ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১৯ জুলাই ২০১৬

শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্কট

১ জুলাই রমজানে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি এবং ৭ জুলাই ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার সন্নিকটে প্রাণঘাতী ও আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা এ যাবত সংঘটিত দেশীয় সন্ত্রাসে যোগ করেছে আন্তর্জাতিক মাত্রা। দেশে ইতোপূর্বে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্নমুখী সন্ত্রাসী তৎপরতাসহ হত্যাকা- সংঘটিত হলেও সাল-তারিখের হিসাবে ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে আহলে হাদিসের সঙ্গে জড়িত জঙ্গীগোষ্ঠী জেএমবির মাধ্যমে ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটতে শুরু করে। ২০০০ সাল থেকে বেশ কয়েকটি বোমা হামলার দায় স্বীকার করে সংগঠনটি। ২০০৫ সালে দেশব্যাপী অর্থাৎ ৬৩টি জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলার দায়ও স্বীকার করেছে জেএমবি। এরা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়, শিয়া মতাবলম্বী, একাডেমিশিয়ান, ব্লগার, লেখকসহ ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের টার্গেট করে হত্যা শুরু করে। জেএমবির কার্যক্রমের সঙ্গে একাত্তরের জামায়াত-শিবির-আলবদর-আলশামস-রাজাকার বাহিনীর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মিল রয়েছে। এর বাইরেও গত কয়েক বছরে হরকত-উল-জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহ্রীর, দৌলাতুল ইসলাম ইত্যাদি নামে-বেনামে আরও নানা জঙ্গী ও সন্ত্রাসী সংগঠন, অধিকাংশই নিষিদ্ধ, গজিয়ে উঠেছে দেশে। প্রশ্ন হলো কেন এমন হচ্ছে ও হলো? এতদিন পর্যন্ত ধারণা করা হতো যে, প্রধানত মাদ্রাসার ছাত্র এবং অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও নিম্নবিত্তভুক্ত তরুণরাই ঝুঁকে পড়ে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও জঙ্গী কার্যক্রমে। তবে গুলশান ও শোলাকিয়ার মর্মান্তিক ঘটনা প্রচলিত এ ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। সেখানে ধৃত ও মৃত জঙ্গীদের অধিকাংশই দেখা যায় রাজধানীর নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র। অনেকে এমনকি লেখাপড়া করেছে বিদেশে। এরা সবাই অপেক্ষাকৃত ধনী ও সচ্ছল মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তথাকথিত আধুনিক ও স্মার্ট জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ। অর্থাৎ এদের দৃশ্যমান বাহ্যিক জীবনধারা আবহমানকাল ধরে প্রচলিত ধর্মীয় অনুসারীদের মতো নয়। তাহলে তারা ধর্মীয় জঙ্গীবাদ, উগ্রপন্থাসহ ঠা-া মাথায় মানুষ হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ল কেন? এদের শিক্ষা ও মগজ ধোলাইয়ের ক্ষেত্রটা ঠিক কোথায়? দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত ও অনুসৃত শিক্ষাব্যবস্থায়, নাকি অন্য কোথাও, অন্য কোন ক্ষেত্রে! মাত্র কয়েক দশক আগে নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের মেধাবী ছাত্ররা অতিবাম মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী অনুপ্রেরণায় দলে দলে ঝুঁকে পড়েছিল নক্সালবাড়ি আন্দোলনে। