিনি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। আর আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম সাবেক সরকারী উর্ধতন এক কর্মকর্তার ছেলে। তিনি আনুমানিক ৬ মাস পূর্বে নিখোঁজ হয়েছেন। হিলানী ওরফে আবু জিদাল সেনাকর্মকর্তা কর্নেল মশিউরের ছেলে। মোঃ সাজাদ রউফ (২৪) নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএতে অধ্যয়নরত ছিলেন। তিনি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। মোঃ ফিরোজ মিয়া ঢাকা কলেজে মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। তিনি গত বছরের আগস্ট থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। বেলাল মোল্লা যশোর সিটি কলেজে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র। তিনি চলতি বছরের জুন মাসে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন। নিখোঁজদের মধ্যে মোঃ মাহমুদুল হাসান রাতুল (২৩), বাবার নাম রওশন আলী খান। তিনি পরিবারের সঙ্গেই রাজধানীর আদাবর থাকতেন। নটরডেম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়া রাতুল গত বছরের ১৯ জুলাই নিখোঁজ হন। দুদিন পর ২১ জুলাই তার বিষয়ে আদাবর থানায় একটি জিডি করা হয়। এখনও পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। নিখোঁজের তালিকার মধ্যে কথিত আইএসের নামে ছাড়া ভিডিওতে তিন বাঙালী তরুণের নামও রয়েছে। এদের একজন ডাঃ আরাফাত তুষার ওরফে নাহিদ রেজা তুষার। ভিডিও বার্তায় জিহাদিদের উদ্বুব্ধ করে গুলশান হামলার দিকে লক্ষ্য করে ওই ভিডিও বার্তায় অপর এক যুবক হচ্ছেন ক্লোজআপ ওয়ান তারকা তাহমিদ রহমান শাফি। নিখোঁজদের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য এরই মধ্যে অভিভাবক ও গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া গেছে। নিখোঁজ সবার বিষয়ে আরও খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। রাজধানীতেই ৭২ ॥ সারাদেশ থেকে নিখোঁজ যে ২৬২ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে রাজধানী ঢাকা থেকেই নিখোঁজ হয়েছেন ৭২ জন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসার পরই তারা নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় এদের নামে সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নিখোঁজের বিষয়ে কোন জিডি হয়নি। নিখোঁজের তালিকায় দেখা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানম-ি, আদাবর, উত্তরা, বনানী, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, রমনা, শেরে বাংলা নগর, তেজাগাঁও ও শ্যামপুর থেকে নিখোঁজ হয়েছে। এছাড়াও কেরানীগঞ্জ, আশুলিয়া থেকেও কেউ কেউ নিখোঁজ হয়েছে। ফিরতে শুরু করেছে ॥ র‌্যাব নিখোঁজের তালিকা প্রকাশের পর নিখোঁজদের অনেকেই ফিরে আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে রাধিন নামে এক তরুণ ফিরে এসেছে। সে পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর কচুক্ষেতে থাকত। নিখোঁজের জিডির খবর টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার পর মুন্সীগঞ্জের এক কলেজছাত্রী এক মাস নিখোঁজ থাকার পর ফিরে এসে নিজেই শ্রীনগর থানায় হাজির হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও থানায় নিখোঁজদের অনেকেই ফিরে আসতে শুরু করেছে। নিখোঁজ থাকলে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতায় গ্রেফতার হয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে অনেকেই নিখোঁজ থাকার পর ফিরে আসতে শুরু করেছে। নিখোঁজ জিলানী সিরিয়ায় নিহত ॥ র‌্যাবের সরবরাহকৃত ২৬২ নিখোঁজ ব্যক্তির নামের তালিকায় ২৬১ তম নামটি জিলানী ওরফে আবু জান্দাল। সিরিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছে সে। আইএসের পত্রিকা দাবিক এর দাবি, সে (জিলানী) আবু জান্দাল আল বাঙালী। জিলানীর বাবা কর্নেল মশিউর বিডিআর বিদ্রোহের সময় নিহত হন। রাজধানীর গুলশান হামলায় জড়িত সন্দেহে এক তরুণীসহ চারজনের ছবি প্রকাশের প্রায় ১০ ঘণ্টা পর ২৬২ জন নিখোঁজের র‌্যাব যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে জিলানীর নাম উল্লেখ আছে। ওই তালিকায় সারাদেশের নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি, ঠিকানা ও সাধারণ ডায়েরির (জিডি) কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বুধবার মধ্যরাতে র‌্যাবের ফেসবুক অফিসিয়াল পেজে এই তালিকাটি প্রকাশ করা হয়। এই তালিকার ২৬১ নম্বরে থাকা জিলানী ইতোমধ্যে সিরিয়ায় নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আইএসের মুখপাত্র দাবিকের ১৪৩৭ রজব এর ১৪তম ইস্যুতে দাবি করা হয়, জিলানী বাংলাদেশ সেনাকর্মকর্তার সন্তান যিনি ‘বিডিআর বিদ্রোহের’ সময় নিহত হয়েছেন। সেই প্রবন্ধে বলা হচ্ছে, ‘জিলানী তার তরুণ বয়সের শেষ সময়ে আসল ইসলামী ডাক পান, যখন তিনি শায়েখ আনোয়ার আল আওলাকির বক্তৃতা শুনতেন। যখন সিরিয়ায় খালিফা ঘোষণা দেয়া হয়, সেই শুরুর সময়েই জিলানী তাওহিদ ও খলিফার বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করতে শুরু করে। দাবিকের মতে, জিলানী যখন দেশ ছাড়তে চায়, তখন সে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কনফারেন্সের নাম করে যাওয়ার পথ নিশ্চিত করতে চেয়ে বাধার সম্মুখীন হয়। কারণ, কলেজের ‘পাপের পরিবেশের’ কথা বলে সে ইতোমধ্যেই কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সে পরবর্তীতে একটি রেফারেন্স লেটার ও অর্থ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়ে সিরিয়ার পথে যাত্রা করেন এবং সিরিয়ায় নিহত হয়। বিদেশে অবস্থানকারী তিন বাংলাদেশীর পরিচয় ॥ গুলশান অভিজাত এলাকার হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলায় সম্ভাব্য বিদেশী যোগসাজশ খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। এ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ বিদেশে থাকা বাংলাদেশীরা। সন্ত্রাসী এ হামলার পেছনে মদদ দেয়ায় সন্দেহভাজনদের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা বাংলাদেশী তরুণ আবু তারেক মোহাম্মদ তাজউদ্দিন কাউসার। জাপান প্রবাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি এবং কানাডার বাসিন্দা বাংলাদেশী বংশদ্ভূত শায়েখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফও এই হামলায় মদদতাদের মধ্যে দুই সন্দেহভাজন। গুলশান হামলায় বাংলাদেশী এ তিন নাগরিকের ভূমিকা পর্যালোচনা করছেন গোয়েন্দারা। গুলশান হামলার পর নিখোঁজ হিসেবে যে ১০ তরুণের নাম প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই তালিকায় তাদের নামও রয়েছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা বাংলাদেশী তরুণ আবু তারেক মোহাম্মদ তাজউদ্দিন কাউসারের তথ্য জানতে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়া ফেডারেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। লক্ষ্মীপুর সদরের বাসিন্দা আবু তারেক মোহাম্মদ তাজউদ্দিন কাউসার ২০০৬ সালে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যান। সর্বশেষ দেশে আসেন অসুস্থ বাবাকে দেখতে ২০১৩ সালে। এরপর থেকে পরিবারের সঙ্গে অনিয়মিত হয়ে পড়ে তার যোগাযোগ। অবশ্য গেল রমজানে বাড়িতে ফোন করে মা তাহেরা বেগমের খোঁজখবর নেন তাজউদ্দিন কাউসার। অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা তাজউদ্দিন কাউসার ছাড়াও জাপান ও কানাডা প্রবাসী নিখোঁজ দুই বাংলাদেশী সম্পর্কেও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। জাপান প্রবাসী মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকির বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার জিনদপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে। জনার্দন দেবনাথের ছেলে তিনি। জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। ২০০১ সালে উচ্চশিক্ষা নিতে জাপানে গিয়ে সেখানে স্থায়ী হন। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তামিম চৌধুরী এখন শায়েখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। দেশটির উইন্ডসরের এ বাসিন্দা বেশকিছু দিন থেকে উগ্রবাদী মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।
×