ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেজবাহ-শিরিনের মুখে স্বস্তির হাসি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২০ জুলাই ২০১৬

মেজবাহ-শিরিনের মুখে স্বস্তির হাসি

রুমেল খান ॥ আশার আকাশে ঘনীভূত হয়েছিল শঙ্কার মেঘ। সেই মেঘ কেটে গিয়ে অবশেষে দেখা দিয়েছে ঝলমলে সূর্যের আলোকিত হাসি। ১৯৮৪ সালের পর এই প্রথম ২০১৬ রিও অলিম্পিকে কোন বাংলাদেশী স্প্রিন্টারকে ছাড়াই বিমানে ওঠার ইতিহাস গড়তে যাচ্ছিল। কিন্তু অল্পের জন্য সেই অগৌরবের ইতিহাস গড়তে হয়নি বাংলাদেশ এ্যাথলেটিক ফেডারেশনকে। বড় বাঁচা বেঁচে গেল তারা। অবশেষে বিলম্বে হলেও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) বাংলাদেশের দুই এ্যাথলেট মেজবাহ আহমেদ ও শিরিন আক্তার ওয়াইল্ড কার্ড পাচ্ছেন বলে ই-মেইলে জানিয়েছে সোমবার দুপুর ১২টায়। কিন্তু তখনই এ্যাথলেটিক ফেডারেশন সেটা গণমাধ্যমকে জানায়নি। সেটা জানায় মধ্যরাতে। যাহোক, বহুল প্রত্যাশিত ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে রিও অলিম্পিকে খেলতে যাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে স্বস্তির হাসি হেসেছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুই তারকা স্প্রিন্টার এবং দেশর দ্রুততম মানব-মানবী মেজবাহ-শিরিন। শিনির নিজেও জানেন না, ফেডারেশন তার নাম জমা দিতে দেরি করেছিল। শুধু তাই নয়, পরে শিরিন আক্তারের নামের বানানে ‘আইরিন’ আক্তার লিখে সেই ভুল নামটিই জমা দেয়া হয়েছিল। পরে বিওএ ফেডারেশনকে ভুল নামের বিষয়টি অবহিত করে। অযোগ্য-অদক্ষ এ্যাথলেটিক ফেডারেশনের কর্মকর্তারা আবারও নামের সংশোধনী দিয়ে মেইল পাঠান। জনকণ্ঠকে দেয়া প্রতিক্রিয়ার শিরিন জানান, ‘যেদিন থেকে এ্যাথলেটিক্স খেলা শুরু করি, সেদিন থেকেই স্বপ্ন দেখেছি এর সর্বোচ্চ স্তরে যাওয়ার। সেই স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হতে চলেছে কাক্সিক্ষত ওয়াইল্ড কার্ড পাওয়ায়। খুবই আনন্দ লাগছে।’ যখন কার্ড না পাওয়ার শঙ্কা জেগেছিল, তখন সময়টা কেমন ছিল? ‘এক পর্যায়ে তো ধরেই নিয়েছিলাম রিওতে বুঝি যাওয়া হবে না। তারপরও ক্ষীণ হলেও আশা ছিল। যখন কার্ড পাওয়ার খবরটা শুনলাম, বিশ্বাসই হচ্ছিল না! তখন ঘুমাচ্ছিলাম। তাই মনে হচ্ছিল স্বপ্ন। খবরটা শোনার পর ইন্টারনেট ঘেঁটে পুরোপুরি নিশ্চিত হই। বাকি রাতটা আর ঘুমাতে পারিনি। আমার চেয়ে আমার পরিবার ও বন্ধুরাই বেশি খুশি।’ শঙ্কা তো কেটেছে। এখন লক্ষ্যটা কি? ‘নিজের সেরা ১১.৯৯ সেকেন্ড (২০১৬ এসএ গেমসে) টাইমিংটাকে ব্রেক করা। এছাড়া দেশকে উপস্থাপনা করা এবং ভাল খেলা।’ শিরিনের জবাব। তিনি আরও যোগ করেন, ‘ভবিষ্যত লক্ষ্য হচ্ছে ওয়াইল্ড কার্ড ছাড়া সরাসরিই যোগ্যতা অর্জন করে অলিম্পিকে যাওয়া। তবে সেজন্য প্রয়োজন কিছু কিছু বাস্তবায়ন করা। দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ এবং বেশি করে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট না খেললে পারফর্মেন্সের উন্নতি হবে না।’ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ভারত সফর করা ২২ বছর বয়সী শিরিনের বাড়ি সাতক্ষীরা। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ নিয়ে পড়ছেন দ্বিতীয় বর্ষে। নিজের প্রিয় এ্যাথলেট প্রসঙ্গে শিরিনের মন্তব্য, ‘গ্লাসগোতে যখন কমনওয়েলথ গেমস খেলতে যাই, তখন সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার প্রিয় স্প্রিন্টার শেলি-এ্যান ফ্রেজারের সঙ্গে। তার উচ্চতা, ওজন এবং শারীরিক গড়ন সব আমারই মতো। প্রায়ই ভাবি, শেলি যদি এই উচ্চতা নিয়ে সফল হতে পারেন, তাহলে আমি তার কাছাকাছি হলেও যেতে পারব না কেন? তিনি আজও আমার অনুপ্রেরণার উৎস।’ ‘রিওতে গিয়ে যখন ট্র্যাকে দৌড় শুরু করব, তখন এটাই আমার জীবনের শেষ দৌড় ... এমনটা ভেবেই জানবাজি লাগিয়ে দৌড়াব।’ শিরিনের শেষ কথা। ‘চারবারের দ্রুততম মানব হওয়ার পরও যদি অলিম্পিকে যেতে না পারি, এটা ভেবে টেনশনে ছিলাম। এখন টেনশন দূর হয়েছে। খুব ভাল লাগছে। আর খুশি এজন্যÑ ফুটবলে ব্রাজিলকে সাপোর্ট করি, সেই ব্রাজিলেই অলিম্পিক খেলতে যাব। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবাই খুব খুশি। জাতীয় হকি খেলোয়াড় মামুনুর রহমান চয়ন ভাইও ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।’ জনকণ্ঠকে দেয়া মেজবাহর প্রথম প্রতিক্রিয়া। অলিম্পিকে এবার ব্রাজিল ফুটবল দলের হয়ে খেলবেন তারকা ফুটবলার নেইমার। তার সঙ্গে যদি দেখা হয়? ‘তাহলে চেষ্টা করব অটোগ্রাফ নেয়ার এবং সেলফি তোলার।’ রিও অলিম্পিকে লক্ষ্য? ‘নিজের সেরা টাইমিংটাকে ছাড়িয়ে যাওয়া। এখন আমার সেরা টাইমিং ১০.৭২ সেকেন্ড। লক্ষ্য থাকবে ১০.৬৫ বা ১০.৭০ সেকেন্ডে উন্নীত করার।’ দেশের বাইরে এটা মেজবাহর ১৪ বা ১৫তম ট্যুর হবে। অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ্যাথলেটদের পার্থক্য প্রসঙ্গে তার বিশ্লেষণ, ‘আমাদের দেশের সঙ্গে বিদেশের এ্যাথলেটদের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ফিজিক্যালি এবং ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজে আমরা অনেক পিছিয়ে। এই ব্যবধান কমাতে হলে বেশি প্র্যাকটিস করতে হবে, বেশি করে ওয়েট ট্রেনিং, কন্ডিশনিং ট্রেনিং, নিউট্রিশন, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ... এগুলো করতে হবে।’ যদি দেশের বাইরে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ট্রেনিং নিতে পারি, তাহলে অবশ্যই উন্নতি করতে পারতাম।’ প্রস্তুতি প্রসঙ্গে মেজবাহ বলেন, ‘অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি চলছে সেই ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের পর থেকেই। যদিও লন্ডনে যেতে পারিনি। নিজেকে প্রস্তুত করে তুলছিলাম রিও অলিম্পিকের জন্য। প্রস্তুতি খুব ভাল।’ রিওতে জিকা ভাইরাস এবং সন্ত্রাসী হামলার হুমকি নিয়ে মেজবাহর উত্তর, ‘ওসব মোটেও উদ্বিগ্ন নই। ব্রাজিল সরকার আমাদের জন্য অনেক কঠিন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে রেখেছে।’ কিভাবে এই খেলায় আসলেন? ‘আমার রক্তে-মাংসেই আছে এ্যাথলেটিক্স। আমরা মা শাহিনা বেগম এবং মামা মনজুর ছিলেন এ্যাথলেট। তাদের দেখেই আমি এই খেলায় আসতে উদ্বুদ্ধ হই। তাদের দুটি স্বপ্ন আমি পূরণ করেছি। মামা চাইতেন আমি দ্রুততম মানব হই। আর মা চাইতেন আমি অলিম্পিকে খেলি। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার পথে।’ যথাসময়ে ওয়াইল্ড কার্ড না পাওয়ায় অলিম্পিক গেমসের এ্যাথলেটিক্সে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। অবশেষে শঙ্কা দূর হলো। সেখানে খেলতে ওয়াইল্ড কার্ড পেয়েছেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানব মেজবাহ আহমেদ ও দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার। গত ১৫ ছিল মেজবাহ ও শিরিনের জন্য ওয়াইল্ড কার্ড পাওয়ার শেষ সময়। কিন্তু সোমবার রাতে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) ওয়াইল্ড কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) মহাপরিচালক ফখরুদ্দিন হায়দার জানান, ‘ গতকাল রাতে তারা মেজবাহ ও শিরিনের ওয়াইল্ড কার্ড দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।’ জাতীয় এ্যাথলেটিক্সে মেজবাহ ও শিরিন টানা দ্বিতীয়বারের মতো ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সেরা। গত আসরে ১২.২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে সেরা হন শিরিন। আগের বার ১২.২৪ সেকেন্ড টাইমিং করে সোনা জিতেছিলেন তিনি। আর ছেলেদের ১০০ মিটারে সেরা হতে মেজবাহ সময় নেন ১০.৬০ সেকেন্ড। আগের সামার মিটে ১০.৪৩ সেকেন্ড টাইমিং করে সেরা হয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে লস এ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে স্প্রিন্টার সাইদুর রহমান ডন দেশের প্রথম প্রতিযোগী হিসেবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন। এরপর কুইন অব দ্য গেমস খ্যাত এ্যাথলেটিক্সে গত ৩২ বছরে অন্তত একটি করে ওয়াইল্ড কার্ড পেয়ে এসেছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালের লন্ডন গেমসে এ্যাথলেটিক্সে অংশ নিয়েছিলেন দেশের দ্রুততম মানব মোহন খান।
×