ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালান

বৃহত্তর চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকা জঙ্গী প্রশিক্ষণের আস্তানা

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৮ জুলাই ২০১৬

বৃহত্তর চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকা জঙ্গী প্রশিক্ষণের আস্তানা

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বৃহত্তর চট্টগ্রামের সীতাকু-, হাটহাজারী, কক্সবাজার, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং মিয়ানমার সংলগ্ন সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট সন্ত্রাসীদের আস্তানায় যেমন পরিণত হয়েছে তেমনি ছোট-বড় অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্যের চালানের জন্য চিহ্নিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে সন্ত্রাসী ও জঙ্গীপনায় জড়িতদের ট্রেনিং চলে। সেই ট্রেনিং নিয়ে সন্ত্রাসী ও জঙ্গীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে ভীতি ও সহিংসতার পাশাপাশি আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। পুলিশ, গোয়েন্দা ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে বিশেষ করে রামু, উখিয়া, টেকনাফ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে তৎপর রয়েছে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। অতীতে এ চক্রটি রামু, উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ বিহারগুলো টার্গেট করে হামলা চালিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এখন ওই চক্রটিই হিন্দু ও তাদের মন্দির উপাসনালয় আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে বিভিন্নভাবে। ইতোমধ্যে এসব বিষয় নিয়ে সেখানকার মানুষের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে, চট্টগ্রামের সীতাকু-, হাটহাজারী ও নগরীর বাকলিয়া ও হালিশহর এলাকায় জঙ্গী সন্ত্রাসীদের ছোট ছোট একাধিক আস্তানা রয়েছে। বাকলিয়া ও হালিশহর থেকে ইতোমধ্যে কয়েকটি সন্ত্রাসী আস্তানা আবিষ্কার করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এছাড়া ফয়’স লেক এলাকায় জন্ম নেয়া জঙ্গী সংগঠন হামজা ব্রিগেডের সকল সদস্য গ্রেফতার হওয়ায় এটির তৎপরতা এখন লক্ষ্যণীয় নয়। পাশাপাশি এদের অর্থ যোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত কয়েকজন ধরা পড়ার পর তারা যেমন গ্রেফতার হয়েছে, তেমনি ব্যাংক এ্যাকাউন্টও জব্দ হয়েছে। ফলে এ সংগঠনটি আর এগুতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে পুলিশের ধারণা শুরুতে খেই হারিয়ে এ হামজা ব্রিগেডের সমর্থকরা দূরে সরে গেছে। সারাদেশে জঙ্গীসংগঠন জেএমবি সদস্যদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে লক্ষ্যণীয় হলেও চট্টগ্রামে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বর্তমানে যেটি আনসার আল ইসলাম নামে পরিচিতি পাচ্ছে এবং এর সদস্যদের তৎপরতা বেশি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সীতাকু-, মীরসরাই ও ফটিকছড়িকে ঘিরে যে পাহাড়ী এলাকাগুলো রয়েছে ওইসব স্থানে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এটিবি) সদস্যদের তৎপরতা ও ট্রেনিং গ্রহণের বিষয়টি ইতোমধ্যে ফাঁস হয়েছে। গত একসপ্তাহে গ্রেফতার হয়েছে এটিবির ৬ সদস্য। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এসব সংগঠনের অধিকাংশ সদস্য বৃহত্তর চট্টগ্রামের বাইরের। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার যুবকরা চট্টগ্রামে এসে এসব জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় থেকে নাশকতার কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সিএমপি ও জেলা পুলিশ সূত্রে জানানো হয়, আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসীসংগঠন হিসেবে চিহ্নিত ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মকা- শুরু থেকেই চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি গতি পেয়েছিল। এ সংগঠনের সঙ্গেও যারা জড়িত তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের বাইরের যুবকদের সংখ্যাই বেশি। এসব যুবকের বড় একটি অংশ এখন বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের আশ্রয় প্রশ্রয়ে নানা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে বলে পুলিশ ধারণা পেয়েছে। জামায়াত-শিবিরের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দীর্ঘদিন ধরে নগরীর চকবাজার এলাকায় ছিল। বর্তমানে এর নিজস্ব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা হয়েছে সীতাকু-ে বিশাল এলাকা জুড়ে। দেশী-বিদেশী অর্থ যোগানে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি খুব দ্রুত একটি বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই জামায়াত শিবিরমনা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে জামায়াত শিবিরমনার সংখ্যা পুরোপুরি না হলেও শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্মচারীরা জামায়াত শিবিরমনা না হলে চাকরি যেমন মেলে না, তেমনি মিললেও থাকে না। অনেকটা ইসলামী ব্যাংকের নীতির মতোই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-আদর্শ। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এ ব্যাপারে চাকরি পাওয়াদের প্রায় শতভাগই জামায়াত শিবির থেকে আসা। এভাবেই মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আর্থিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের সমর্থকদের প্রাধান্য দিয়ে আসছে। এছাড়া বেসরকারীভাবে জামায়াত শিবিরের মধ্যে যারা টাকার পাহাড় বানাতে সমর্থ হয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এদের সংখ্যা বেশি। এরফলে মৌলবাদের সমর্থকরা বর্তমান সরকারকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হবার কারণে এদের বড় একটি অংশ জঙ্গীপনার সঙ্গে জড়িত ইসলামী ব্যানারের বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হয়েছে। এখন এ বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঢাকায় নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়টি বেসরকারী পর্যায়ে একটি অন্যতম বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছিল। এখন এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র একটি অংশ জঙ্গীবাদে জড়িত হবার প্রমাণ মিলেছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকও ঘৃণ্যতম জঙ্গীপনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রসঙ্গত, এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে অন্তত ৩ জন রয়েছেন, যারা সক্রিয়ভাবে জামায়াত শিবিরের এক সময়ের নেতা এবং এখন বড় ধরনের পৃষ্ঠপোষক। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের জঙ্গীপনায় জড়িত হবার বিষয়টি দেশের সকল মহলকে রীতিমত হতবাক করেছে। বিষয়টি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এ ব্যাপারে কি-ই বা করার আছে। সর্বশেষ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসিসহ ৩ জন জঙ্গীপনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে। চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে তা নিয়ে সরকারী নজরদারি কঠোরভাবে বলবত করার এখনই সময়। কেননা, মৌলবাদ জামায়াত শিবিরের সমর্থকগোষ্ঠী এই প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে মনে করে।
×