ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তে কড়া সতর্কতা, ভারতে মাদ্রাসার ওপর নজরদারি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৯ জুলাই ২০১৬

সীমান্তে কড়া সতর্কতা, ভারতে মাদ্রাসার ওপর নজরদারি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কড়া নজরদারি চলছে। ঢাকা ও বিভাগীয় শহর ছাড়াও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে চলছে বিশেষ অভিযান। কড়া নজরদারিতে রয়েছে ভারতে থাকা মাদ্রাসাগুলো। মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যাই বেশি। সন্দেহভাজন বাংলাদেশী ছাত্র ও শিক্ষকদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। শুধু সন্দেহভাজন ছাত্র-শিক্ষক নয়, তাদের কাছে এবং ভারতের মাদ্রাসাগুলোতে ঘন ঘন যাতায়াতকারী বাংলাদেশেীদের সম্পর্কেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজনদের বিষয়ে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে দুই দেশের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই ভারতে থাকা মাদ্রাসাগুলোর ওপর বিশেষ নজরদারি চলে আসছে। বিভিন্ন সময় ভারতের রাজনৈতিক দলের নেতারাও এসব বিষয়ে কথা বলেছেন, যা বিভিন্ন সময় সে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিতও হয়েছে। গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে হামলায় ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে জঙ্গীরা। ওই হামলায় নিহত বিদেশীদের মধ্যে একজন ভারতীয়ও রয়েছেন। ইতোপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা এবং সর্বশেষ গুলশানে জঙ্গী হামলার পর ভারতজুড়ে বিষয়টি নিয়ে আবার জোরালো আলোচনা চলছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গুলশানের ঘটনার পর অত্যন্ত যৌক্তিক এবং ভৌগলিক কারণেই ভারত বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশী তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ নানাভাবে সহযোগিতা করছে। এসব দেশের মধ্যে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে। সর্বক্ষণিক যোগাযোগের সূত্র ধরে অনেক বিষয়ই সামনে চলে এসেছে। সূত্রটি বলছে, বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ভারতে থাকা মাদ্রাসাগুলোতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্রদের বিষয়টিও চলে এসেছে। যদিও বাংলাদেশী সব ছাত্র বা শিক্ষকের প্রসঙ্গ আসেনি। সন্দেহভাজন কিছু ছাত্র ও শিক্ষকের প্রসঙ্গ এসেছে মাত্র। এছাড়া এসব সন্দেহভাজন মাদ্রাসাছাত্র ও শিক্ষকের কাছে যারা ঘন ঘন যাতায়াত করেন বা যোগাযোগ রাখেন তাদের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। সন্দেহভাজন বাংলাদেশী ছাত্রদের সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যাই বেশি। এসব ছাত্র, শিক্ষক ও এদের সঙ্গে যোগাযোগকারীদের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুধু সন্দেহভাজন বাংলাদেশী নয়, ভারতের মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত সন্দেহভাজন কিছু পাকিস্তানী ছাত্র ও শিক্ষকের প্রসঙ্গও এসেছে। যদিও তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশের কাছে কোন তথ্য চাওয়া হয়নি। তবে সন্দেহভাজন পাকিস্তানী ওই সব ছাত্র ও শিক্ষক যাতে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ভারতের মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত ছাত্র ও অন্যদের বেশিরভাগই সীমান্তপথে ভারত যাতায়াত করে থাকেন। গুলশান হামলার পর তাদের যাতায়াতের বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে দুই দেশই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। সূত্র বলছে, কলকাতার খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর থেকেই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আরও বেশি সতর্ক। গুলশানের ঘটনার পর সে সতর্কতা আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। সতর্ক থাকার পাশাপাশি দুই দেশই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে জঙ্গী, সন্ত্রাসী, চোরাচালানসহ নানা বিষয়ে সর্বক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান অব্যাহত রাখতে বলেছে। হালে তথ্য আদান-প্রদান আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে। প্রায়ই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ে এ বিষয়ে যোগাযোগও হচ্ছে। ২০১৪ সালের