ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

ফুটবলের দেশে অলিম্পিক

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২০ জুলাই ২০১৬

ফুটবলের দেশে অলিম্পিক

আরেকটি মহাযজ্ঞ! বিশ্ব ক্রীড়া ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রদর্শনী শুরু হতে বাকি শুধু চলতি মাসের কয়েকটা দিন। আগস্টের শুরুতেই ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে বিবেচিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক শুরু হয়ে যাবে। ৫ থেকে ২১ আগস্ট এবার এ মহাযজ্ঞের আয়োজন করবে ব্রাজিলের সমুদ্র তীরবর্তী শহর রিও ডি জেনিরো। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত পাহাড়-পর্বত ঘেরা এই শহরটি নিদারুণ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সেখানেই এবারের অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু দেশটির সিংহভাগ সাধারণ জনগণই এই বিরাট ব্যয়বহুল আয়োজনের বিপক্ষে। দেশটির অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে সাধারণ মানুষ অনেক আগে থেকেই অলিম্পিক আয়োজন না করার দাবিতে সোচ্চার। এছাড়া আছে জঙ্গী হামলার হুমকি। বিভিন্ন অংশগ্রহণকারী দলের ওপর আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলার বেশ কয়েকটি হুমকি রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ব্রাজিলে ছড়িয়ে পড়া এ মারাত্মক ভাইরাসের কারণে অনেক তারকা এ্যাথলেটই এবার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা থাকায়। আর ব্যাপক হারে ডোপ পাপের জন্য আকর্ষণীয় রাশিয়ার ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের এ্যাথলেটরা অংশ নিতে পারবেন না। গুঞ্জন উঠেছে রিও অলিম্পিকে রাশিয়ার পুরো দলকেই নিষিদ্ধ করা হতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে এবার অলিম্পিক আকর্ষণীয় ও বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে সফল করাটাই এখন ব্রাজিলের জন্য বিরাট অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টালমাটাল এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে রিও অলিম্পিক নিয়ে। এবার অলিম্পিকে ১৮৬ দেশের ১০ হাজার ২৯৩ ক্রীড়াবিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। শুরুর পর সেটা বেড়ে ছাড়িয়ে যেতে পারে ১০ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি। এবার ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন ক্রীড়ার ৪১ ডিসিপ্লিনে মোট ৩০৬ ইভেন্টে হবে স্বর্ণপদকের লড়াই। মূল ভেন্যু বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়াম। মারাকানা স্টেডিয়ামকে ঘিরে সবমিলিয়ে চারটি ভেন্যু রাখা হয়েছে এই অলিম্পিক আয়োজনের। মারাকানা, ডিওডোরো, ব্যারা ও কোপাকাবানায় হবে ক্রীড়াযজ্ঞ। এই ভেন্যু চারটিকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে অলিম্পিক ভিলেজ। অলিম্পিকের ইতিহাসে এবারের ভিলেজটিই সবচেয়ে বড় হবে বলে দাবি করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে স্টেডিয়ামে থাকবে ৮০ হাজার চেয়ার, ৭০ হাজার টেবিল, ২৯ হাজার ম্যাট্রেস, ৬০ হাজার কাপড় ঝুলানোর হ্যাঙ্গার, ৬ হাজার টেলিভিশন ও ১০ হাজার স্মার্টফোন। এই বিশাল যজ্ঞের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে ব্রাজিলকে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সংস্কার, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি, অলিম্পিক পার্ক তৈরি, বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং সৌন্দর্যবর্ধনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়েছে ব্রাজিল সরকারকে। এবার অলিম্পিকের অফিসিয়াল মাস্কট করা হয়েছে ব্যারা ডাঃ টিজুকা। এর মূল নাম ভিনিসিয়াস। বিখ্যাত সঙ্গীত বিশারদ ভিনিসিয়াস ডি মোরায়েসের সঙ্গে মিল রেখে এ নাম দেয়া হয়েছে। ব্রাজিলের স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেহারায় থাকবে দেশটির বন্য বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি। ২০১৪ সালেই ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলে আরেকটি বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছে। সে সময়ই বিশ্বকাপবিরোধী কার্যক্রমে সোচ্চার ছিলেন ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ। কারণ যেখানে অনেক মানুষ নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে, অন্ন-বস্ত্রের সংস্থানে হা-হুতাশ করছেন তখন ক্রীড়ার পেছনে এই বিপুল অর্থ ব্যয় অহেতুক বলেই মনে করেছেন তারা। তাই বিশ্বকাপ চলার সময়েও প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন রাজপথে। এবারও একই সমস্যার কারণে নিজেদের জীবনমানের উন্নয়নের দাবিতে অলিম্পিকবিরোধী অনেক মানুষই রাজপথে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু এরপরও অলিম্পিক প্রস্তুতি থেমে নেই। বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত সফলভাবেই আয়োজন করেছে ব্রাজিল। এবার অলিম্পিকও সার্থক আয়োজনের ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্থানীয় আয়োজকরা। শুধুমাত্র অলিম্পিক পার্ক তৈরিতেই ৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। সাধারণ মানুষের দাবি এই বিপুল অর্থ দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে এবং জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা ও জীবনমানের উন্নতি নিশ্চিত করার পেছনে ব্যয় করা হোক। স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি এবার অনেক বড় মাথাব্যথার কারণ। এক ধরনের মশা থেকে জিকা ভাইরাস বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা যাতে অলিম্পিকের সময় কমে যায় সেজন্য স্থানীয় আয়োজকদের জল নিষ্কাষণের ব্যবস্থাগুলোর উন্নয়ন, স্যুয়ারেজ পদ্ধতিতে সংস্কার ইত্যাদির জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। এছাড়া ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ার জন্যও ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন দেশের এ্যাথলেটরা বেশ উদ্বিগ্ন এ বিষয়টি নিয়ে। অনেক বড় তারকাই সে কারণে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবার রিও অলিম্পিক থেকে। বিশেষ করে টেনিস ডিসিপ্লিন প্রায় তারকাশূন্য হয়ে গেছে। কানাডার মিলোস রাওনিক, রোমানিয়ার সিমোনা হ্যালেপ, ৮ নম্বর চেক প্রজাতন্ত্রের তারকা টমাস বার্ডিচ, ১৬ নম্বর রাশিয়ান তারকা ক্যারোলিনা পিসকোভা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন ইসনার, অস্ট্রিয়ার ডোমিনিক থিয়েম, অস্ট্রেলিয়ার বার্নার্ড টমিক ও নিক কাইরজিওস, স্পেনের ফেলিসিয়ানো লোপেজ, ইতালির মহিলা তারকা ফ্রান্সেসকা শিয়াভোন। এছাড়া বেলারুশের টেনিস সেনসেশন, বিশ্বের ৬ নম্বর ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা ইনজুরির জন্য এবং রাশিয়ান সুন্দরী মারিয়া শারাপোভা ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হওয়ার কারণে থাকছেন না অলিম্পিকে। এছাড়া রাশিয়ার এ্যাথলেটিক্স দল ডোপ কেলেঙ্কারির জন্য নিষিদ্ধ হওয়ায় অলিম্পিকে অনেক তারকার ঘাটতি থাকবে। অংশ নেবেন না দক্ষিণ আফ্রিকার মেজরজয়ী গলফার লুইস ওসথুইজেন, ব্র্যানডেন গ্রেস ও চার্ল স্কোয়ার্টজেল। এই তালিকাটা আরও বড়। আর সম্প্রতিই নতুন করে রাশিয়ান ক্রীড়াবিদদের নিয়ে প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে আরও ডোপ পাপের ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সোচি শীতকালীন অলিম্পিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক রাশিয়ান ক্রীড়াবিদই নাকি অবৈধ ড্রাগ গ্রহণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ডোপবিরোধী সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে এটি বেরিয়ে এসেছে। উভয় দেশের ডোপবিরোধী সংস্থা এ কারণে রাশিয়ার পুরো অলিম্পিক দলকেই এবার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি বিশ্ব ডোপবিরোধী সংস্থাও (ডব্লিইএডিএ- ওয়াডা) অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (আইওসি) প্রতি একই আহ্বান জানিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আইওসি দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেবে। রাশিয়ার মতো আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি দল বাদ গেলে রিও অলিম্পিক আরও আকর্ষণ হারাবে। এটা ক্রীড়া বাণিজ্যেও বড় একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনটাই মনে করছেন বিশ্বের ক্রীড়া নেতৃবৃন্দ। তবে এরপরও রাশিয়া নিষিদ্ধ হওয়ার গুঞ্জনই শোনা যাচ্ছে। যে কোন আন্তর্জাতিক ক্রীড়াযজ্ঞে রাশিয়ার ক্রীড়াবিদরা বাড়তি আকর্ষণ। যোগ্যতা ও নৈপুণ্যের ক্ষেত্রেও অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে দারুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলে প্রতিযোগিতা মনোমুগ্ধকর করে তোলেন। আর যুগে যুগে রাশিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদরা। বিশ্ব ক্রীড়াকে সমৃদ্ধ ও মর্যাদাপূর্ণ রেকর্ডে ভরপুরও করেছেন তারা। সেই রাশিয়ার সব ক্রীড়াবিদ ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ আসন্ন অলিম্পিকে অংশ নিতে না পারলে ম্লান হয়ে যাবে রিও গেমসটি। অনেকাংশেই আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে এই মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতাটি। কানাডার আইনজীবী রিচার্ড ম্যাকলারেন তার তদন্ত প্রতিবেদনে রাশিয়ান এ্যাথলেটদের পুরো অলিম্পিকে অংশগ্রহণ থেকেই বিরত করার পরামর্শ রেখেছেন। কিন্তু ইউরোপের ক্রীড়া প্রধানরাও ম্যাকলারেনের প্রতিবেদনে বেশ ক্ষিপ্ত। ইউরোপিয়ান অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট প্যাট হিকি দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর আইওসি ও আইএএএফের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। তাই রাশিয়াকে ছাড়াই মর্যাদার এ অলিম্পিককে সার্থক ও সফলতম করার চ্যালেঞ্জটা অনেক বড় ব্রাজিলের জন্য। আরেকটি বড় অগ্নিপরীক্ষা ব্রাজিলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে। এর আগে কোন অলিম্পিকেই ছিল না আত্মঘাতী হামলার হুমকি। কিন্তু এবার সেই অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছে ব্রাজিলের রিও অলিম্পিক। বিশেষ করে ফ্রান্সের নিস শহরে সম্প্রতিই সন্ত্রাসবাদীদের আত্মঘাতী ট্রাক হামলায় ৮৪ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন। সন্ত্রাসবাদীরা এরপর দেশটির অলিম্পিক দলের ওপর প্রতিযোগিতা চলাকালীন সময়ে হামলার হুমকিও প্রদান করেছে। এমনটাই দাবি করেছে ফ্রান্সের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স। বিষয়টি তারা রিও অলিম্পিক আয়োজক কমিটিকেও জানিয়ে রেখেছে। এছাড়া বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন মাধ্যম থেকে উড়ো হুমকি এসেছে রিও অলিম্পিকে আত্মঘাতী হামলা করে আয়োজন প- করার। সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনা করে ব্রাজিল সরকার অলিম্পিকের সময় নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে যাচ্ছে। এমনটাই জানিয়েছে তারা। ব্রাজিলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট মাইকেল টেমার একটি জরুরী মিটিং করেন গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান ও মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের সঙ্গে। মূলত নিসে সন্ত্রাসবাদীদের হামলার পর করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতেই এ জরুরী সভা ডাকা হয়। প্রেসিডেন্ট টেমার মিটিং ত্যাগ করার পর গোয়েন্দা প্রধান সার্জিও ইচেগোয়েন জানান নতুন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে এবং বাড়তি কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে অলিম্পিক চলাকালীন চেক পয়েন্ট, ব্যারিকেড ও কড়াকড়ি আরও বাড়বে। ব্রাজিল ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা করেছে অলিম্পিকে নিরাপত্তা বিধানের জন্য ৮৫ হাজার নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েনের। এর মধ্যে ৪৭ হাজার পুলিশ ও ৩৮ হাজার সেনাসদস্য। সেটা আরও বাড়ানো হতে পারে বিপুল পরিমাণে। সবমিলিয়ে এবার অলিম্পিক নিয়ে বেশ টালমাটাল অবস্থায় আছে ব্রাজিল। এসব পরিস্থিতি উতরে সফলভাবে এবারের অলিম্পিক আকর্ষণীয় ও বর্ণাঢ্য করার ক্ষেত্রে রিও ডি জেনিরো শহর বেশ বড় ধরনের অগ্নিপরীক্ষার মধ্যেই আছে।
×