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, রামমোহনের ভাস্কর্য ভেঙ্গে, জোতদার-পুলিশ হত্যা করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন তথা বিপ্লব আনতে চেয়েছিল তারা। একশ্রেণীর মধ্যবিত্তের নৈতিক সমর্থনও ছিল এর পেছনে। তার পরও বাস্তব সত্য হলো, তাদের এই হটকারী চেষ্টা ব্যর্থ হয় চূড়ান্তভাবে। বিশ্বব্যাপী ধনিক শ্রেণী নিপাত যায়নি, শ্রমিক শ্রেণীও মুক্তি পায়নি। দেশে দেশে বামপন্থী আন্দোলনই এখন পর্যুদস্ত ও বিভ্রান্ত। মার্ক্সবাদ থেকে মওদুদীবাদ। অতিবাম থেকে অতি ডান। বহুকথিত অর্থে ধর্মহীনতা থেকে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি! মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে কেন এই পরিবর্তন? তারুণ্যের কেন এই বিপথগামী ও বিভ্রান্ত উত্থান? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এর ফলাফল, কারণ অনুসন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, মনোবিশ্লেষক ও তাত্ত্বিকদের। বিশ্বের সর্বত্রই তারুণ্য এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ও বৈচিত্র্যবিলাসী। তাই বলে সন্ত্রাসী তৎপরতা, বোমাবাজি, ছুরি, চাপাতি, গুলি সর্বোপরি মানুষ হত্যা কোন ইজম অথবা ধর্মের নামে? এটা কী আদৌ কোন ধর্ম অথবা আদর্শ সমর্থন দেয়? কিংবা করে? তাহলে কেন এই হানাহানি, উন্মত্ততা, রক্তের হোলিখেলা, ভয়াবহ নির্মম নৃশংসতা? প্রকৃত অর্থে গলদটা কোথায়? ধর্মে নাকি শিক্ষায়? আমরা তো কোনটাই ধারণ করতে পারছি না! না শিক্ষা, না ধর্ম? আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ হবে রুচিশীল, স্মার্ট, পরিশীলিত, মার্জিত, অসাম্প্রদায়িক, সংস্কারমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, সর্বজনীন সর্বোপরি বৈশ্বিক নাগরিক। তা না হয়ে আমরা যেন ক্রমশ হয়ে উঠছি অসংস্কৃত, অমার্জিত, অশিক্ষিত, সাম্প্রদায়িক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, কুৎসিত, ঘৃণ্য, অপরিশীলিত, জিঘাংসাপ্রবণ, পশুপ্রবৃত্তিসুলভ এমনকি রক্তপিপাসু! সেক্ষেত্রে শিক্ষা ও ধর্মের গলদটা ঠিক কোথায়, তা খুঁজে বের করতে হবে জ্ঞানী-গুণী ও বিদগ্ধজনকে। তা না হলে উটের গ্রীবার মতো অদ্ভুত আঁধার এক নেমে আসবে, আসছে অচিরেই আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও সমাজযাপনে। ॥ দুই ॥ বর্তমান এই বৈশ্বিক সঙ্কট ও প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে। আজীবন-আমৃত্যু তিনি ভাবিত ছিলেন শিক্ষা ও সভ্যতার জন্য ঘনিয়ে আসা সঙ্কট মোচনে। নিজের জীবন ও লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে তুলেছেন বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতন। স্বীয় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন শিক্ষা ও চরিত্রগঠন বিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধে। শিক্ষার সঙ্গে গড়ে তুলতে চেয়েছেন জীবনের সংযোগ ও সেতুবন্ধন। সেই প্রকৃত শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন, যা মানুষকে যথার্থ অর্থে গড়ে তুলবে মানুষ হিসেবে। আর মানুষ যখন তা হবে, তখনই সে বন্ধ করবে হানাহানি, রক্তপাত। ভুলে যাবে হিংসা ও বিদ্বেষ। অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দিতে ক্রমাগত আলো দিয়ে আলো জ্বালতে সচেষ্ট হবে সর্বদাই। এটাই তো প্রকৃত মানবধর্ম। রবীন্দ্রনাথ দেশের প্রচলিত স্কুল-কলেজের শিক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতিতে বিশ্বাস করতেন না। সেদিন নিতান্তই ঘরোয়া এক আড্ডায় নিছক আলাপচারিতায় কথাটা বলে রীতিমতো বিপদে পড়লাম। সত্যি বলতে কী, কথাটা অনেকে আমলেই নিলেন না। কেউ কেউ হা-হা করে উঠলেন। তাদের বক্তব্য ও মনোভাব বুঝতে অবশ্য কষ্ট করতে হয় না তেমন। