ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

২৩ জুলাই শহীদ মিনার থেকে গুলশান Ñ সংস্কৃতিকর্মীদের মিছিল

অন্ধকার সময় রুখতে রাস্তায় নামছে সাংস্কৃতিক শক্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২১ জুলাই ২০১৬

অন্ধকার সময় রুখতে রাস্তায় নামছে সাংস্কৃতিক শক্তি

মোরসালিন মিজান ॥ জঙ্গীবাদের ভয়ঙ্কর ছোবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে এবার ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামছে সামাজিক সাংস্কৃতিক শক্তি। জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অভিভাবক সংগঠনগুলো এরই মাঝে নানা কর্মসূচী নিয়ে মাঠে আছে। ধর্মান্ধ অপশক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজধানীসহ সারাদেশে এসব কর্মসূচী পালন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে এলে জঙ্গীবাদের মতো দানব পরাজিত হতে বাধ্য। সমাজ ও দেশের প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টি ও জাগ্রত করতে কর্মসূচী অব্যাহত রাখা হবে। বাংলাদেশে ধর্মের নামে বহুদিন ধরেই মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল জঙ্গীবাদ। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হতে থাকলে তৎপরতা বাড়িয়ে দেয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। এরই অংশ হিসেবে প্রথমে ব্লগারদের খুন করা হয়। একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে প্রগতিশীল চিন্তার অনেক ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ পর্যায়ে একই গোষ্ঠী অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর বর্বর আক্রমণ শুরু করে। মন্দিরের পুরোহিত, আশ্রমের সেবক, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করতে থাকে। অতিথিপরায়ন বাঙালী অবাক হয়ে দেখেন, রাস্তার ধারে পড়ে আছে বিদেশী নাগরিকের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ। এসবের বিরুদ্ধে কথা বলায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের হত্যার হুমকি দেয়া হয়। আর এই দানব কতবড় দানব, কত ভয়ঙ্কর এর চেহারা তা পরিষ্কার হয় গত ১ জুলাই। এদিন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় আক্রমণ চালিয়ে ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এমন বিভীষিকা এর আগে দেখেনি বাংলাদেশ। এখনও শোকস্তব্ধ গোটা জাতি। তবে এই শোককে শক্তিতে পরিণত করার ওপর জোর দিচ্ছে দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক শক্তি। তাদের মতে, ধর্মের নামে এমন নিষ্ঠুরতা মানুষ খুন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে অকল্পনীয়। এ দেশের আলো জল হাওয়ায় বড় হওয়া, বেড়ে ওঠা কোন মানুষ এত অমানবিক হতে পারে না। পরিবার ও সমাজের ক্যান্সার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তারা। এই টিউমার অপসারণ একা সরকারের কাজ নয়। বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি দিয়ে অন্ধকার সময়ের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সংস্কৃতির আলোয় আত্মাকে বিকশিত করতে হবে। তবেই জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। এরই মাঝে ধর্মের নামে মানুষ হত্যার কালো সময়ে ভীত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সম্প্রতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, রামেন্দু মজুমদার, ড. সারওয়ার আলীসহ ৩২ বুদ্ধিজীবীর দেয়া বিবৃতিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে তারা বলেন, সমবেতভাবে এ অপশক্তিকে রুখতে হবে। কতিপয় বিপথগামীর কাছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশ পরাস্ত হতে পারে না। ধর্মীয় জঙ্গীবাদ বৈশ্বিক সমস্যা এবং নানান নামে তাদের চিন্তাধারার অনুসারীরা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ধারাবাহিক অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক হামলায় হত্যাকারীদের অধিকাংশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সচ্ছল পরিবারের সন্তান। হত্যাকা-ের পরিকল্পনাকারীরা তাদের ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যায় দীক্ষিত ও আচ্ছন্ন করেছে, অত্যাধুনিক ও আত্মহননের পথে প্ররোচিত করেছে। এদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মমত্ব ও মানবিকতাবোধ সৃষ্টি করার ওপর জোর দেয়া হয় বিবৃতিতে। বিশিষ্ট নাগরিকদের এ আহ্বান আমলে নিয়ে জাতীয়ভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতি সংগঠনগুলোর নেতারা পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেন। গত সপ্তাহে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় একটি বৈঠক। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. সারওয়ার আলী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, জঙ্গীবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশেও এর থাবা পড়েছে। জঙ্গীবাদ রুখতে সরকার তার নিজের মতো করে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা মনে করছি আমাদেরও অনেক কিছু করার আছে। সমস্যার আরও গভীরে যেতে হবে। এজন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার আছে। সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে, সব মত-পথের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এ কাজ এগিয়ে নিতে চাই। সে লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচী পালনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। একই বিষয়ে কর্মসূচী চূড়ান্ত করতে বুধবার টিএসসি কার্যালয়ে প্রতিনিধি সভা ডাকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। জোটের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। বৈঠক শেষে জোটের সভাপতি গোলাস কুদ্দুছ জনকণ্ঠকে বলেন, গুলশানে ও শোলাকিয়ায় যারা জঙ্গী আক্রমণ চালিয়েছে তারা বয়সে তরুণ। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছে। এই অংশটির শেকড়ের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে কোন সংযোগ থাকে না। বাবা মা ভাই কোন প্রেয়সীকে ভালবাসার মতো করে এদের গড়ে তোলা হচ্ছে না। জঙ্গীবাদের উত্থানের এটা অনেক বড় কারণ। আমরা সেই মূল জায়গাটিতে কাজ করতে চাই। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করতে চাই। কাজটি ব্যাপকভাবে করতে সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি একত্রিত হয়ে মাঠে নামার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি জানান, এরই অংশ হিসেবে আগামী ২৩ জুলাই শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে গুলশান পর্যন্ত পদযাত্রা কর্মসূচী পালন করা হবে। বিকেল তিনটায় শুরু হওয়া পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করবেন দেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। জঙ্গীবাদবিরোধী সঙ্গীত পরিবেশ ও আবৃত্তিসহকারে এগিয়ে যাবে মিছিল। গুলশানে নিহতদের প্রতিকৃতি বহন করবেন সংস্কৃতি কর্মীরা। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর সামনে সন্ধ্যায় ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। একই সময় থাকবে প্রদীপ প্রজ্বালনের কর্মসূচী। জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ জানান, এটা শুরু; আরও কর্মসূচী আসছে। দেশব্যাপী জঙ্গীবাদবিরোধী কর্মসূচী অব্যাহত রাখা হবে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাঠে নামছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অহর্নিশ সংগ্রাম করা গোষ্ঠী আগামী ২২ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দেশব্যাপী ‘জঙ্গীবাদবিরোধী সপ্তাহ’ পালন করবে। এ লক্ষ্যে বিস্তারিত কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে উদীচীর প্রতিটি জেলা ও শাখা সংসদ নিজ নিজ এলাকায় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করবে। থাকবে জনসচেতনতামূলক নানান কর্মসূচী। জঙ্গীবাদবিরোধী সপ্তাহের প্রথম দিন বিকেলে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনুষ্ঠিত হবে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ। এছাড়া সপ্তাহের শেষ দিন ২৮ জুলাইও কেন্দ্রীয় উদীচীর উদ্যোগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এমন কর্মসূচী গ্রহণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে উদীচী সভাপতি কামাল লোহানী বলেন, গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলা এবং ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় দেশ গভীর সঙ্কটের মুখে পড়েছে। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে ব্লগার, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মী, ইমাম, পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ, বিদেশী অতিথিসহ সমাজের প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনা সেসব ঘটনারই ধারাবাহিকতা বলে মনে করে উদীচী। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। লাখো শহীদের রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক দেশে রূপান্তরিত করতে দেয়া হবে না। বাংলার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা এবং সব ধরনের উগ্রতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতে উদীচী জঙ্গীবাদবিরোধী সপ্তাহ পালন করবে বলে জানান দেশের বিশিষ্ট এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কর্মসূচীতে যোগ দেয়ার জন্য সমাজের সকল বয়সের, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে উদীচী। এছাড়াও জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, পথনাটক পরিষদ, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন অভিভাবক সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে জঙ্গীবাদবিরোধী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। এ প্রসঙ্গে গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি শিল্পী ফকির আলমগীর বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গীবাদের যে চেহারা আমরা দেখছি তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। ভাবতে কষ্ট হয়, এত ভয়ঙ্কর খুনী এ সমাজ থেকেই এসেছে! আমাদের আশপাশে বড় হয়েছে! এদের সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে এ কথা পরিষ্কার যে, মানুষের প্রতি, সমাজ ও দেশের প্রতি এদের কোন দায়বোধ গড়ে ওঠেনি। সুকুমার বৃত্তির কোন চর্চায় এরা যুক্ত ছিল না। ফলে মনে কোন কোমলতা স্থান পায়নি। আমরা সংস্কৃতি কর্মীরা এ কথাগুলো সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে চাই। একই প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা এর চেয়ে বড় সঙ্কট পাড়ি দিয়ে এসেছি। তখনও সংস্কৃতি কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন; এখনও তারা লড়াইয়ে নামলে শত্রুরা পিছ পা হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে জঙ্গীবাদবিরোধী কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
×