ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যার রিমান্ডে থাকার কথা, তার ডাকে জাতীয় ঐক্য? -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২১ জুলাই ২০১৬

যার রিমান্ডে থাকার কথা, তার ডাকে জাতীয় ঐক্য? -স্বদেশ রায়

গুলশানের জঙ্গী হামলার পর গোটা জাতি শোকাহত, জঙ্গীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ- এ সময়ে বাংলাদেশের নষ্ট একটি শ্রেণী এই জঙ্গী হামলাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের কিছু নষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও তথাকথিত সুশীলসমাজ তারা এই সুযোগে বাংলাদেশের জঙ্গীমাতা খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছে, তথাকথিত জাতীয় ঐক্যের নামে। জাতীয় ঐক্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনেক পরিচিত। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ দেশের মানুষ জাতীয় ঐক্য দেখেছে। সেদিন ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, নেজামে ইসলামী বা জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য হয়নি। সেদিন মানুষই জাতীয় ঐক্য তৈরি করেছিল। সেদিনও যেমন জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে ইয়াহিয়া, ভুট্টো, নেজামে ইসলামী বা জামায়াতে ইসলামীর কোন সম্পর্ক ছিল না, আজও খালেদা, জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ঐক্যজোট, হেফাজতে ইসলাম এদের নিয়ে জঙ্গীবিরোধী জাতীয় ঐক্য হয় না। মূলত বাংলাদেশের জঙ্গী তৎপরতার বাস্তবতা যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে বলতে হবে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট কঠোর সরকার নয় বলেই ( দুর্বল বললাম না) খালেদা জিয়া আজ রিমান্ডে নয়। জেলেও নয়। কারণ অন্য কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলে ২০১৩ থেকে এ অবধি খালেদা জিয়া যেভাবে জঙ্গী তৎপরতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাতে তার রিমান্ডে থাকার কথা, জেলে থাকার কথা। বাইরে থাকতেন না। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার বলেই খালেদা বাইরে আছেন। আর কোন অথরিটিয়ান দেশে হলে, যেমন সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া হলে এতদিন জঙ্গী নেতৃত্বের অপরাধে খালেদার সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ে যেত। অথচ দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের যে- এক শ্রেণীর নষ্ট বুদ্ধিজীবী ও চরিত্রহীন রাজনীতিকরা তাকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। সত্যি বিচিত্র এ দেশ! ২০১৩ সালে সাতক্ষীরা, বগুড়া বা চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় যে সীমাহীন জঙ্গী তৎপরতা ঘটেছিল, যেভাবে জঙ্গীরা মানুষ হত্যা করেছিল তা কার নেতৃত্বে হয়েছিল? বাংলাদেশে একা জামায়াতের সাধ্য আছে এ কাজ করা! বিএনপি ছাড়া জামায়াত কোথাও দাঁড়াতে পারে? তা ছাড়া সারাদেশে যেভাবে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছেন বেগম জিয়া, নিজের অফিসে মাসের পর মাস কাটিয়ে ওই হত্যাকা-ের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার পরে তিনি জঙ্গী নন, বাড়ির দুষ্টু মেয়ে আর কি? একটু দুষ্টুমি করে ১৬ কোটি মানুষের কয়েক শ’ মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। যেন মায়ের অনেক তৈজসপত্র তার থেকে দুষ্টু মেয়েটি কয়েকটি কাচের গ্লাস ভেঙ্গেছে! যে সব বুদ্ধিজীবী এখনও তাকে নিয়ে ঐক্যের কথা বলেন, এদের নাকে কি মানুষের পোড়া গন্ধ লাগে না? নাকি এরা অন্য কোন পশুর নাক নিজের নাকে লাগিয়ে নিয়েছেন? আওয়ামী লীগের এক নেতা তিনি অবশ্য ঐক্যের বিপক্ষে, তার পরেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলেন, বুঝি রাজনীতিবিদরা এভাবে মতামত যাচাই