ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুন্নু ফেব্রিক্সের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের ১৪৩ কোটি টাকা গায়েব

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণের সুপারিশ সংসদীয় কমিটির

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২০ জুলাই ২০১৬

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণের সুপারিশ সংসদীয় কমিটির

সংসদ রিপোর্টার ॥ সোনালী ব্যাংকে নিয়মবহির্ভূত প্রকল্প ঋণ দেখিয়ে ‘মুন্নু ফেব্রিক্স’র মাধ্যমে গায়েব করে দেয়া হয়েছে ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এছাড়া প্লেজ ঋণের ঘাটতি মালের মূল্য নগদে আদায় ছাড়াই আসল ও সুদসহ বার বার ব্লক ঋণে রূপান্তর এবং প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট আদায় না করে পুনর্তফসিলীকরণ ও পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত ছাড়াই পুনরায় সিসি প্লেজ ঋণ নবায়ন করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এমনকি ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ সম্পদ ও মাল পরিচালনা বোর্ড বা উচ্চপদস্থদের না জানিয়ে গোপনে বিক্রি করে সেই অর্থ ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির ঋণ পুনর্তফসিল ও সুদ কার্যক্রমের ২০০৯-১০ অর্থবছরের হিসাবের ওপর বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের উপস্থাপিত বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে কমিটির পক্ষ থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, এ বিষয়ে দায়েরকৃত মামলার তদারকি জোরদার এবং অনধিক ৬০ দিনের মধ্যে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে অডিট অফিসের মাধ্যমে কমিটিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। কমিটির সভাপতি ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য মোঃ আবদুস শহীদ, মোহাম্মদ আমান উল্লাহ, পঞ্চানন বিশ্বাস, মোঃ আফসারুল আমীন, বেগম রেবেকা মমিন, মইন উদ্দীন খান বাদল, এ কে এম মাঈদুল ইসলাম ও ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজী এবং সিএন্ডএজি মাসুদ আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবিরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লেজ ঋণের ঘাটতি মালের মূল্য নগদে আদায় ছাড়াই আসল ও সুদসহ বার বার ব্লক ঋণে রূপান্তর করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট আদায় না করে পুনর্তফসিলীকরণ ও পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত গ্রহণ না করে পুনরায় সিসি প্লেজ ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের ৬১ কোটি ৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অমান্য করে যেসব কর্মকর্তা ঋণ পুনর্তফসিল করার সঙ্গে জড়িত তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ, ঋণ গ্রহীতার জমাকৃত অর্থ ব্যাংকের হিসাবে নগদায়ন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তত্ত্বাবধান জোরদার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যাতে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পুনরায় ঋণ গ্রহণ না করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি অবহিত করার সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে ব্যাংকের দায়বদ্ধ মাল ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই বিক্রি হয়েছে দাবি করে বলা হয়েছে, কারও অনুমতি ছাড়াই দায়বদ্ধ মাল বিক্রি এবং ঋণ হিসাবে জমা না করে ব্যাংকের ২০ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪৬ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। ব্যাংকের প্লেজ ঋণের দায়বদ্ধ মাল ব্যাংকের অগোচরে বিক্রি করা সত্ত্বেও এবং অনাদায়ী পিএসসি প্লেজ ঋণের টাকা আদায় না হওয়ার পরও ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলীকরণ ও নবায়ন করার মাধ্যমে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে ১১ কোটি ৬২ লাখ ৩৫ হাজার ১৮১ টাকা। এছাড়া স্টকলটকৃত মাল রফতানির মাধ্যমে সমন্বয়ের শর্ত আরোপ না করে মেয়াদী ঋণে পরিণত এবং ঘাটতি মালের মূল্য আদায় না করে পুনর্তফসিলীকরণ ও ঋণ পরিশোধের কিস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে ৭০ কোটি ২০ লাখ ২০ হাজার ৮১৩ টাকা এবং শাখা ব্যবস্থাপক ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে মেসার্স এইচ এস ফ্যাশন লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপন এবং মাল রফতানি না করে ঋণের টাকা অন্য খাতে বিনিয়োগ ও অনিয়মিতভাবে পুনর্তফসিলীকরণ সত্ত্বেও দায় আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকের আরও ৩৬ কোটি ৩০ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদনে বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, স্টকলটকৃত মালের মূল্য ঋণ হিসাবে জমাকরণে ব্যর্থ ও পুনর্তফসিলীকরণ কার্যকর না হওয়া সত্ত্বেও ডাউনপেমেন্ট আদায় না করে পুনর্তফসিলীকরণ করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ৩৭ কোটি ৪১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। পুনর্তফসিলীকরণ ও ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপনের সুবিধার প্রেক্ষিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি আমদানিকৃত মাল রফতানি না করায় ক্ষতি হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ ২ হাজার ৬৩৭ টাকা। রফতানি সামর্থ্য যাচাই না করে মেসার্স নাসের গার্মেন্টস ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপন এবং রফতানি ব্যর্থতাজনিত কারণে সৃষ্ট ফোর্সড লোনসহ প্রকল্প ঋণ, সিসি হাইপো ও এলটিআর ঋণের দায় আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৯৪ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩০ টাকা। এছাড়া পুনর্তফসিলীকরণ সত্ত্বেও প্রকল্প ঋণের নিয়মিত কিস্তির টাকা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পরও আমদানি এলসি স্থাপন করে আরও দায় সৃষ্টি এবং প্রকল্প বন্ধ থাকায় মেসার্স মুন্নু ফেব্রিক্সের ঋণ বাবদ ব্যাংকের ক্ষতি ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপনের মাধ্যমে আমদানিকৃত মাল রফতানি না করে গ্রাহক বিক্রি করে দেয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে পুনর্তফসিলীকরণসহ রফতানি ব্যবসার সুযোগ দেয়া হয়। এছাড়া পুনর্তফসিল সুবিধা আর প্রদান না করা ও ঋণের দায় পরিশোধের অঙ্গীকারনামা থাকা সত্ত্বেও পুনর্র্তফসিলীকরণের শর্ত লঙ্ঘন করে অনিয়মিতভাবে একাধিকবার পুনর্তফসিলীকরণের সুবিধা অনুমোদন করায় এবং খেলাপী ঋণ আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে ব্যাংকের ১৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫৩ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
×