ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বসুন্ধরা ও শেওড়াপাড়ায় জঙ্গী নেটওয়ার্কের সন্ধান- গোয়েন্দা জালে আটকা পলাতকরা ॥ নর্থ সাউথের প্রো-ভিসিসহ ৪ জন আট দিনের রিমান্ডে

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় রাজনৈতিক কানেকশন

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৮ জুলাই ২০১৬

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় রাজনৈতিক কানেকশন

শংকর কুমার দে ॥ গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় জঙ্গী নেটওয়ার্কটির সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। গুলশান ও শোলাকিয়া সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা, ছককষাসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এমন প্রায় এক ডজন জঙ্গী সদস্য এখন গোয়েন্দা জালে আটকা পড়েছে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ীই নর্থ সাউথের প্রো-ভিসিসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ দিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত। এ ছাড়াও মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় আরও একটি জঙ্গী আস্তানা খুঁজে পেয়ে সেখান থেকে গ্রেনেড রাখার বালুভর্তি কার্টন, কালো কাপড়, জঙ্গীদের কাপড়সহ বিভিন্ন মালামাল উদ্ধার ও জঙ্গীদের আশ্রয়দাতা বাড়ির মালিক নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। জঙ্গী হামলার পর জিজ্ঞাসাবাদে ও অনুসন্ধানে গোয়েন্দা সংস্থা ও তদন্তকারীরা যে তথ্য পেয়েছে তাতে জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলে কানেকশন থাকার তথ্য স্পষ্ট। সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে জঙ্গীদের দিয়ে বিদেশীদের জিম্মি করার পর হত্যা করানোর ঘটনাটি ছিল রাজনৈতিক দলের ছক। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এই ধরনের খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নেপথ্যে থাকা রাজনৈতিক দলের ছককষা ফাঁদে ফেলে ধর্মের নামে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে ধর্মপ্রাণ ছাত্র-যুবকদের একাংশকে জঙ্গী গোষ্ঠীতে পরিণত করাটার মধ্যে আছে একটা নীলনক্সা। এসব ছাত্র-যুবকদের মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে উম্মত্ততা সৃষ্টি ও বিভ্রান্ত করে জঙ্গী সদস্য বানানোর পরিকল্পনাটি দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিতেই গুলশান, শোলাকিয়াসহ একের পর এক জঙ্গী হামলা ঘটাচ্ছে নেপথ্যে থাকার রাজনৈতিক গোষ্ঠী। গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কিংবা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত আছে এমন জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য পাওয়ার পর জঙ্গী নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গুলশান ও শোলাকিয়া সন্ত্রাসী হামলায় জঙ্গী গোষ্ঠীর যেসব জঙ্গী সদস্য জড়িত তার মধ্যে অন্তত এক ডজন জঙ্গী সদস্য আটক হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে মামা খালেক, বাইক হাসান ওরফে নজরুল, জাহাঙ্গীর, রিয়াজুল, মেহেদী, রাহুল, সুভাষ, তৌফিকুল, রিপন, বিজয়, আরিফুল অন্যতম। তাদের অনেকেই গুলশান ও শোলাকিয়া সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। বসুন্ধরা ও শেওড়াপাড়ার ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করেছে তারা। গুলশান ও শোলাকিয়া সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় যেসব জঙ্গী পলাতক ছিল আটককৃতরাই সেই সব জঙ্গী। যেসব জঙ্গীকে আটক করা হয়েছে তাদের আটকের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে স্বীকার করা হচ্ছে না। এসব জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই জঙ্গী নেটওয়ার্ক, রাজনৈতিক দলের কানেকশন ইত্যাদির তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। ৪ জন ৮ দিনের রিমান্ডে, জামিন নামঞ্জুর ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলাকারী জঙ্গীদের সহযোগিতার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন আহসানসহ ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। রবিবার ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ তসরুজ্জামান আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডকৃত অপর আসামিরা হলো, ড. গিয়াস উদ্দিনের ভাগ্নে আলম চৌধুরী এবং জঙ্গীদের ভাড়া করা বাড়ির ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান তুহিন ও রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ার জঙ্গীদের ভাড়া দেয়া বাড়ির মালিক মোঃ নুরুল ইসলাম। কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ইন্সপেক্টর হুমায়ুন কবির ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে হাজির করেন তাদের। কোর্ট রিপোর্টার জানান, রিমান্ড আবেদনে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু এবং প্রসিকিউশন পুলিশের সহকারী কমিশনার মিরাস উদ্দিন বলেন, হামলাকারী জঙ্গীরা ড. গিয়াস উদ্দিনের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়ক, ব্লক-ই, টেনামেন্ট-৩-এর ফ্ল্যাট এ/৬ এ এবং মিরপুরের শেওড়াপাড়ার নুরুল ইসলামের বাসা ভাড়া নেয়। শনিবার বিকেলে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ভবন থেকে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্য গিয়াস উদ্দিন আহসানসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত অপর ৩ জন হলো- গিয়াস উদ্দিনের ভাগ্নে আলম চৌধুরী এবং বসুন্ধরার ওই ভবনের ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান তুহিন। আর রাতে ঢাকার পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় আরেক বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় শিক্ষক নূরুল ইসলামকে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আগে পাঁচ জঙ্গী বসুন্ধরা ও শেওড়াপাড়ার ওই দুই বাসায় আশ্রয় পেয়েছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য। হামলার দিন পর্যন্ত তারা ওই বাসায় অবস্থান করেছিলেন। হামলাকারীদের বাসা ভাড়া দিলেও নিয়ম অনুযায়ী তাদের সম্পর্কে পুলিশের কাছে কোন তথ্য দেয়নি তারা। যেহেতু হামলাকারী হামলার দিন পর্যন্ত উক্ত বাড়িগুলোয় অবস্থান করছিলেন তাই ওই বাড়িগুলোতে অবস্থান করে তারা হামলার পরিকল্পনা করতে পারেন। এছাড়া হামলাকারীদের বাসা ভাড়া দিয়ে আসামিরা গোপন করায় তারাও এই মামলার সঙ্গে থাকতে পারে মর্মে ধারণা করা হচ্ছে। তাই আসামিদের উক্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য রিমান্ডের প্রয়োজন। অপরদিকে আসামিপক্ষের মধ্যে গিৃয়াস উদ্দিনের পক্ষে এ্যাডভোকেট আরফান উদ্দিন খান এবং নুরুল ইসলামের পক্ষে এ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন রিমান্ড বাতিল করে জামিন দেয়ার আবেদন করেন। আবেদনপত্রে বলা হয়, আসামি গিয়াস উদ্দিন সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিক হলেও দেখা শোনার দায়িত্বে ছিল আসামি আলম চৌধুরী এবং মাহবুবুর রহমান তুহিন। তাই হামলাকারীদের সম্পর্কে গিয়াস উদ্দিনের কোন ধরণাই নেই। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক, শিক্ষকতাই তার ধ্যান-জ্ঞান। আবেদনে আসামি নুরুল ইসলামকেও নিরাপরাধ দাবি করে বলা হয়, তিনি একজন হাইস্কুল শিক্ষক এবং তিনি কোন তথ্য গোপনও করেননি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গুলশান হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার ঘটনায় জড়িত জঙ্গীদের বাড়িভাড়া দেয়ার ও তাদের তথ্য গোপনের অভিযোগে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্যসহ তিনজনকে আটক করা হয়। এছাড়া এই জঙ্গীদের মদদদাতা সন্দেহে নুরুল ইসলামকে গতকাল রাজধানীর ৪৪১/৮ পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নুরুল ইসলাম মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি থেকে একটি হাতে তৈরি গ্রেনেড ও জঙ্গীদের ব্যবহৃত কালো পোশাক উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। যা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তা ॥ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেছেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়কের ব্লক- ই-এর ৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের এ/৬ নম্বর ফ্ল্যাটে বালুভর্তি কার্টন এবং জঙ্গীদের কাপড়সহ বিভিন্ন মালামাল পাওয়া গেছে। সেখানে গুলশানে হামলাকারীরা মিলিত হয়েছিলেন। আর বালুভর্তি এসব কার্টনে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড রাখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর রাজধানীর মিরপুরের ৪৪১/৮ পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসাতেও ‘জঙ্গীদের ব্যবহৃত হাতে তৈরি গ্রেনেড, কালো রঙের পোশাক’ পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ না করা এবং তথ্য গোপন করার অভিযোগে বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। গুলশান হামলার ঘটনায় ৪ জুলাই রাতে গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস বাদী হয়ে সন্ত্রাস দমন আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। পরে মামলার তদন্তভার দেয়া হয় কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে। গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালায় জঙ্গীরা। হামলায় ১৭ বিদেশী নাগরিক ও ৩ বাংলাদেশীসহ ২০ জন নিহত হয়। এছাড়া হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও। আহত হন ৩০ পুলিশ সদস্য। তিন থেকে চার জন থাকত শেওড়াপাড়ায় ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলাকারী জঙ্গীদের আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত হওয়া রাজধানীর শেওড়াপাড়ার ওই বাড়িতে মোট ৩ থেকে ৪ জন থাকত বলে জানিয়েছেন পাশের ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দা। গত ১৬ জুলাই দিবাগত রাতে দ্বিতীয় বারের মতো এই বাড়িটিতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এর আগেও গত ১৩ জুলাই দিবাগত রাত ৪টার দিকে এখানে একবার অভিযান চালানো হয়। বাড়ির এক বাসিন্দা বলেছেন, এর আগে বুধবার রাতে ৪টার দিকে ডিবি পুলিশ দুই জনকে হেলমেট পরিয়ে নিয়ে এসেছিল। সে সময় ঘরের দরজা বাইরে থেকে লাগানো ছিল। এ সময় তালা ভেঙ্গে একটি পাঞ্জাবি ও জায়নামাজ পান। তারা সেগুলো নিয়ে যান। এরপর সেখানে বাড়ির মালিক তালা লাগিয়ে দেন। এরপর গতকাল রাতে ১২টার দিকে আরেকবার অভিযান চালিয়ে ঘরে গ্রেনেড পায় ও কালো পোশাক পেয়েছে বলে দাবি করে পুলিশ। এরপর সেখানে পুলিশ একটি তালা লাগিয়ে দেয়। ঈদের পরের দিনও ওই ফ্ল্যাটে এক যুবককে দেখা গেছে। ফ্ল্যাটটিতে সব মিলিয়ে যে ৩ থেকে ৪ জনকে আসা যাওয়া করতে দেখা গেছে তাদের প্রত্যেকের বয়স আনুমানিক ১৮ থেকে ২২ বছর। প্রায় ৩ মাস আগে বাসা ভাড়া নেয় তারা। বেশিরভাগ সময়ই বাসাটির দরজায় বাইরে থেকে তালা দেয়া থাকত। মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে তালা দেয়া থাকলেও ভেতরে লোক থাকত বলেও দাবি করেন তিনি। এতে সন্দেহ দেখা দিলে তিনি বাড়ির মালিককেও জানিয়েছিলেন প্রতিবেশী ও বাসিন্দারা। জবাবে বাড়ির মালিক তাকে বলেন, ‘ওরা ছাত্র মানুষ, পড়াশোনা করে মনে হয়।
×