ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

নেতায় নেতায় ঐক্য দ্বারা জাতীয় ঐক্য গড়া সম্ভব কি?

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২০ জুলাই ২০১৬

নেতায় নেতায় ঐক্য দ্বারা জাতীয় ঐক্য গড়া সম্ভব কি?

বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার রব উঠেছে। রবটা বেশি তুলছে বিএনপি। ঐক্যের জন্য নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই এই রবটা বিএনপি তুলেছে বলে আমার মনে হয়। বিএনপি এখন দেশের রাজনীতির ঘরে-বাইরে কোথাও নেই। তারা গত সাধারণ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ভুলের খেসারত দিচ্ছে। সংসদে তারা নেই। সংসদের বাইরে জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আন্দোলনের নামে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারার সন্ত্রাস চালিয়েও কোন লাভ হয়নি। বরং দলটি গণবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন বাঘ তাই মোষ সেজে সন্ত্রাস দমনের নামে ঐক্য চাই, ঐক্য চাই বলে চিৎকার জুড়েছে। যদি সন্ত্রাস দমনে ঐক্যের সংলাপে সরকারী দল তাদের ডাকে তাহলে বিএনপি আবার রাজনীতির পাতে উঠতে পারে। তাতে সন্ত্রাস দমন না হোক, বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা পাবে। সে জাতে উঠবে। এই সত্যটা বিএনপির পোঁ ধরা বুদ্ধিজীবীরাও এখন বুঝতে পারছেন। তাই তারা জাতীয় ঐক্যের ধুয়া তোলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নেত্রীর কাছে জামায়াতের সংশ্রব ত্যাগেরও আবেদন জানাচ্ছেন। এমন যে বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবী ডাঃ জাফরুল্লা, তিনিও ভাসানী অনুসারীদের মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানাচ্ছেন, তিনি যেন সন্ত্রাসবিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই ডাকটি তিনি তার পছন্দের নেত্রী খালেদা জিয়াকে দেননি। মঙ্গোলিয়া সফর শেষে ঢাকায় ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য ইতোমধ্যেই সৃষ্টি হয়ে গেছে।’ সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে ঐক্যের প্রস্তাব তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার এই দৃঢ় ভূমিকা আমাকে স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দেশের পূর্বাংশে (বাংলাদেশে) নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দল কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, মুসলিম লীগ, জামায়াত প্রভৃতি একটি আসনও পায়নি। নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগের কাছে সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা। তারা তা না করে ক্ষমতা ধরে রাখার ষড়যন্ত্র করে। সামরিক শাসনের অবসান এবং বাঙালীর স্বাধিকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। মুসলিম লীগ, জামায়াত প্রভৃতি দল আওয়ামী লীগের স্বাধিকার আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানায় তিনি যেন তাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের সংলাপে বসেন এবং এই ঐক্যের ভিত্তিতে আন্দোলনে নামেন। তাহলেই মাত্র আন্দোলন সফল হতে পারে। এই তথাকথিত ঐক্যের ডাকের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি নেতায় নেতায় ঐক্য চাই না, চাই জনতার ঐক্য। নেতায় নেতায় ঐক্য হলে তার পরিণতি কি হয় তা আমরা ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে দেখেছি। সেই ভুল আর করব না। এবার চাই জনতার ঐক্য। বাংলার স্বাধিকারের প্রশ্নে একমাত্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছাড়া দলমত নির্বিশেষে বাংলার মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। জনতার এই ঐক্যই জাতীয় ঐক্য। এই ঐক্যই আমাদের শক্তি। এই শক্তির বলেই আমরা সংগ্রামে জয়যুক্ত