করে নেন, তাঁকে বলি, বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আমি আলোচনায় বসতে পারি না। আর এখন কি আওয়ামী লীগ বার্ন ইউনিট ভুলে গিয়ে খালেদার সঙ্গে আলোচনায় বসবে? অবশ্য শেখ হাসিনা সাফ জবাব দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও শেখ হাসিনার আসেম থেকে ফিরে এই জবাব দেয়ার আগে আওয়ামী লীগের নানান নেতা কেন নানান কথা বলেন? তারা কী বুঝে বলেন, আলোচনা হতে হলে জামায়াতকে ছাড়তে হবে? বাংলাদেশে এখন জঙ্গী হিসেবে কে বড় জামায়াত না খালেদা ও তারেক? যা হোক, শেখ হাসিনা বলার পরে আওয়ামী লীগের ওই সব নেতার নানান ধরনের বক্তব্য শেষ হয়েছে। তবে হায়রে আমাদের মিডিয়ার একটি অংশ! বুঝতে পারি না। এরা বোঝার ওপারে, না হয় আমাদের মতো মূর্খদের পক্ষে এদের বোঝা সম্ভব নয়। তবে ওয়েস্টার্ন কোন মিডিয়া তো বোগদাদীর পক্ষে যে সব বুদ্ধিজীবী তথাকথিত ইসলামিক স্টেটে আছে তাদের নিয়ে টকশো করে না। তাদের বক্তব্য প্রকাশ করে না। আমাদের এদের এত বাংলাদেশের বোগদাদী খালেদার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে টানাটানি কেন? রশিটি কোথাকার? গুলশান ঘটনার পরদিন একটু আকার ইঙ্গিতে কিছু কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। এখন এই রশিটি কোথায় সেটা তাকে অবশ্যই দেখতে হবে। এই রশিটির উৎস না দেখলে কিন্তু বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ করা কষ্টকর। এই রশিটির যেমন উৎস দেখতে হবে, তেমনি বাংলাদেশের জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ করতে হলে শেখ হাসিনাকে ও তাঁর দল বা জোটকে আরও বেশি মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। গুলশান ঘটনার পরে ১৪ দল রাজধানীতে যে মিটিং করে সেখানে কেন কম সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হলো- এটা সত্যিই দুঃখজনক। এদিন কেন লাখ লাখ মানুষ ঢাকা শহরের রাস্তায় নেমে এলো না? কেন আওয়ামী লীগ সে ব্যবস্থা করল না। ডানপন্থী এরদোগান যদি এত মানুষ নামাতে পারে, উদার রাজনীতিক শেখ হাসিনার পক্ষে কি জঙ্গী বিরোধিতায় রাজপথে মানুষ নামবে না? কেন ১৪ দলের নেতৃত্বে এখনও জেলা শহরগুলোতে মাঠ ও রাস্তা উপচে পড়া মানুষ জঙ্গীবাদের প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে না? এর কারণ কি সেটা খুঁজতে হবে আওয়ামী লীগকে। যদিও পশ্চিমারা এখনও মনে করছে, বর্তমানের যে জঙ্গীবাদ তা উন্নত টেকনোলজি দিয়ে দমন করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়। পশ্চিমাদের হিসেবে তাদের বিষয়টি ঠিক, কারণ তাদের জঙ্গীবাদ দমন করতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে, আফ্রিকায় ও আফগানিস্তানে। সেখানে টেকনোলজি ছাড়া তাদের কিছু করার নেই। কিন্তু বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদ দমন করতে হবে নিজের দেশের ভেতর। তাই এখানে টেকনোলজি যেমন প্রয়োজন, উন্নত ও আধুনিক অস্ত্র এবং উপাদান সমৃদ্ধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন প্রয়োজন, তেমনি রাজনৈতিক কর্মকা- বা জনসম্পৃক্ততা আরও বেশি প্রয়োজন। যেমন বিএনপি ঘরানার ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ী এমনকি আশ্রয়দাতার সাহায্য না পেলে শুধুমাত্র জামায়াত, জেএমবি, হুজি বা এটিবির পক্ষে কোন হামলা করা সম্ভব নয়। তাই যে জনসম্পৃক্ততা নিয়ে জঙ্গীরা কার্যক্রম চালাচ্ছে তার থেকে শত গুণ জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে জঙ্গীবিরোধী তৎপরতায়। সত্যি কথা বলতে কি এখানে শেখ হাসিনা ছাড়া বেশিরভাগের কোথায় যেন একটা আন্তরিকতার অভাব দেখা যাচ্ছে। তারা সকলে যেন অন্য কোন একটা কাজে ব্যস্ত। তাদের ওই ব্যস্ততা যাতে কমে, এ কাজে যাতে মনোযোগী হয় সে কাজটি শেখ হাসিনাকে করতে হবে। তা না হলে কিন্তু বর্তমানে জাতি যে আতঙ্কে আছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর মাথা নিচু হয়ে গেছে। তাঁর মাথা অর্থাৎ জাতির মাথা। এ মাথাকে উঁচু করতে হলে তাঁর নেতাদের ওই ‘অন্য’ কাজটি কমাতে হবে। আগে জঙ্গী দমন করতে হবে। নইলে সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। যেমন গত সোমবার সত্যি অর্থে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে খুব ব্যথিত হয়েছি। কারণ পুলিশ অফিসার হিসেবে র‌্যাবপ্রধান বেনজির আহমেদকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তাঁর যোগ্যতাই তাঁকে পছন্দ করার মূল কারণ। তিনি যে মুখ করে বগুড়ায় গিয়েছিলেন ওই চরে অপারেশন চালাতে, তত বড় মুখ নিয়ে তিনি ফিরতে পারেননি। কারণ তাঁর অপারেশন ওইভাবে খুব ফলদায়ক হয়নি। অথচ ওই চরে যে জঙ্গী ট্রেনিং হয় সে সংবাদ বিদেশী পত্রিকায়ও প্রায় এক বছর আগে ছাপা হয়েছে। তা হলে অপারেশনটি এমন হলো কেন? বেনজির আহমেদ অত্যন্ত ট্যালেন্টেড অফিসার। তিনি নিশ্চয়ই অপারেশনের সবদিক এখন ক্ষতিয়ে দেখবেন। বেনজির আহমেদ যখন এই অপারেশনের ফল খতিয়ে দেখতে বসবেন, তখন তাঁকে কয়েকটি অনুরোধ করব। এক. যে স্থানীয় পুলিশ অফিসারদের নিয়ে আপনি ওই অপারেশনে গিয়েছিলেন তাদের ছাত্র জীবনের রাজনীতি খোঁজ নিন। দুই. বগুড়ায় তাদের সামাজিক সম্পর্কের খোঁজ নিন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে খোঁজ নিতে হবে, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ কি এই অপারেশনে মন থেকে সাহায্য করেছে? আমরা আমাদের সাংবাদিকতার সূত্রের মাধ্যমে যে খোঁজ পাই তাতে জানতে পারি, বগুড়ার অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা জামায়াতের সঙ্গে একটা সমঝোতার সঙ্গে সেখানে রাজনীতি করেন। যেমন গুলশান হামলা ও শোলাকিয়ার হামলার পরে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেখানে কথা প্রসঙ্গে আসে জনকণ্ঠের একটি নিউজের কথা- যেখানে জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার সমুদ্র হক উল্লেখ করেছেন, বগুড়াই বেশি জঙ্গী প্রোডিউস করছে। তখন ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে বলি, আপনারা যেভাবে ড. রাজ্জাক ও কর্নেল ফারুক খানকে দিয়ে ঢাকার কমিটি করেছেন। বগুড়ায় এই দুজনকে দিয়ে একটি কাজ করান। আপনারা বগুড়ার বর্তমান আওয়ামী লীগ কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে ফারুখ খান ও ড. রাজ্জাক যেমন ঢাকার কয়েক হাজার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা মহানগর কমিটি করেছেন, তেমনি তারা বগুড়ায়ও কয়েক হাজার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে বগুড়া আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি করুক। দেখবেন, তাতেই দেশের ত্রিশ ভাগ জঙ্গী হামলা কমে যাবে। কারণ ওই নতুন কমিটি করার সঙ্গে সঙ্গে বগুড়ার প্রশাসন ঠিক হয়ে যাবে। প্রশাসন আর জামায়াত বিএনপিকে পরোক্ষ সহায়তা করবে না। এবং বগুড়া থেকে জামায়াত পালাতে শুরু করবে। যেমন তারা পালিয়েছে সাতক্ষীরা থেকে। এমনিভাবে জঙ্গী উপদ্রুত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেখানের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিয়েও শেখ হাসিনাকে ভাবতে হবে। কারণ এটা তো অতি সহজ, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও কিছু এলাকায় কীভাবে জামায়াত, বিএনপি ও জঙ্গীরা এই অপরাধী চক্রের আধিপত্য বজায় রেখেছে। কোথাও একটা অন্ধকার দিক সেখানে আছে। আর সেটা সরকারী দলের ভেতরই। এই ক্যান্সারও শেখ হাসিনাকে সারাতে হবে। এসব কথা লিখতে গিয়েও দুঃখ লাগে এই ভেবে, সব কিছু একজনকে করতে হবে? আবার সান্ত¡না খুঁজে পাই, কবি শামসুর রাহমানের কবিতায়, তোমার কন্যা একি গুরুভার বয়। আসলে বঙ্গবন্ধু রক্ত দিয়ে এ গুরুভার তো কন্যার কাঁধেই দিয়ে গেছেন। তাঁকে তো এ পাষাণ ভার বইতেই হবে। [email protected]
×