ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বের হয়ে আসছে নানা অজানা তথ্য ॥ পাঠ নিচ্ছে ২ শতাধিক শিক্ষার্থী

জামায়াতী যোদ্ধা তৈরির কারখানা বরিশালের পিস স্কুল

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৮ জুলাই ২০১৬

জামায়াতী যোদ্ধা তৈরির কারখানা বরিশালের পিস স্কুল

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ জামায়াত-শিবিরের আতুরঘর হিসেবে ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করেছে বরিশাল নগরীর পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজ। মাত্র এক বছর আগে নগরীতে কার্যক্রম শুরু করার সময় কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছিল বর্তমানে বিতর্কিত ইসলামী বক্তা ডাঃ জাকির নায়েকের ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধায়নে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হবে। ওই সময় বিভিন্ন মাধ্যমে জাকির নায়েক ‘জনপ্রিয়’ হয়ে ওঠায় অল্পদিনে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এ স্কুলে বর্তমানে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। বর্তমানে জাকির নায়েকের বুদ্ধিবৃত্তিক জঙ্গীবাদ প্রচারের অপকৌশল ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর কথা ঘুরিয়ে নিয়েছেন বরিশালের পিস স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। পিস স্কুল কমিটির নেতৃবৃন্দ বলছেন, এ স্কুলের সঙ্গে জাকির নায়েকের ফাউন্ডেশনের কোন সস্পৃক্ততা নেই। তাহলে পিস স্কুল পরিচালনা করছেন কারা? এমন প্রশ্নের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে নানা অজানা তথ্য। সূত্র মতে, সরাসরি জামায়াতে ইসলামী পরিচালনা করছে পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজ বরিশাল শাখা। ‘ইনভাইট পিস’ নামক একটি কোম্পানি স্কুলটি পরিচালনা করছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজের পাঠক্রম অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারী স্কুলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি বোর্ডের পাঠক্রমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখানে সরকার স্বীকৃত পাঠক্রম প্রচারে ব্যবহৃত হলেও মূলত ‘জামায়াতী পাঠ্যক্রম’ অনুসারে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, বইতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমনই লেখা থাকুক না কেন, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা ভিন্নভাবে তা ব্যাখ্যা করে থাকেন। এখানে কখনও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় না। তবে ইসলামী শিক্ষার নামে বিভিন্ন যুদ্ধের চৌম্বুকাংশ প্রায় প্রতিদিন শিশুদের মাঝে বাধ্যতামূলক ‘বয়ান’ দেয়া হয়। সচেতন নাগরিকদের মতে, এটা জামায়াতের একটা অপকৌশল। ইসলামী শিক্ষার নামে যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে ছোট থেকেই শিশুদের মনে ‘জিহাদী’ হওয়ার প্রবণতা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের মতে, জামায়াত ও জাকির নায়েকের ‘টার্গেট’ খুব বেশি আলাদা নয়। যেহেতু বিশ্বে জাকির নায়েক বিশেষ একশ্রেণীর মানুষের কাছে ‘প্রিয়’ এবং তার টেলিভিশনের নাম পিস টিভি, তাই সেই নাম ব্যবহার করে সুযোগ নিয়েছে জামায়াত। এমন ধারণার সত্যতাও পাওয়া গেছে। পিস স্কুল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের (ইনভাইট পিস লিমিটেড) চেয়ারম্যান আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। তিনি শিবিরের সাবেক সভাপতি। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ শিবিরের ১১তম সভাপতি। তিনি, ১৯৯১-৯২ সেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাকে বিভিন্ন সময় ছাত্র শিবিরের অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে। ছাত্র শিবিরের মুখপত্র ‘ছাত্র সংবাদেও’ তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। বিষয়টি কয়েকদিন পূর্বে গণমাধমে আলোচিত হলে তাকে সরিয়ে নতুন চেয়ারম্যান করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর মীর আকরামুজ্জামানকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আকরামুজ্জামানের সঙ্গে জামায়াতের প্রত্যক্ষ কানেকশন থাকার অভিযোগে এর আগে দুইবার তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। তবে ওই দুই দফায় লিখিত মুচলেকা দিয়ে তিনি জামায়াতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বন্ধ করে স্বপদে বহাল হন। অনুসন্ধানী সূত্রে আরও জানা গেছে, বরিশালের পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজে ভাষা হিসেবে বাংলা, ইংরেজী ও আরবি শিখানো হয়। শিক্ষার্থীরা জানায়, তাদের ইংরেজী ও আরবি শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়। তার তুলনায় বাংলা ভাষা শেখানো হয় না। এমনকি ইংরেজী বা আরবি শেখাতে গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ইরাক, ইরান, সিরিয়া বা আফগানিস্তানে তালেবান এবং আইএসএসের যোদ্ধাদের মানুষ হত্যার গল্প ‘লেসন স্পিড’ হিসেবে পড়ানো হয়। একাধিক অভিভাবকরা জানান, পিস স্কুলে লেখাপড়ার কৌশল ভিন্ন এবং এখানে অনেক কিছুই শেখানো হয় যা স্বাভাবিক শিক্ষা নয়। তবে দুটি কারণে তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের সেখানে ভর্তি করিয়েছেন। এর মধ্যে আরবি ও ইংরেজী ভাষাটা রপ্ত করা যাচ্ছে বলে জানান তারা। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা স্কুলটি সম্পর্কে কোন কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। স্কুলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, স্কুলটি জামায়াতের পরিচালনা কমিটি দিয়ে চললেও জাকির নায়েকের লেকচারের নির্বাচিত অংশ পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়ে থাকে। যে অংশের মধ্যে অনেক মতামত আছে যা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সূত্র মতে, নগরীর ৪৭ কলেজ এভিনিউয়ের জিমি কটেজ ভাড়া নিয়ে স্কুল এ্যান্ড কলেজটি পরিচালিত হলেও নির্দিষ্ট লোকের বাইরে কেউ এ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেন না। সূত্রটি আরও জানিয়েছেন, বরিশালে জামায়াতের যোদ্ধা তৈরির আতুরঘর হিসেবে স্কুল এ্যান্ড কলেজটি পরিচালিত হচ্ছে। এখানে একদিকে যেমন শিশুদের শিক্ষার নামে ভিন্ন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তেমনি একই সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে এখানে বিশেষ সভা বসে। যেটিকে বাইরে প্রচার করা হয়ে থাকে স্কুল এ্যান্ড কলেজ কমিটির সভা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেই সভা প্রায় বিকেলে হয়ে থাকে। সভায় যারা যোগদান করেন তারা বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলের শীর্ষ জামায়াত নেতা। সূত্র মতে, এর পূর্বে স্কুল এ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান ছিলেন বিএম কলেজের গণিত বিষয়ের শিক্ষক মোশারেফ হোসেন। জামায়াত পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কথা বিএম কলেজ কর্তৃপক্ষ জানতে পারায় শেষে বাধ্য হয়ে তিনি (মোশারেফ) পদত্যাগ করেন। তবে এটি তার আইওয়াশ বলছেন অনেকেই। এখনও নেপথ্যে মোশারেফই স্কুল এ্যান্ড কলেজটি চালাচ্ছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, স্কুলে ২১ শিক্ষকের মধ্যে ১৯ জনই জামায়াতের সমর্থক। বরিশালের পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর এম মোয়াজ্জেম হোসেন। পিস স্কুল সম্পর্কে জানতে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও স্কুলে গিয়েও তাকে না পাওয়ায় কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে স্কুল এ্যান্ড কলেজের অফিস ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের স্কুলের সঙ্গে জাকির নায়েক বা জামায়াতের কোন কানেকশন নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে চাকরি নেয়ার ক্ষেত্রে যেমন আওয়ামী লীগের সুপারিশ দরকার, তেমনি পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজও শিবির বা জামায়াতের সুপারিশ ছাড়া কিছুই হয় না।
×