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপদ্ধতিতে যেহেতু প্রায় মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই অনাগত সন্তানকে রবীন্দ্রনাথের শিশুতোষ ও মাতৃবিষয়ক ছড়া দিয়ে শুরু এবং অনতিপরেই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে এবং এমনকি যৎকিঞ্চিত সংস্কৃতিবান ও রুচিশীল হলে মৃত্যুতেও রবীন্দ্র-কবিতা ও গান দিয়ে শেষ বিদায় জানানো হয়, সেখানে এমন কথা বলা ও ভাবা বাতুলতা বৈকি। এটা তো সত্য যে, সম্ভবত বিশ্বখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার ও কবি শেক্সপীয়রের পরেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে সর্বাধিক পঠন-পাঠন চর্চা ও গবেষণা, বই-পুস্তক প্রকাশনা, নাটক মঞ্চায়ন, চলচ্চিত্র নির্মাণ, সঙ্গীতানুষ্ঠান, তদুপরি এমফিল, পিএইচডি, ডি-ফিল ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে। এমনকি চীনা ভাষাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে বাস্তবে এই রবীন্দ্রনাথই ছিলেন বিদ্যায়তনিক আবহ ও শিক্ষার বাইরে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বড় ঘরের ছোট ছেলে। তার শিশুকাল কেটেছিল সদর-অন্দর সীমানার বাইরে। চাকর মহলে দ্বিতলের এক গৃহকোণে ভৃত্যশাসনের গ-ীরেখায়। বহু সন্তানবতী কুলপালিকা মাতার স্নেহ দৃষ্টি মোটেও সুলভ ছিল না। হুকুম ছিল ছোট ছেলেদের বাড়ির সদর দরজা না ডিঙ্গানোর। প্রথম পাঠ আরম্ভ হয়েছিল চন্ডীম-পে বাড়ির পাঠশালায়। বছর দুয়েকের বড় অগ্রজ সোমেন্দ্রনাথ ও ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদের দেখাদেখি রবীন্দ্রনাথ জেদ করে নিতান্ত কচি বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, তবে অচিরেই তা তার অরুচিকর ঠেকেছিল। সুতরাং তার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ পর্যন্ত এগোতে পারেনি। ঘরের খাঁচা শিশুর মনকে বেঁধে রাখতে পারত না, তবে ইস্কুলের খাঁচা মনকে যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত। কোন কোন শিক্ষকের নিষ্ঠুর বচন এবং কতিপয় সহপাঠীর নিকৃষ্ট সাহচর্য গৃহকোণ পালিত সুদর্শন বালকের শুচি রুচি ও কোমল মন পিষ্ট-ক্লিষ্ট করত প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় যে দু’তিনজন শিক্ষকের সহৃদয়তা ও সহানুভূতির কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন, তাদের অন্যতম অধ্যাপক ফাদার ডি পেনেরান্ডার, বৃদ্ধ খাজাঞ্চি কৈলাস মুখুজ্জ্যে, গৃহশিক্ষক প-িত রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য এবং সুরগুরু শ্রীকণ্ঠ সিংহ ও কিশোরী চাটুজ্জ্যে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও কর্মে পিতার পরেই যে ক’জন ব্যক্তির প্রভাব সবচেয়ে ব্যাপক হয়েছিল, তারা তাদের অন্যতম। তাদের প্রশান্ত পুণ্য ছবি জীবনস্মৃতিতে স্বল্পরেখায় সমুজ্জ্বল। আরও একটা কথা অবশ্য স্মরণীয়। পিতা দেবেন্দ্রনাথ তার সংসারে বিলাসিতা দূরে থাক, কোনরকম অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বাহুল্যের প্রশ্রয় দেননি কোনদিন। আর তাই কলকাতার জাঁকালো অভিজাত ঘরের ছেলে হয়েও রবীন্দ্রনাথ অল্পবিত্ত সাধারণ গৃহস্থের ছেলের মতো অনাড়ম্বর স্বাচ্ছন্দ্যে মানুষ হয়েছিলেন। জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘আহারে আমাদের শৌখিনতার গন্ধও ছিল না। কাপড়চোপড় এতই যৎসামান্য ছিল যে এখানকার ছেলেদের চক্ষে তাহার তালিকা ধরিলে সম্মানহানির আশঙ্কা থাকে। বছর দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনদিন কোন কারণেই মোজা পরি নাই। শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আর একটা সাদা জামাই যথেষ্ট ছিল।’ মোটকথা, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গৃহশিক্ষিত ও আত্মশিক্ষিত। বাল্যে তার পাঠশিক্ষা হয়েছিল গৃহশিক্ষকের কাছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা তার ধাতে সয়নি। ইস্কুলের সঙ্কীর্ণ রুদ্ধকক্ষ ও ঘণ্টাবন্দী রুটিন বালক রবীন্দ্রনাথের অসহ্য ঠেকেছিল। প্রথমে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, তারপর নর্মাল স্কুল, এরপর বেঙ্গল একাডেমি এবং সবশেষে সেন্ট জেভিয়ার্স-কোথাও তিনি টিকতে পারেননি। অতঃপর পাঠানো হয়েছিল বিলাতে। বড় আশা ছিল রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টার হয়ে ফিরবেন। সেখানে কেটে গেল দেড় বছর। আশার গুড়ে বালি। মাস কতক পড়া হলো লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে। মাস কতক গৃহশিক্ষকের কাছে ল্যাটিন শেখার চেষ্টা। উদ্দেশ্য সফল হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। যেটুকু বিদ্যা রবীন্দ্রনাথ অধিগত করেছিলেন, তা খুব উল্লেখযোগ্য নয়। পরে স্বেচ্ছায় ফরাসী ও জার্মান ভাষা শিখতে যতœবান হয়েছিলেন। তাও ব্যর্থ হয়। তবে নিজের চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ বহুশ্রুত হয়েছিলেন। গৃহশিক্ষকের কাছে যখন নিয়মিত পাঠ নিচ্ছেন, তখন পাঠ্য বিষয় ও পাঠ্য পুস্তকের অতিরিক্ত পাঠ্য-অপাঠ্যে তার মন নিমগ্ন হয়েছিল। বিদ্যালয়ের সুড়ঙ্গপথে রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালাভ না হওয়ায় আমাদের লাভ হয়েছে অপরিমিত। ইস্কুলের ছেলেদের সাহচর্য দুঃসহ না হলে, ইস্কুলের কারাকক্ষ ও পরীক্ষার কাঠগড়া ভীতিপ্রদ না ঠেকলে রবীন্দ্রনাথ হয়ত আর পাঁচজন ছেলের মতোই পরীক্ষার পর পরীক্ষা পাস করে অবশেষে হাইকোর্টে উত্তীর্ণ হতে পারতেন। তাতে হয়ত আত্মীয়স্বজন অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা লাঘব হতো; তবে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা জানি কবি-শিল্পী-মনিষীরূপে পূর্ণ মহিমায় তাকে পেতাম না। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরের কথাই বলেছেন এবং তাতে ‘ইস্কুল-কালেজীয়’ শিক্ষার কোন স্থান নেই। বইটি পড়বার সময় আমরা যেন তার সঙ্গে সেকালের গন্ধ গান দৃশ্য স্পর্শের স্বাদ পেতে পেতে চলতে থাকি, তার হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করি এবং কয়েকটি মহৎ হৃদয়ের চকিত পরিচয় পাই। যদি কোন একটি রচনাকে রবীন্দ্রনাথের গদ্য সাহিত্যের প্রতিভূ বলতে হয়, তবে সে জীবনস্মৃতি। