ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর ২২শ’ অবৈধ প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২০ জুলাই ২০১৬

রাজধানীর ২২শ’ অবৈধ প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ

মশিউর রহমান খান ॥ নিয়ম ভেঙ্গে ও অনুমতি না নিয়ে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়ে ২২ শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে চিঠি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। আগামী সাত দিনের মধ্যে এসব অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নোটিসে বলা হয়েছে। রাজধানীর ধানম-ি, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর মিরপুরসহ সকল আবাসিক এলাকায় জরিপ করে এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। ডিএনসিসি’র আওতাধীন আবাসিক এলাকায় পাঁচ সহস্রাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ডিএনসিসি প্রায় ১১শ’ প্রতিষ্ঠানকে বর্তমানের স্থান থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নিতে চিঠি প্রদান করেছে। ডিএসসিসি মঙ্গলবার পর্যন্ত এক হাজার ১শ’ ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি প্রদান করেছে। দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষই প্রতিদিনই এসব নোটিস প্রদান করছে। এর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানা গেছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ভবনগুলোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে দুই সিটি কর্পোরেশন। তালিকা অনুযায়ী ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ৬ হাজার ৫৬টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে দক্ষিণে ৭শ’ ১৫টি এবং উত্তরে ৫ হাজার ৩৪১টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আবাসিক এলাকায় হলেও এর মধ্যে আবার ৪শ’ ৫৯টি প্রতিষ্ঠান রাজউকের কাছ থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। বাকি ৪ হাজার ৮৮২টি প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বেআইনীভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ডিএনসিসির ১ নম্বর জোন উত্তরা আবাসিক এলাকায় ৯শ‘ ৩৫টি, ২ নম্বর জোন মিরপুর (১ নম্বর) এ ৯শ’ ১৯, ৩ নম্বর জোন গুলশানে ৮শ’ ৩০, ৪ নম্বর জোন মিরপুর (২ নম্বর) এ ৬শ’ ৭৩ এবং ৫ নম্বর জোন কাওরান বাজারের আবাসিক এলাকায় ১ হাজার ৫শ’ ২৫টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ডিএনসিসি তালিকা তৈরির পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ওই তালিকা পাঠায়। এ তালিকা অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে গত ৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভায় তা উত্থাপিত হয়। মন্ত্রিসভায় আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে আগামী ৬ মাসের মধ্যেই তালিকার করা সকল স্থাপনা সরিয়ে নিতে কার্যক্রম শুরু করে দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, এ সিদ্ধান্তের পরই ভবন ও প্রতিষ্ঠান মালিকদের নোটিস ইস্যুর কাজ শুরু করে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠান রাজউক অনুমোদিত কমার্শিয়াল এলাকার ঠিকানায় ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ট্রেড লাইসেন্স বিধি ভঙ্গ করে সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকায় ব্যবসা খুলে বসেছেন। তাদের বিরুদ্ধেও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে জানা গেছে। সিটি কর্পোরেশনের ব্যবসা সরানোর নোটিস পেয়েছেন ধানম-ি ১৫ নম্বর এলাকার শগিদুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আমাদের আগামী সাত দিনের মধ্যে অন্যত্র ব্যবসা সরিয়ে নিতে চিঠি প্রদান করেছে। তবে এত কম সময়ের মধ্যে ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া অনেকটা অসম্ভব বটে। নোটিস দেয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফুটপাথের ওপর গড়ে তোলা দোকান থেকে শুরু করে বহুতল বিশিষ্ট ভবনের মধ্যে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে যেগুলোর মালিকগণ সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কোন প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, বিউটি পার্লার, আবাসিক হোটেল, রেস্তরাঁ, ক্লাব, স্কুল, কলেজসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান কোন প্রকার ট্রেড লাইসেন্স নেননি। ফলে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষও নিয়মিত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ডিএনসিসি এসব নোটিস গত রমজানের শুরু থেকে প্রদান করা শুরু করেছে। অপরদিকে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ ঈদের পর থেকে নোটিস প্রদান শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিএসসিসি আওতাধীন এলাকায় মাত্র ৩টি আবাসিক এলাকা রয়েছে। এর বাইরে অনেক এলাকায়ই বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে ডিএনসিসি এলাকায় আবাসিক এলাকা বেশি। সূত্র জানায়, ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের করা জরিপ অনুযায়ী দেয়া ১ হাজার ১শ’ ৩৭টি নোটিসই ধানম-ি আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে। এর বাইরে অপর ছোট দুটি আবাসিক এলাকায় কয়েকদিন পরে নোটিস প্রদান শুরু করবে। জানা গেছে, ধানম-ি এলাকায় আরও নোটিস প্রদান করবে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে ডিএনসিসি আওতাধীন রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত রাজউকের নির্ধারিত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায়ই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯শ’ নোটিস প্রদান করেছে। যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এর মধ্যে ৭৭টি নামীদামী দেশী-বিদেশী রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বার ও ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। বাকি সব আবাসিক এলাকায় প্রায় ২ শতাধিক নোটিস প্রদান করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে। মূলত গত ৪ এপ্রিল আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে দেয়া হবে মন্ত্রিসভার এমন সিদ্ধান্তের পর ৬ মাসের মধ্যে নিজ থেকে গুটিয়ে নেয়ার জন্য আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিস দেয়ার কাজ শুরু করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এর বাইরে সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলার পর এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সূত্র জানায়, রাজউকের ৮টি জোনের মধ্যে গুলশান এ্যাভিনিউর শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান-২ এর গোলচত্বর, মাদানি ও কামাল আতাতুর্ক এ্যাভিনিউর গুলশান-বনানী ব্রিজ থেকে গুলশান-বারিধারা ব্রিজ পর্যন্ত ও বনানী-১১ নম্বর রোড এবং গুলশানের সঙ্গে তেজগাঁও সংযোগ সড়কের কিছু অংশ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। এসব স্থানেই কেবল ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবেন। আর সিটি কর্পোরেশনও এসব জোনের যে কোন স্থাপনায় ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করে থাকেন। এছাড়া ডিএনসিসির আওতাধীন কূটনৈতিক জোন হিসেবে খ্যাত গুলশান-বনানী-বারিধারার বাকি পুরো অংশই আবাসিক এলাকা। এসব এলাকায় আবাসিকের চরিত্র হারিয়েছে অনেক আগেই। সরকারের উচ্চমহলের নির্দেশে এবার তৎপর হয়েছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। ডিএনসিসি’র হিসাবে সংস্থাটির ৩ নম্বর জোন গুলশান, বনানী, বারিধারা, খিলগাঁও এবং মালিবাগের আবাসিক এলাকায় ৮৩০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বার ও ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে ১০৫টি। খিলগাঁও এবং মালিবাগের ৮ প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে বাকি ৯৭টি প্রতিষ্ঠানই গুলশান-বনানী-বারিধারায়। এর মধ্যে রাজউকের অনুমোদিত বাণিজ্যিক এলাকায় রয়েছে মাত্র ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৭৭টি নামীদামী দেশী-বিদেশী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই গুলশান-বনানী-বারিধারার আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। এসব প্রতিষ্ঠানকেই ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ ব্যবসা গুটিয়ে নিতে নোটিস প্রদান করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা উপসচিব গোলাম মোস্তফা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ডিএসসিসি আওতাধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঘোষিত আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে তোলা সকল বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার বিরোধী। সরকারের নির্দেশে ২০০৭ সালের আগস্ট মাস থেকে আবাসিক এলাকায় সকল প্রকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বন্ধের জন্য ট্রেড লাইসেন্স প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছে। এর বাইরে ডিএসসিসি কর্তৃক জরিপের মাধ্যমে আমরা যেসব প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করছে তার একটি তালিকা তৈরি করেছি। এসব প্রতিষ্ঠানকে কোনক্রমেই অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য অনুমতি প্রদান করা হবে না। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল অবৈধ বাণিজ্যিক স্থাপনা আগামী ৭ দিনের মধ্যেই সরিয়ে নিতে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ পর্যন্ত এক হাজার ১ শ৩৭টি নোটিস প্রদান করেছি। তবে শুধু ধানম-ি আবাসিক এলাকায় এসব নোটিস দেয়া হয়েছে। তবে এর সংখ্যা আরও বাড়বে। এরপর আমরা খিলগাঁওসহ অন্য আবাসিক এলাকায়ই এসব নোটিস প্রদান করব। প্রতিদিনই আমরা এসব নোটিস প্রদান করছি। নোটিস পাওয়ার পরও এসব অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা বন্ধ না করলে না সরালে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে অবৈধ সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে।
×