ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২১ জুলাই ২০১৬

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

আজ একুশে জুলাই। কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছর পূর্ণ করবে শীঘ্রই। দীর্ঘ এই সময়ের পরও কর্নেল তাহের ও জাসদ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল আছে জনমনে, সচেতন মহলে। সমাজ বদলের লড়াইয়ে জাসদ ও তাহের এমন কিছু ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত করেছিল, সমাজকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মূলে আঘাত হেনেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাসদ সূচিত সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান অবশ্য সফল হয়নি, প্রতিবিপ্লবের কাছে পরাজিত হয়েছিল। এর ফলে কঠিন মূল্য দিতে হয় অভ্যুত্থানের নেতা তাহের ও তার দল জাসদকে। পরাজিত হলে যা হয়, তাহের ও জাসদকে বাংলাদেশ ও জনগণের সকল ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিভিন্ন মহলের যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা অভিযোগ ও আক্রমণ এখনও প্রবলভাবেই অব্যাহত আছে জাসদের বিরুদ্ধে। অতীতে জাসদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের পথভ্রষ্টতার কারণে জাসদে ভাঙ্গন এসেছে একাধিকবার। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশন থেকে কয়েক নেতা কোন আদর্শিক কারণে নয়, নিছক একটি পদের জন্য বেরিয়ে গিয়ে নতুন কমিটি করেছেন। এত বিপর্যয়ের পরও এই দলটিকে নিয়ে নানা মহলের ‘ভূতের ভয়’ এটাই নির্দেশ করে যে আগামী দিনের রাজনীতিতে জাসদের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিতা ভালভাবেই আছে। প্রতিপক্ষ এখনও জাসদের উত্থানে ভীত বোধ করে। একটি রিট পিটিশনের জবাবে দীর্ঘ শুনানির পর মহামান্য হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে– ‘তাহেরকে বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছে, তিনি একজন মহান দেশপ্রেমিক’– এমন অভিমত দেয়ার পর, তাহেরের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। ‘গবেষণার’ নামে নির্বিচার মিথ্যাচার চলছে তার নামে। কারণ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মনে তাহের নামটি এখনও ভীতির সঞ্চার করে। তা ঝেড়ে ফেলতে এক অশুভ জোটে জড়ো হওয়ার প্রক্রিয়ায় ‘গবেষকদের’ নিয়োগ করেছে তারা। এই প্রেক্ষাপটে জানাব কি কি বিবেচনায় তাহের জাসদে যোগ দিয়েছিলেন। সে বিবেচনা যথার্থ ছিল কিনা। শিরোনামের বিষয়ে বিশদে বলার আগে জাসদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাটি বলে নেই। তা এই জন্য যে, জাসদের সঙ্গে কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের সংযোগ আমার মাধ্যমেই হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তির কিছুদিন পরই আমার জীবনে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল। আমরা কয়েক ছাত্র লেখাপড়া ছেড়ে টেকনাফ অঞ্চলে চলে গিয়েছিলাম। আমাদের নেতা ছিলেন প্রয়াত সিরাজ শিকদার। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সদ্য তিনি পাস করে বেরিয়েছেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন তিনি। তার যে রাজনৈতিক তত্ত্ব আমাদের আকৃষ্ট করেছিল, তা তখনকার দিনে প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলেছিলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের উপনিবেশ। শুধু একটি সশস্ত্র জাতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন মাতৃভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তার জন্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলতে হবে। টেকনাফ অঞ্চলকে বেছে নেয়ার কারণ, ওই অঞ্চলে নাফ নদী পার হলেই ওপারে আরাকান রাজ্য। বার্মার বহু বিস্মৃত জায়গা তখন সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে। সে সময়টায় পৃথিবীজুড়ে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চলছে। সমাজতান্ত্রিক চীন তাতে সক্রিয় সমর্থন দিচ্ছে। বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির। নাফ নদীর ওপারে আরাকান ও আরও গভীরে পেগু পাহাড় অতিক্রম করে আমরা চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কথাও ভেবেছি। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার সিরাজ শিকদারের চিন্তা আমাদের পরিবারের আবাল্য লালিত স্বপ্নের সঙ্গে মিশে গেল। কারণ আমাদের পরিবারেও আমার ভাই কর্নেল তাহের, আমার বড় বোন শেলী আপা এসব কথা বলতেন। তাহের শুধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন না, ভবিষ্যত মুক্তিযুদ্ধের কথা চিন্তা করে যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্য পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। কমান্ডো বাহিনীর অফিসার তাহের ছুটিতে বাড়ি এলেই আমাদের শেখাতেন অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল, খালি হাতে যুদ্ধ ও নানা যুদ্ধ সরঞ্জাম বানাবার পদ্ধতি। গেরিলা যুদ্ধের নীতি কৌশলের ওপর আমাদের ক্লাস নিতেন। আমাদের বিপ্লবী প্রচেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কয়েক মাসের মধ্যে অধিকাংশ সাথী বিপ্লবের কঠিন জীবন ছেড়ে ঢাকায় ফিরে যান। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। ১৯৬৯ সালে যখন সারাদেশে আইয়ুববিরোধী প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হলেও দেশে জারি হয় ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল’। এ সময় দ্বিতীয়বারের মতো আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিপ্লবী কাজে আত্মনিয়োগ করি। সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে আমাদের বিপ্লবী প্রচেষ্টায় এবার আমরা তাহেরকেও যুক্ত করেছিলাম। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন থেকে তাহের দীর্ঘ ছুটি নিয়ে ঢাকায় কলাবাগানে আমাদের মেজ ভাই আবু ইউসুফের বাসায় প্রতিদিন তিনটি ব্যাচে বিপ্লবী যুবকদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের নীতি-কৌশল শেখানো শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন সিরাজ শিকদার। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে তাহের এবং আমার সম্পর্ক অবশ্য স্থায়ী হয়নি। প্রশিক্ষণ চলাকালে মতপার্থক্য ঘটল। চলবে...
×