আগস্টে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সৌমিক ভট্টাচার্য এক জনসভায় পিলে চমকানোর মতো বক্তব্য দেন, যা ওই সময় ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। বক্তব্যে তিনি নারীদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ আপনারা যে কোন সময় হামলার শিকার হতে পারেন। আক্রমণকারীরা বাইরে থেকে আসতে পারে। এজন্য প্রয়োজনে আপনারা আপনাদের রান্নাঘরের ছুরি পর্যন্ত প্রস্তুত রাখুন। আচমকা নারীদের উদ্দেশ করে খুবই নাটকীয়ভাবে এমন বক্তব্য দিলে উপস্থিত নারীরা অবাক হয়ে যান। নারীরা এমন বক্তব্যের কারণ জানতে চান। এর পর সৌমিক ভট্টাচার্য কলকাতা রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের বরাত দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের নামে বহু উগ্র মৌলবাদী সংগঠন রয়েছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান সে দেশের সরকারের কাছেও নেই। বেসরকারী মাদ্রাসাগুলো উগ্র মৌলবাদী সংগঠনগুলির প্রধান আস্তানা। মাদ্রাসাগুলো উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী সৃষ্টির ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও এসব উগ্র মৌলবাদীর তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। তাদের পক্ষে যে কোন সময় সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে হামলা চালানোর চেষ্টা করাও বিচিত্র নয়। এজন্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা অতি জরুরী। সৌমিক ভট্টাচার্য আরও বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারী মাদ্রাসাগুলোতে খুবই খোলামেলাভাবে ইসলামের নামে উগ্র মৌলবাদীদের আশ্রয় দেয়া হয়। এতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করলে এর বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। তারপরও বাংলাদেশে ইসলামের নামে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের প্রভাব কমেনি। এমনকি কলকাতাতেও বাংলাদেশী উগ্র মৌলবাদীদের তৎপরতা আছে। তৃণমূল কংগ্রেস এসব বিষয়ে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের দুই হাজার ২১৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যাতায়াত আছে। এসব সীমান্তপথে অন্যদের মতো উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরাও যাতায়াত করে। প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ ম-লের বরাত দিয়ে বলা হয়, জামায়াত ও রাজাকার পাকিস্তানপন্থী। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকেই সক্রিয়। এ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। সাম্প্রতিককালে এসব গোষ্ঠী আরও বেশি তৎপর। পুলিশের তদন্তে দেখো গেছে, লালগোলা, রানীতলা এবং জলঙ্গী এলাকার মাদ্রাসাগুলো পাকিস্তানভিত্তিক জমিয়তে আহলে হাদিস মতাদর্শে বিশ্বাসী। এ সংগঠনটি দ্বারা প্রভাবিত। এসব মাদ্রাসায় বাংলাদেশের অনেক নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনেরও প্রভাব আছে। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, প্রায়ই সন্দেহভাজন, অচেনা মানুষদের জলঙ্গী, রানীনগর, ধুমকল, শমসেরগঞ্জ ও লালগোলায় সন্দেহজনক ঘোরাফেরা ও অবস্থান করতে দেখা যায়। তাদের পরনে অনেকটা জঙ্গীদের পরনে যে ধরনের পোশাক থাকে তেমন পোশাক থাকে। এমন পোশাকের মধ্যে খাটো পায়জামা, পাঞ্জাবি, ছোট টুপি, লম্বা কুর্তা ও পায়ে রাবারের স্যান্ডেল দেখা যায়। দেখে বোঝা যায়, অনেকেই বাংলাদেশের নাগরিক। এসব নাগরিক আবার বিশেষ বিশেষ দল বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আশ্রয়ে থাকে, যারা পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন। এদের অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমিতি বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে সশস্ত্র ট্রেনিংয়ে অংশ নেয় বলে শারীরিক কাঠামো পর্যালোচনায় আন্দাজ করা যায়। মুর্শিদাবাদের ২৫৪টি পঞ্চায়েতের প্রতিটিতে সরকার অনুমোদিত তিন থেকে পাঁচটি মাদ্রাসা আছে। এসব মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ অধিকাংশ বাংলাদেশী ইসলামী উগ্র মৌলবাদীদের হাতে। ভারতে পড়াশোনারত বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র সাধারণত সীমান্ত দিয়েই যাতায়াত করে। এজন্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। এদের সীমান্ত এলাকা বা সীমান্তের পার্শ্ববর্তী এলাকায় জড়ো হয়ে বড় ধরনের নাশকতা চালানোও বিচিত্র নয়।
×