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীদের জন্য লেখা ছেলেবেলা (১৯৪০) এবং অব্যবহিত পরে ‘গল্পস্বল্প’ (১৯৪১) বলা চলে জীবনস্মৃতির পরিপূরক। রবীন্দ্রনাথের জীবনের বাইরেও শিক্ষা বিষয়ে তার নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভাবনাচিন্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত সমাবর্তন ভাষণ ইত্যাদি রয়েছে। রবীন্দ্র জীবদ্দশায় প্রকাশিত মোট ষোলো ভাগ গদ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে চার ভাগ বাদ দিয়ে বাকি বারো ভাগে গদ্য প্রবন্ধগুলো সংকলিত হয়। প্রতিটি ভাগ স্বতন্ত্র গ্রন্থ। এর মধ্যে ১৯০৮ সালে প্রকাশিত চতুর্দশ ভাগের শিরোনাম শিক্ষা। এতে সাতটি প্রবন্ধ আছেÑ শিক্ষার হেরফের, ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ, শিক্ষা-সংস্কার, শিক্ষা-সমস্যা, জাতীয় বিদ্যালয় এবং সাহিত্য সম্মেলন। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত শিক্ষার তৃতীয় সংস্করণে আরও কয়েকটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়। পরিশিষ্ট রূপে রয়েছে আরও পাঁচটি রচনা। অবশ্য এর বাইরেও শিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের আরও প্রবন্ধ-নিবন্ধ সর্বোপরি মন্তব্য ও বিশ্লেষণ থাকা বিচিত্র নয়। বাংলাদেশের জয় বুকস ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর ষষ্ঠ খ-ের ৫৬৩-৬০১ পৃষ্ঠায় শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলো স্থান পেয়েছে। বক্ষ্যমান নিবন্ধে উদ্ধৃত বক্তব্য প্রধানত সেখান থেকেই নেয়া হয়েছে। আর কিছু ঋণ রয়েছে শ্রীসুকুমার সেনের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ তৃতীয় খ-- রবীন্দ্রনাথের প্রতি। সবগুলো প্রবন্ধ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তাতে অযথাই পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে। প্রথমে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে শিক্ষা-সংস্কার প্রবন্ধটি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা অনুধাবনের জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। ১৩১৩ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধটি তিনি যখন লেখেন, তখন ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে শিক্ষা সম্বন্ধে খুব একটা গোলমাল চলছিল। এমন এক সময়ে বিখ্যাত ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘স্পীকার’-এ আইরিশ শিক্ষা-সংস্কার সম্বন্ধে যে প্রস্তাব আলোচিত হয়েছে, তা রবীন্দ্রনাথের মনোযোগ আকর্ষণ করে। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘য়ুরোপের যে যুগকে অন্ধকার যুগ বলে, যখন বর্বর আক্রমণের ঝড়ে রোমের বাতি নিবিয়া গেল, সেই সময়ে য়ুরোপের সকল দেশের মধ্যে কেবলমাত্র আয়রলন্ডেই বিদ্যার চর্চা জাগিয়াছিল। তখন য়ুরোপের ছাত্রগণ আয়রলন্ডের বিদ্যালয়ে আসিয়া পড়াশুনা করিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন বহুতর বিদ্যার্থী এখানে আসিয়া জুটিয়াছিল, তখন তাহারা আহার বাসা পুুঁথি এবং শিক্ষা বিনামূল্যেই পাইত। কতকটা আমাদের দেশের টোলের মতো আর কি।... য়ুরোপের অধিকাংশ দেশেই আইরিশ বৈরাগিগণ বিদ্যা এবং খৃষ্টধর্মের নির্বাণপ্রায় শিখা আবার উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন। ফ্রান্সের রাজা শার্লমান অষ্টম শতাব্দীতে পারিস য়ুনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাভার বিখ্যাত আইরিশ প-িত ক্লেমেন্সের হাতে দিয়াছিলেন।... প্রাচীন আইরিশ বিদ্যালয়ে যদিচ লাটিন, গ্রীক এবং হিব্রু শিখানো হইত, তবু সেখানে শিখাইবার ভাষা ছিল আইরিশ। গণিত জ্যোতিষ, ফলিত জ্যোতিষ এবং তখনকারকালে যেসকল বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল, তাহা আইরিশ ভাষা দ্বারাই শেখানো হইত। সুতরাং