ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেড় হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নামছে রাজউক

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৮ জুলাই ২০১৬

দেড় হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নামছে রাজউক

মশিউর রহমান খান ॥ আগামী ৩ মাসের মধ্যে রাজধানীর গুলশান, বনানী ও বারিধারাসহ সকল আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠা সকল প্রকারের স্থায়ী অস্থায়ী অবৈধ স্থাপনা অপসারণের মাধ্যমে এলাকাগুলোকে আবাসিক এলাকা হিসেবে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। রবিবার মন্ত্রী জনকণ্ঠকে এ কথা জানান। এর আগে মন্ত্রী সচিবালয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গী হামলার শিকার রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি নামের প্রতিষ্ঠানটি এতদিন অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন গণপূর্তমন্ত্রী। এ সময় সাংবাদিকদের কাছে তিনি অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে অবৈধ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দেন। এ সময় রাজউকের চেয়ারম্যান বজলুল কবির চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। আবাসিক এলাকায় ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন অনুমোদন ছাড়াই নিয়মবহির্ভূতভাবে গড়ে তোলা সকল অবৈধ স্থাপনার একটি তালিকা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তালিকা অনুযায়ী রাজধানীর প্রায় সকল এলাকায় গড়ে উঠা স্থাপনার সংখ্যা এক হাজার ৬শ’ ২৫টি। চলতি সপ্তাহের যে কোন দিন এসব স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে রাজউক। সূত্র জানায়, সোমবার অভিযানের বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে এক জরুরী সভা আহ্বান করেছে রাজউক। এ সভায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। অপর একটি সূত্র জানায়, পুলিশ প্রাপ্তি সাপেক্ষে অভিযানের তারিখ ঘোষণা করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ তালিকায় আরও নতুন নতুন স্থাপনা যোগ হবে। প্রাথমিকভাবে রাজউকের ৮টি জোনের মধ্যে রাজধানীর ভেতরের ৫টি জোনে এসব অবৈধ স্থাপনা পাওয়া গেছে। এর বাইরের ৩টি জোনের তালিকাও খুব শীঘ্রই তৈরি করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গত ৪ দিনে রাজউকের চেয়ারম্যানের নির্দেশে সকল জোনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকার মধ্যে গুলশান বারিধারা জোনের অবৈধ স্থাপনা হচ্ছে ৫শ’ ৫২টি, উত্তরা জোনের ২শ’ ১৫টি, মিরপুর জোনের ৫শ’ ৮০টি, ধানম-ি লালবাগ জোনের ১৭৩টি, মতিঝিল খিলগাঁও জোনে ১০৫টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তালিকা অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনার মধ্যে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রেস্তরাঁ, হোটেল, বেসরকারী অফিস, মার্কেটসহ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা রয়েছে। এসব স্থাপনাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই রাজউক থেকে আবাসিক স্থাপনার অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিকসহ কমার্শিয়াল বা শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন থেকে ব্যবসার জন্য নামমাত্র একটি ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের দেয়া এসব স্থাপনার ঠিকানা রাজউক নির্ধারিত কমার্শিয়াল এলাকায় দেয়া হলেও অনুমতি না নিয়েই সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। যদিও সিটি কর্পোরেশন দীর্ঘ বছর যাবত আবাসিক এলাকায় কোন প্রকার অনাবাসিক বা কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বন্ধ করতে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান বন্ধ রেখেছে। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ১৬শ’ ২৫টি স্থাপনার তালিকা করা হলেও এ তালিকা আরও বড় হবে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সতর্কভাবে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলে উচ্ছেদ অভিযানের আগে কোনক্রমেই এসব তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে রাজি নয় রাজউক। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযানের জন্য যেসব তালিকা করা হয় সেই তালিকায় কোন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পারলে অভিযানের আগেই এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশে তালিকা থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নাম মুছে দেন। ফলে অভিযানের সার্বিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সূত্র জানায়, তালিকার মধ্যে প্রাথমিকভাবে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্তরাঁগুলোকে উচ্ছেদ করা হবে। এর মধ্যে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও বারিধারা ডিওএইচএস এলাকায় গড়ে উঠা সকল হোটেল ও রেস্তরাঁ অপসারণ কাজ শুরু করা হবে। তবে ধানম-ির মতো আবাসিক এলাকায় যেভাবে অতি দ্রুতগতিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে সেখানে রাজউকের তালিকায় মাত্র ১৭৩টি অবৈধ স্থাপনা থাকায় ওই এলাকায় বসবাসকারীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, এ সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছাবে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের তালিকায় রয়েছে আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা বার, গেস্ট হাউস, বেসরকারী কমিউনিটি সেন্টার, ফিটনেস সেন্টার, স্পা, বিউটি পার্লার, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, কলেজ, কোচিং সেন্টার, বুটিকের দোকান। এছাড়া আবাসিক এলাকার কোন প্লটের বেজমেন্ট বা ভূ-তলের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা বন্ধ রেখে তা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করলে, সেগুলোও উচ্ছেদ করা হবে বলে জানা গেছে। অপর একটি সূত্র জানায়, রাজউকের নকশা অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৩ লাখ ২০ হাজার হোল্ডিংয়ের মধ্যে প্রায় পৌনে তিন লাখই আবাসিক ভবন। এর মধ্যে অনুমোদিত ৫৪ হাজার আবাসিক ভবন ও সাত হাজার সরকারী প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে ঢাকার বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, ধানম-ি, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজউক এবং পূর্ত বিভাগের দেয়া আবাসিক প্লট রয়েছে। এসব আবাসিক এলাকার বেশকিছু ভবনে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এর মধ্যে বনানীতে ৩৯৯, গুলশানে ৯০৪, উত্তরায় ১ হাজার ৪৯, মিরপুরে ১ হাজার ৮৩৬, মোহাম্মদপুরে ১ হাজার ৫৫২ ও ধানম-িতে ১ হাজার ১৭০টি আবাসিক ভবনসহ মোট ৬ হাজার ৯১০টি ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। এছাড়া বারিধারার কয়েকটি ভবনেও বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে বলে রাজউক সূত্রে জানা গেছে। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় নজিরবিহীন জঙ্গী হামলার পর অভিজাত এসব এলাকার অননুমোদিত স্কুল-কলেজ, হোটেল-রেস্তরাঁ ও হাসপাতাল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে রাজউক এলাকায় স্থাপিত সকল অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অপর একটি সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে হোটেল রেস্তরাঁ ও সকল অস্থায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালগুলো সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তিন মাস সময় দেয়া হতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ৩ মাসের মধ্যেই গুলশান, বনানীসহ রাজধানীর সকল অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিয়ে পূর্বের ন্যায় আবাসিক এলাকায় ফিরয়ে আনব। এ লক্ষ্যেই আমরা বেশ কয়েক মাস যাবত কাজ করছি। আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক স্থাপনা সরাতেই হবে। আমরা ইতোমধ্যেই রাজউকের মাধ্যমে অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করেছি। ৫টি জোনে এর সংখ্যা এক হাজার ৬শ’ ২৫টি। তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানে বিরুদ্ধে যে কোন দিন উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করা হবে। সংশ্লিষ্ট কাউকেই কোনক্রমেই ছাড় দেয়া হবে না। এ বিষয়ে রাজউক কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এসব তালিকায় নতুন নতুন আরও প্রতিষ্ঠানের নাম সংযুক্ত হবে। ইচ্ছা করলেই যে কোন সময় সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয় বিধায় আমরা স্কুল-কলেজ বা হাসপাতালগুলোকে অবৈধ এসব স্থান থেকে সরিয়ে নিতে তাদের তিন মাসের নোটিস দেব। এর মধ্যে অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নিতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তাকারী বাড়ির মালিকদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির মালিকের বিরুদ্ধেও আইন ভঙ্গ করে অনুমতি ছাড়া কোন রেস্তরাঁ গড়ে তুলতে অনুমতি দেয়া হলো সে বিষয়ে আমরা আইনী ব্যবস্থা নেব। গুলশানের ভয়াবহ জঙ্গী হামলার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, রেস্তরাঁ, হোটেল বা এসব প্রতিষ্ঠান এমন সব স্থানে গড়ে উঠেছে যে এ বিষয়ে কোন তথ্যই রাজউক বা সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় থানার পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও নেই। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনটির কোথায় বিদেশীরা আসা-যাওয়া করেন তা বলা মুশকিল হয়ে পড়ে। ফলে এসব হোটেল বা রেস্তরাঁয় আসা-যাওয়াকারী বিদেশীদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে অনুমতি সাপেক্ষে রাজউকের কমার্শিয়াল এলাকায় গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সরকারের সকল সংস্থার কাছে তথ্য থাকে বিধায় এসব স্থানে যাতায়াতকারীদের নিরাপত্তা প্রদানসহ সকল সমস্যার সমাধান সহজ হয়। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টটি সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, অতি নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় তৈরি করা এ রেস্তরাঁটি সম্পর্কে রাজউকের কাছে কোন তথ্য ছিল না। তবে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, তালিকায় থাকা স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালগুলোকে প্রয়োজনে রাজউকের উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পে সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন। তবে এজন্য জমি দেয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তারা আবেদন করলে তা বিবেচনা করা হবে। তবে আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরাতেই হবে। এক্ষেত্রে কাউকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। গুলশানের একটি ঘোষিত বাণিজ্যিক এলাকার বাইরে আর কোথাও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে দেয়া হবে না। উল্লেখ্য, হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় ১৭ বিদেশীসহ অন্তত ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর ঈদের ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবসে সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে গুলশান ও আশপাশের এলাকায় অননুমোদিত এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে গত ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের আবাসিক প্লট ও ভবন থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরাতে ছয় মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়।
×