ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এসএসএফের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন চাই

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২০ জুলাই ২০১৬

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন চাই

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের শক্তিকেই মূলশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের মোকাবেলায় সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রের সকল নিরাপত্তা বাহিনীকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শিতা অর্জনের তাগিদ দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এটার জন্য যা যা প্রয়োজন অবশ্যই সরকার তা করবে। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মকে কোনমতেই অসম্মানিত হতে দিতে পারি না। যাদের কারণে এগুলো হচ্ছে, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা লক্ষ্য করছি যে-সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এর ধরন পাল্টেছে, বদলেছে। যে কারণে আমি প্রত্যেক বাহিনীকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি এই অশুভ শক্তিকে দমনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের আহ্বান জানাব। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। অনুষ্ঠানে এসএসএফ’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ শফিকুর রহমান স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মোঃ আবুল কালাম আজাদ এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মের দোহাই দিয়ে মেধাবী তরুণদের উগ্র জঙ্গীবাদে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। জড়িতদের চিহ্নিত করে এর মূলোৎপাটন করা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন কিছু সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের ঘটনা ঘটেছে যা সত্যই ঘৃণিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার এক দিকে যেমন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে, অপরদিকে ধ্বংসাত্মক কাজে এগুলোর ব্যবহার মানুষের জীবনমানকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তবে এ ধরনের ঘটনা যে শুধু বাংলাদেশেই ঘটছে তা নয়, উন্নত বিশ্বেও ঘটে চলেছে। এগুলো সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমি চাই বাংলাদেশ কোন ক্ষেত্রেই যেন পিছিয়ে না থাকে, আমরা প্রত্যেক বাহিনীকেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেব। প্রধানমন্ত্রী জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, আমরা জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন ঘটনাবলীর তদন্ত করে এসব ঘটনায় সম্পৃক্তদের গ্রেফতার করছি। তবে এই সামাজিক ব্যাধি দূরীকরণে এটুকুই যথেষ্ট নয়, আমাদের এই দুই অপশক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী চেতনাকে জাগ্রত করে এ বিষয়ে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন করে তুলতে হবে। নিজেদের সন্তানদের বিপথে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য পিতা-মাতা, অভিভাবকদের সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের সন্তানরা কি করে, কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে- এসব বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রত্যেক পিতা-মাতা ও অভিভাবকের দায়িত্ব। যাতে করে তারা কোন ভুল পথে পা না বাড়াতে পারে। সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের একাংশ যাদের পরিবার তাদের কোনই অভাব-অভিযোগ অপূরণীয় রাখেনি -তারাই এই পথে পা বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেখা যাচ্ছে তাদের কোন একটা চাওয়া-পাওয়ার অপূর্ণতাও তাদের মানসিক যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি তাদের জন্য পিতা-মাতাকে আলাদা সময় বের করা এবং সন্তানদের জন্য সময় ব্যয় করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের সন্তানের সবরকম ভাল-মন্দের দিকে নজর রাখবেন এবং ধর্মের প্রকৃত শিক্ষায় যেন তারা শিক্ষিত হতে পারে- সেই ব্যবস্থা করবেন। প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর গুলশানের একটি রেস্তরাঁ এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে জঙ্গী হামলার পাশাপাশি সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত গুপ্তহত্যার জন্য যুদ্ধাপরাধী এবং দেশের উন্নয়নবিরোধী অপশক্তি জড়িত বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি-এসব ঘটনার ষড়যন্ত্রকারীরা কোনভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাঙালী জাতির উন্নয়ন প্রত্যাশী নয় এবং তারা কোনভাবেই বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের অন্যদেশের প্রশংসাবাক্য শুনতেও আগ্রহী নয়। যে কারণে তারা এই জঘন্য হামলা সংঘটিত করেছে। তাছাড়া বিশ্ব সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদও এ সময় একইসঙ্গে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। পবিত্র ও শান্তির ধর্ম ইসলামকে কেউ যেন কলুষিত করতে না পারে তা প্রতিরোধে তাঁর সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, এসব নৃশংস কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণ করবে। পাশাপাশি এজন্য আন্তর্জাতিক মহলের আরও সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ আজ এই ধর্মকে বিভিন্নভাবে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এটা ইসলামের মূল চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখজনক। ধর্মের নামে ধর্মান্ধতার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ধর্মের মূল বাণীটা যেন সঠিকভাবে শিখতে পারে সে ব্যবস্থাটা নেয়া উচিত। এটা প্রতিটি ধর্মের ক্ষেত্রেই হওয়া উচিত। প্রতিটি ধর্মেই শান্তির বাণী বলা আছে’। তিনি বলেন, ‘ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই। তিনি বলেন, ‘মানুষ খুন করে বেহেশতে চলে যাবে! বেহেশতে গিয়ে হুর-পরী পাবে! এগুলো কোন যৌক্তিক কথা না। এটা ধর্মের কথা না, কোরান শরীফের কথা না, আমাদের নবীর নির্দেশও না’। প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ জুলাই থেকে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী ১১তম এশিয়া-ইউরো সম্মেলনে (আসেম) প্রদত্ত বক্তৃতাতেও সন্ত্রাস এবং উগ্রচরমপন্থার শেকড় খুঁজে বের করার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘এদের অর্থের যোগান কে দেয়, অস্ত্র দেয়, প্রশিক্ষণ দেয় এবং কারা এই যুবকদের মন্ত্রণা দিয়ে মানসিকভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে ধর্মীয় উগ্রবাদের বীজ রোপণ করছে- তা খুঁজে বের করার জন্যও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।’ এসএসএফ সদস্যদের কর্মকা-ের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ফোর্স তাদের অন্তর্ভুক্তিকাল থেকেই উচ্চ মানসিক শক্তি, সর্বোচ্চ আনুগত্য এবং সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এসএসএফ কর্মকর্তারা যেভাবে তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব বিগত ৩০ বছর যাবত অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন সেভাবেই আগামীর দিনগুলোতেও তারা দায়িত্ব পালন করে যাবেন। এই বাহিনীর উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকা- সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য সরকার এর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যেসব পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছে। আর সেগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার জন্যও তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় এসএসএফ সদস্যদের নিজেদের ও পরিবার-পরিজন থাকার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনাদেরও সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে পেশাগত দায়বদ্ধতা। কাজেই পরিবারের সদস্যদের প্রতিও যতœবান হবেন বলেই আশা করি।
×