এ ভাষার পারিভাষিক শব্দের দৈন্য ছিল না... ‘যখন দিনেমার এবং ইংরেজরা আয়রলন্ড আক্রমণ করে তখন এই সকল বিদ্যালয়ে আগুন লাগাইয়া বিপুল সঞ্চিত পুঁথিপত্র জ্বালাইয়া দেয়া হয় এবং অধ্যাপক ও ছাত্রগণ হত ও বিক্ষিপ্ত হইতে থাকে।... অবশেষে এলিজাবেথের কালে লড়াই হইয়া যখন সমস্ত সম্পত্তি অপহৃত হইল, তখন আয়রলন্ডের স্বায়ত্তবিদ্যা ও বিদ্যালয় একেবারে নষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।... এইরূপে আয়রলন্ডবাসীরা জ্ঞানচর্চা হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিল, তাহাদের ভাষা নিকৃষ্ট সমাজের ভাষা বলিয়া অবজ্ঞাপ্রাপ্ত হইতে থাকিল। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘ন্যাশনাল ইস্কুল’ প্রণালীর সূত্রপাত হইল। জ্ঞানপিপাসু আইরিশগণ এই প্রণালীর দোষগুলি বিচারমাত্র না করিয়া ব্যগ্রভাবে ইহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইল।... আইরিশদিগকে জোর করিয়া স্যাকসনের ছাঁচে ঢালা এবং ইংরেজ করিয়া তোলাই ন্যাশনাল ইস্কুল প্রণালীর মতলব ছিল। ফলে এই চেষ্টার ব্যর্থতা প্রমাণ হইল।... নানা প্রকার কঠিন শাস্তি দ্বারা বালকদিগকে তাহাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করিতে একেবারে নিরস্ত করিয়া দেওয়া হইল। শুধু ভাষা নয়, আইরিশ ইতিহাস পড়ানো বন্ধ হইল; আইরিশ ভূবৃত্তান্তও ভাল করিয়া শেখানো হইত না। ছেলেরা বিদেশের ইতিহাস ও ভূবৃত্তান্ত শিখিয়া নিজের দেশ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিত। ইহার ফল যেমন হওয়া উচিত, তাহাই হইল। মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল। আইরিশ-ভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া। ইহার কারণ, এ শিক্ষাপ্রণালী কলের প্রণালী, ইহাতে মন খাটে না, ছেলেরা তোতাপাখি বনিয়া যায়।... ফলস্বরূপ বিদ্যাশিক্ষা সেখানে একেবারে দলিত হইয়া গেল।’ ব্রিটিশরাজ প্রবর্তিত আয়রলন্ডের শিক্ষারীতি ও সংকটের সঙ্গে তুলনা করে অতঃপর রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বিদ্যাশিক্ষায় আমাদেরও মন খাটিতেছে নাÑ আমাদেরও শিক্ষা প্রণালীতে কলের অংশ বেশি। যে ভাষায় আমাদের শিক্ষা সমাধা হয়, সে ভাষায় প্রবেশ করিতে আমাদের অনেক দিন লাগে। ততদিন পর্যন্ত কেবল দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হাতুড়ি-পেটা এবং কুলুপ-খোলার তত্ত্ব অভ্যাস করিতেই প্রাণান্ত হইতে হয়। আমাদের মন ১৩-১৪ বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে, সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার ওপর বিদেশী ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্থ বিদ্যার শিলাবৃষ্টি বর্ষণ হইতে থাকে, তবে তাহা পুষ্টি লাভ করিবে কি করিয়া?... এইরূপ শিক্ষা প্রণালীতে আমাদের মন যে অপরিণত থাকিয়া যায়, বুদ্ধি যে সম্পূর্ণ স্ফূর্তি পায় না, সে কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে।... আমাদের লেখাপড়ার মধ্যে সেই ছাত্র অবস্থার ক্ষীণতাই বরাবর থাকিয়া যায়; আমরা নকল করি, নজির খুঁজি এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি, তাহা হয় কোনো না কোনো মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। হয় মানসিক ভীরুতাবশত আমরা পদচিহ্ন মিলাইয়া চলি, নয় অজ্ঞতার স্পর্ধাবশত বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে থাকি।... ‘আর একটি