ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে

জামায়াত পরিচালিত ব্যাংক বীমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২১ জুলাই ২০১৬

জামায়াত পরিচালিত ব্যাংক বীমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ

রহিম শেখ ॥ এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে বিক্ষিপ্তভাবে জঙ্গী হামলা হচ্ছে। এসব ঘটনার পর পাকড়াও হয়েছে অনেক জঙ্গী। সর্বশেষ রাজধানীর গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর আবারও সামনে এসেছে ‘জঙ্গী অর্থায়ন’র বিষয়টি। একই সঙ্গে প্রতিবারই ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন। জঙ্গীদের যারা অর্থ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান জামায়াতের মালিকানাধীন বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে নাশকতায় অর্থ যোগানদাতাদের সন্ধানে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয় জামায়াত ঘরানোর প্রতিষ্ঠানকে। সম্প্রতি জামায়াত পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেই নির্দেশ মোতাবেক জামায়াত নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে জঙ্গী অর্থায়ন নিয়ে বুধবার আরও ২৮টি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈঠকে ব্যাংকগুলোকে জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। জানা গেছে, ২০০৫ সালের আগস্টে সারা দেশের ৬৩ জেলায় একসঙ্গে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজের শক্তির জানান দেয় ইসলামী জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এর পর থেকে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটেছে নীরবে। এ সময় বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, প্রশিক্ষণ ও হামলায় পারস্পরিক সহযোগিতা পেয়েছে। জঙ্গীবাদের এ আন্তর্জাতিকায়নের মতো এর অর্থায়নের উৎসমুখও বড় হয়েছে। সর্বশেষ রাজধানীর গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার জঙ্গী হামলার পর আবারও সামনে এসেছে ‘জঙ্গী অর্থায়ন’র বিষয়টি। জঙ্গী অর্থায়নের উৎস খুঁজতে উচ্চ পর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে গঠিত ওই টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভা হয় ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তাতে ছয়টি সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ইসলামী শরিয়াহ আইনে পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে সুদমুক্ত আমানতকারীদের সুদ বা লভ্যাংশের কত টাকা শুরু থেকে এ পর্যন্ত জমা হয়েছে এবং এ অর্থ কোথায় ব্যয় হয়েছে তার একটি হিসাব দিতে হবে। আর ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য আলাদা কোন আইন না থাকায় সাধারণ ব্যাংকিং আইনে কোন বিধান সংযোজন করে বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা যায় কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এ দুটিসহ মোট ছয়টি সিদ্ধান্ত তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর পর এক বছর পার হয়ে গেলেও ওই চিঠির উত্তর দেয়নি সংশ্লিষ্ট কেউই। এ অবস্থায় গত ৮ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোঃ কামরুল হাসান খান স্বাক্ষরিত আরেকটি তাগিদপত্র পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়গুলোতে। সূত্র জানায়, নাশকতায় অর্থ যোগানদাতাদের সন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সন্দেহভাজন ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রফতানি, ব্যাংকে খোলা ঋণপত্র (এলসি), দেশের ভেতরে-বাইরে ব্যবসায়িক লেনদেনসহ রাজস্ব পরিশোধসংক্রান্ত তথ্য, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, নগদ অর্থের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করছে। এসব ব্যবসায়ীর স্ত্রী, সন্তান, নিকটাত্মীয়, ব্যবসায়িক অংশীদারও রয়েছেন নজরদারিতে। সূত্রমতে, জঙ্গী সংগঠনগুলোকে অর্থ দাতাদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা। জঙ্গীদের যারা অর্থ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান জামায়াতের মালিকানাধীন বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে। বেসরকারী একটি ব্যাংকসহ একাধিক এনজিও প্রতিষ্ঠান ও জামায়াত প্রভাবিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। জঙ্গী বিস্তারে নেপথ্য ভূমিকায় থাকা অর্থদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় বের করতেও কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। গত ১০ জুলাই জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক শ’ প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকাসংবলিত ২১৬ পাতার একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই তালিকায় থাকা জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, জামায়াত নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের কর্তৃত্ব থাকা ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাঃ রাজী হাসান বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক জামায়াত নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তারপর যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান। জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখানোর নির্দেশ ॥ জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখানোর জন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে কিছু এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। এই এ্যাকশন প্লান বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনা পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেনে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন যথাযথ পরিপালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কনফারেন্স রুমে দেশের ২৮টি তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তাদের (ক্যামেলকো) সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএফআইইউ। এর আগে মঙ্গলবার ২৮টি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্যাংকগুলোকে জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখানোর জন্য বলা হয়েছে। জঙ্গীরা কিভাবে অর্থ লেনদেন করছে, কারা এর মদদদাতা, ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব অর্থ লেনদেন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার জন্য বিএফআইইউকে নির্দেশ দেয়া হয়। বৈঠকে বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে সন্দেহজনক লেনদেনের বেশি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে অধিক সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এর একটি অংশ আবার জঙ্গী বা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। কোন লেনদেন নিয়ে সন্দেহ হলে বিদ্যমান আইনে তাৎক্ষণিকভাবে বিএফআইইউকে তথ্য দেয়ার নিয়ম থাকলেও অনেক ব্যাংক তা করে না। যে কারণে পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিদর্শনে সন্দেহজনক লেনদেনের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সামনের দিনে কোনভাবে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করতে বলা হয়েছে।
×