হবো।” স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হামলা শুরু হতেই স্বাধীনতাকামী সিপিবি, ন্যাপ প্রভৃতি দল কোন সংলাপে বসা ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়, এমনকি তখন পিকিংপন্থী বলে পরিচিত ন্যাপের অপর অংশের নেতা মওলানা ভাসানীও তার দলের নেতাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টাম-লীর সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দল পাকিস্তানের হানাদারদের সঙ্গে হাত মেলায়। তাদের দেশদ্রোহিতা বাঙালীর সার্বিক জাতীয় ঐক্যকে ব্যাহত করতে পারেনি। বাংলাদেশে আজ একাত্তর সালের মতো পরিস্থিতি আবার দেখা দিয়েছে। দেশ আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। জাতি যুদ্ধরত। এবারের হানাদারেরা ‘ইসলামী জঙ্গী’ নামে পরিচিত হলেও একাত্তর সালের পাকিস্তানী হানাদারদের উত্তরাধিকারও বহন করছে। এবং একাত্তর সালের ঘাতকদের মতোই এদের পেট্রন জামায়াত। গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক দলগুলোর অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে। জামায়াত বর্তমান যুদ্ধেও শত্রুপক্ষ। কিন্তু বিএনপির অবস্থানটা কোথায়? তার কি অবস্থান ’৭১ সালের মুসলিম লীগের মতো? বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের সঙ্গে তার স্থায়ী মৈত্রী তো তাকে ’৭১ সালের মুসলিম লীগের চাইতেও ভয়ঙ্কর অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ’৭১ সালে বাংলাদেশের দলমত নির্বিশেষে মানুষ যেমন চেয়েছে হানাদারদের পরাজয় এবং সেজন্য আওয়ামী লীগের ডাকের অপেক্ষা না করেই দলটির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, বর্তমানেও তেমনি একমাত্র সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকেরা ছাড়া দেশের দলমত নির্বিশেষে মানুষ চায় এই বর্বর সন্ত্রাসের অবসান। সেজন্য তারা কোন্ সরকার ক্ষমতায় আছে তার বাছবিচার না করে এই সরকারের নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিএনপি গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক দল হলে তার উচিত ঐক্য চাই ঐক্য চাই বলে অনাবশ্যক চিৎকার না জুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে জাতির পাশে এসে দাঁড়ানো। এই যুদ্ধে নিজস্ব কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নেমে পড়া এবং সন্ত্রাস দমনের জন্য সরকার গ্রাম পর্যায়ে যে কম্যান্ডো গঠন করতে যাচ্ছে তাতে বিএনপি ও ছাত্রদলের কর্মীদের যোগ দিতে নির্দেশ দেয়া। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা গঠিত ন্যাশনাল ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিল। কোন সংলাপের জন্য অপেক্ষা করেনি। বলেছিল এটা জনযুদ্ধ (চবড়ঢ়ষব’ং ধিৎ)। বাংলাদেশেও বর্তমানের যুদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের একার যুদ্ধ নয়। এটা বর্বর সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে যোগ দিতে বিএনপিকে বা তার সমমনা দলগুলোকে সরকারের ডাকের অপেক্ষা করতে হবে কেন? তাদের সঙ্গে সংলাপে বসার শর্ত দিতে হবে কেন? যুদ্ধরত এবং বিপন্ন জাতিকে রক্ষা করার কাজে বিএনপি’র কি কোন দায়িত্ব নেই? এটা কি দর কষাকষির সময়, না যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়? আগে জাতি সঙ্কটমুক্ত হোক, তারপর জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংলাপে বসা যেতে পারে। কিন্তু সর্বাগ্রে বিএনপি’র উচিত সন্ত্রাস দমনের যুদ্ধে যুক্ত হতে হলে সন্ত্রাসী দল জামায়াতের সঙ্গে সর্বপ্রকার সংশ্রব বর্জনের প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া। শুধু ঘোষণা দেয়া নয়, জামায়াতের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মাঠে নেমে আসা। নইলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত থাকার কালিমা মুছে বিএনপি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিবে কিভাবে? এই যুদ্ধে যোগ দেয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা তাদের কোথায়? আগে এই বিশ্বাসযোগ্যতা তাদের অর্জন করতে হবে। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারের নেতারা সংলাপে বসলেই তথাকথিত জাতীয় ঐক্য গঠিত হবে বা সন্ত্রাস দূর হবে এমনটা আশা করা হাস্যকর। জামায়াত এখনও বিএনপি’র ঘাড়ে ভর করে আছে। বিএনপি’র নির্দেশে চালিত হয় না। তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তারা সন্ত্রাস বন্ধ করবে না। কখনও তালেবান, কখনও আইএস পরিচয়ে তারা সন্ত্রাস চালাতে চাইবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার তাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত না করে। বিএনপি যে এই সন্ত্রাস দমনের কাজে সরকারের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য গড়ার নামে সংলাপে বসতে চাইছে, এটা তাদের আরেক রাজনৈতিক কৌশল। রাজপথে সন্ত্রাস সৃষ্টি দ্বারা সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে না পেরে এখন সংলাপে বসে একই উদ্দেশ্য হাসিলের কৌশল গ্রহণ করেছে। আমি বিএনপির কয়েকজন পাতি নেতার সঙ্গে আলাপে বুঝেছি, আওয়ামী লীগ সংলাপে বসলেই তারা দাবি তুলবে, সন্ত্রাস দমনের স্বার্থে অবিলম্বে নির্বাচন দেয়া হোক। তাদের যুক্তি, দেশের বর্তমান সরকার সঠিকভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার নয়। গণতান্ত্রিক সরকারের অনুপস্থিতিতেই দেশে সন্ত্রাস বাড়ছে। আমেরিকা ও ফ্রান্সে তো সঠিকভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার আছে, তাহলে সন্ত্রাস বাড়ছে কেন এই প্রশ্নের জবাব বিএনপি নেতারা দেন না। তাদের লক্ষ্য সন্ত্রাস দমন নয়, লক্ষ্য যে কোন উপায়ে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানো। সুতরাং সন্ত্রাস দমন ও জাতীয় ঐক্য গড়ার নামে আলোচনায় মূল ইস্যু হবে অবিলম্বে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই পুরনো ইস্যু তুলে সংলাপ দীর্ঘায়িত করা হবে। সরকারের দৃষ্টি সন্ত্রাস দমনের দিক থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া হবে। তার সুযোগে সন্ত্রাস অব্যাহত থাকবে। সংলাপ এবং সন্ত্রাস এই দুয়ের সহযোগে চাপ সৃষ্টি করে বিএনপি চাইবে সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। জাতীয় ঐক্য হবে তখন বলির পাঁঠা। আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন। এই নেতায় নেতায় ঐক্য দ্বারা জাতীয় ঐক্য গঠন হবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও জয়লাভ করা যাবে না। এই যুদ্ধে জয়লাভের জন্য জনতার ঐক্য গড়ে তোলাই হবে হাসিনা সরকারের জন্য একমাত্র পথ। শেখ হাসিনা যদি মনে করেন এই জনতার ঐক্য বা জাতীয় ঐক্য ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে তাহলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তাকে দ্বিধাহীনভাবে কাজে লাগান। শহরের মহল্লায় মহল্লায়, পল্লীর প্রত্যেকটি এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী যুব কম্যান্ড গঠনের ব্যবস্থা করুন। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করুন। সন্দেহভাজনদের বিনা দ্বিধায় গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করুন। সেজন্য প্রয়োজন হলে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হোক। সন্ত্রাসবিরোধী জনমত গঠনের জন্য মিডিয়াগুলোর সহযোগিতা আরও ভালভাবে নেয়া হোক। এক কথায় নেতায় নেতায় ঐক্য নয়, জনতার ঐক্যকে ভিত্তি করে হাসিনা সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। একাত্তরের যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মানুষের জয়লাভের মতো এবারের যুদ্ধেও হাসিনার নেতৃত্বে বাংলার জনযুদ্ধের জয় হবে। লন্ডন, ১৯ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০১৬ ॥
×