কথা। শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যের সঙ্গে যদি আর কোনো অবান্তর উদ্দেশ্য ভিতরে ভিতরে থাকিয়া যায়, তবে তাহাতে বিকার জন্মায়। আইরিশকে স্যাকসন করিবার চেষ্টায় তাহার শিক্ষাকেই মাটি করা হইয়াছে। কর্তৃপক্ষ আজকাল আমাদের শিক্ষার মধ্যে পোলিটিক্যাল মতলবকে সাঁধ করাইবার চেষ্টা করিতেছেন।... শিক্ষাকে তাহারা শাসন বিভাগের আফিসভুক্ত করিয়া লইতে চান।... বিদ্যালয়ের বইগুলিও এমনভাবে প্রস্তুত ও নির্বাচিত হইবে যাহাতে নিরপেক্ষ উদার জ্ঞানচর্চা পোলিটিক্যাল প্রয়োজন সিদ্ধির কাছে খ-িত হইয়া যায়।’ ‘শিক্ষা-সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটি অংশ। সাড়ে ১০টার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়। মাস্টারেরও মুখ চালিতে থাকে। চারটার সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার কলও তখন মুখ বন্ধ করেন। ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে-ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়। কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে ঠিক ফরমাশ দেওয়া জিনিসটা পাওয়া যায়Ñ এক কলের সঙ্গে আর এক কলের উৎপন্ন সামগ্রীর তফাত থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়। কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে আর এক মানুষের অনেক তফাত। এমনকি, একই মানুষের একদিনের সঙ্গে আর একদিনের ইতরবিশেষ ঘটে। তবু মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায়, কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না। কল সম্মুখে উপস্থিত করে কিন্তু দান করে নাÑ তাহা তেল দিতে পারে কিন্তু আলো জ্বালাইবার সাধ্য তাহার নাই।... এমন অবস্থায় বিদ্যালয় একটা ইঞ্জিন মাত্র হইয়া থাকেÑ তাহা বস্তু জোগায়, প্রাণ জোগায় না।’ উদ্ধৃতি আরও বড় করে কোনো লাভ নেই। সব কথার সার কথা, যা রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন, তা হলো ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় স্কুল সিস্টেমে আমাদের এখানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তাতে জীবনের সংযোগ নেই। উপমহাদেশের সমাজ-সংসার, জীবনযাপন, দেশ, জাতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার-আচরণ, আহার-বিহার, আদব-কায়দা, ভূপ্রকৃতি ইত্যাদির সঙ্গে বিদ্যালয়ের শিক্ষার কোনো যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সংসারে কৃত্রিম জীবনযাত্রায় হাজার রকমের অসত্যও যেখানে প্রতিমুহূর্তে রুচি নষ্ট করিয়া দিতেছে, সেখানে ইস্কুলে দশটা-চারটার মধ্যে গোটাকতক পুঁথির বচন সমস্ত সংশোধন করিয়া দিবে, ইহা আশাই করা যায় না। ইহাতে কেবল ভুরি ভুরি ভানের সৃষ্টি হয় এবং নৈতিক জ্যাঠামি যাহা সকল জ্যাঠামির অধম, তাহা সুবুদ্ধির স্বাভাবিকতা ও সৌকুমার্য নষ্ট করিয়া দেয়।... ব্রহ্মচর্য পালনের দ্বারা ধর্ম সম্বন্ধে সুরুচিকে স্বাভাবিক করিয়া দেয়া হয়, উপদেশ দেওয়া নহে, শক্তি দেওয়া হয়। নীতিকথাকে বাহ্যভূষণের মতো জীবনের উপরে চাপাইয়া দেওয়া নহে, জীবনকেই ধর্মের সঙ্গে গড়িয়া তোলা এবং এইরূপে ধর্মকে বিরুদ্ধপক্ষ দাঁড় না করাইয়া তাহাকে অন্তরঙ্গ করিয়া দেওয়া হয়। অতএব জীবনের আরম্ভে মনকে চরিত্রকে গড়িয়া তুলিবার সময় উপদেশ নহে, অনুকূল অবস্থা এবং অনুকূল নিয়মই সকলের চেয়ে বেশি আবশ্যক।’ ॥ তিন ॥ অকপটে স্বীকার করতে হবে যে, বহুদিন থেকে প্রচলিত এই শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা অন্তত তরুণ প্রজন্মের চাহিদা ও আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারছে না। অবশ্য এই শিক্ষা নিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু লোক দেশে ও বিদেশে কিছু একটা করে কেটে খাচ্ছে বটে; তবে অন্তত অধিকাংশের কাছে তা জীবনজীবিকার অন্যতম উৎস হয়ে উঠতে পারছে না; মনুষ্যত্ব বিকাশ তো দূরের কথা। এতে করে সমাজে ও রাষ্ট্রে ধনবৈষম্য ও শ্রেণীবৈষম্য শুধু যে বাড়ছে, তা নয়, দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ ক্রমশ নীতিনৈতিকতাহীন, দুর্নীতিপ্রিয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠছে। একটু সচেতন পাঠকের প্রসঙ্গক্রমে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের কট্টর বাম আন্দোলন, যা সমধিক নক্সালবাড়ী আন্দোলন নামে খ্যাত, তার কথা মনে পড়তে পারে। সে সময়েও অনেক ভালো ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ, যাদের অনেকেই ছিলেন অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ঘরের, ধনবৈষম্য ও শ্রেণীবৈষম্য নিরসনকল্পে যোগ দিয়েছিলেন এই অতি বামপন্থী আন্দোলনে। অনেক মধ্যবিত্ত তাতে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য কঠোরহস্তে এই আন্দোলন দমন ও চুরমার করে দেওয়া হয়। ট্র্যাজেডি এই যে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শই তো এখন বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত বিশ্বব্যাপী। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে দেশে এবং বিদেশেও বটে, মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে কতিপয় ধর্মাশ্রয়ী আন্দোলন। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এমনকি অন্যান্য ছোটখাটো ধর্মকে অবলম্বন করেও এক জাতীয় মৌলবাদী তৎপরতা বিশ্বের নানা দেশে দানা বাঁধতে দেখা যাচ্ছে। ইরাক-সিরিয়ার বিশাল একটি ভূখ- দখলে নিয়ে আইএস তো রীতিমতো মূর্তিমান আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী। ভারতে অনুরূপ আরএসএস-জনসংঘ, মিয়ানমারে বুড্ডিস্টসংঘ, জার্মানিতে পেডিগা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সে উগ্র ন্যাশনালিস্ট পার্টি, আমেরিকায় ক্লু- ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান ইত্যাদি। বাংলাদেশে আইএসের শাখা-প্রশাখা ও সংযোগ থাকুক আর নাই থাকুক, গুলশানে ও শোলাকিয়ায় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের আস্ফালন তো লক্ষ্য করা গেল। এতে বেশ বোঝা যায় যে, বাংলাদেশও আর নিরাপদ নয়। সুতরাং সবাইকে জরুরীভাবে বসতে হবে, ভাবতে হবে। আশু করণীয় নির্ধারণ করে নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। পৃথিবীর কোন ধর্মই নরহত্যার কথা বলে না, সমর্থন করে না, স্বীকৃতি তো দূরের কথা। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করবে, এটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অমার্জনীয় অপরাধ। আইনের দৃষ্টিতে তো বটেই। সে অবস্থায় বিভ্রান্ত ও বিপথগামী তরুণদের আশা-আকাক্সক্ষা চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে জানা ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের সন্তানদের জীবনের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে হবে সবাইকে, সর্বতোভাবে।
×