ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পারিবারিক মূল্যবোধ ও আগামীর পথ চলা

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৮ জুলাই ২০১৬

পারিবারিক মূল্যবোধ ও  আগামীর পথ চলা

সময়ের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাপন। নানা জটিলতার বেড়াজালে বন্দী আমাদের স্বাভাবিক জীবন আর আগের মতো সহজ সরল স্বাভাবিক থাকছে না। প্রাত্যহিক জীবনে নিত্য তাড়া করে ফিরছে বিচিত্র সঙ্কট। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির। ঘটছে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আজকাল পত্রিকার পাতা ওল্টালেই তেমনি অস্বস্তিকর, অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনার খবর দেখছি আমরা সবাই। ‘স্বামীর নির্যাতনে স্ত্রীর মৃত্যু’, ‘স্ত্রীর পরকীয়ায় বাধা হওয়ায় স্বামী খুন’, ‘সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ সংঘাতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন’, ‘মাদকাসক্ত ছেলের হাতে বাবা খুন,’ ‘ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা সইতে না পেরে তরুণ-তরুণীর আত্মহত্যা’ ইত্যকার খবরগুলো এখন প্রতিদিন সবার চোখে পড়ে। এ ধরনের খবরগুলো যে কোন বিবেকবান মানুষকে খুব সহজেই আলোড়িত করে, বিচলিতও করে। আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এখনকার চিত্র ভিন্ন। আগে কালেভদ্রে এ জতীয় ঘটনা ঘটলেও এখন এর হার অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আমাদের চারপাশে প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখে হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা কোন পথে এগোচ্ছি, আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কি লোপ পাচ্ছে, আমরা কি দিনে দিনে সভ্য সুশিক্ষিত আধুনিক মুক্ত চিন্তা-চেতনার দাবিদার হওয়ার বদলে অসভ্য, বর্বর মানবিক মূল্যবোধহীন হয়ে পড়ছি? শহরে নাগরিক জীবনযাপনে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতিক্রিয়ায় হয়ত পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন ও সম্পর্কে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে আটপৌরে সাধারণ জীবনে যান্ত্রিকতা বাসা বাঁধছে। পুরনো প্রচলিত মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চেতনা, নৈতিক আদর্শিক ভাবধারা ক্রমেই মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। এখন হৃদয়বৃত্তিক আকর্ষণের বদলে সবাই বিত্তবৈভবে প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি অর্জনে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠেছি। যে কোন উপায়ে সহজ সংক্ষিপ্ত উপায়ে বড়লোক মানে ধনী হওয়ার নেশায় পেয়ে বসেছে সবাইকে। এজন্য নৈতিক অধঃপতন ঘটছে অনেকের। তারা নিয়মনীতি, ধর্মীয় বিধিনিষেধ, আদর্শিক ভাবধারা কোনটিরই তোয়াক্কা করছে না। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য যে কোন উপায় অবলম্বন করতে বিব্রত হচ্ছে না তারা। দুর্নীতি, অসততা, অনিয়ম, প্রতরাণা, লোভ লালসার কাছে প্রতিনিয়ত আত্মসমর্পণ করতে দ্বিধা সঙ্কোচ করছে না। এক শ্রেণীর মানুষ। মনুষ্যত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে পশুত্বকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে তারা। এভাবেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি অবক্ষয়, অসততা, প্রতারণা, লাম্পট্য ব্যভিচার, অনিয়ম, লোভ আর নির্মমতা। যার ফলে প্রতিদিনই ঘটছে অসদাচরণের বিচিত্র সব ঘটনা। হতাশা, বঞ্চনা, ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে ভুল পথে ধাবিত হচ্ছে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এভাবেই হাজার হাজার নারী-পুরুষ। আজ মাদকাসক্তি আমাদের গোটা সমাজকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। এ জন্য চিন্তিত সবাই। ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, মদ, হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে জগত সংসার, বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কত মানুষ তার হিসাব জানা নেই কারও। মাদকাসক্তের পেছনে কি কি কারণ রয়েছে তা অনুসন্ধান করতে হবে। কেন পারিবারিক বলয়ের মধ্যে থেকেও স্বপ্ন সম্ভাবনা ভবিষ্যৎ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। হতাশা থেকে তৈরি হচ্ছে জীবন সঙ্কট। এর জন্য প্রয়োজন স্বপ্ন ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। মাদকের পেছনে রয়েছে একটি ব্যবসায়িক চক্র। তাদের চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া দরকার। মানসিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এর মারাত্মক বিপর্যয়ের চিত্রটি শিক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের জানিয়ে দিতে হবে। শ্রমজীবী সাধারণ দরিদ্র মানুষ থেকে প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষরাও মাদকাসক্ত হচ্ছে। দুটির কারণ ভিন্ন। এই কারণগুলো যথাযথভাবে জানার জন্য একটি জাতীয় কার্যক্রম থাকতে হবে এবং প্রতিরোধের জন্য সমাজের ভেতর থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। মানবতার ভবিষ্যত রচিত হয় পরিবারকে কেন্দ্র করে। মূলত পরিবার হলো সমাজের মৌলিক কোষ বা সেল। এ কারণেই একটি সুন্দর সুস্থ সচ্ছল সুখী পরিবার একটি সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করে। অন্যদিকে দুর্বল পরিবার সমাজে ঘুণ ধরায়। আগে আমাদের সমাজ যৌথ পরিবারের প্রাধান্য ছিল। যৌথ পরিবারের এক চুলার ধারণা ছিল। একই উঠোনে সবার হাসি-কান্না, আনন্দ বেদনা এক জোট হতো এই অন্নে। একে বলা হতো একান্নবর্তী। পরিবারের একজন থাকতেন ছায়ার মতো। সুখে-দুঃখে তিনিই সবাইকে আগলে রাখতেন। এক সময় সামাজিক অটুট বন্ধনে যৌথ পরিবার ছিল নিউক্লিয়াসের মতো। সামাজিক নানা প্রক্রিয়ায় আজকাল পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভাঙ্গন শুধু পরিবারে নয়, মূল্যবোধেও তা আঘাত হানছে। আমাদের চারপাশে দাম্পত্য কলহ সঙ্কট ক্রমেই জটিল হচ্ছে। যে কারণে ডিভোর্স, সেপারেশনের ঘটনা নগরজীবনে অহরহ ঘটছে। লিভ টুগেদার আর পরকীয়া শব্দ দুটোর প্রকোপ বাড়ছে দিনে দিনে। স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সহানুভূতি আস্থার সঙ্কট প্রকট হচ্ছে। অবিশ্বাস, সন্দেহ, রুচি বিকৃতি, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে যৌন অপরাধ বাড়ছে। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলায় আজকাল বিবাহিত নারী-পুরুষ খুব সহজেই পরপুরুষ কিংবা পরনারীতে আসক্ত হচ্ছেন। যার সুযোগ একশ্রেণীর অপরাধী প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মিথ্যে পরিচয়ের ফাঁদে ফেলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর নারী পুরুষের সঙ্গে প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইলিং এর আশ্রয় গ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রায় সময়েই দেখা যাচ্ছে। প্রেমিক সেজে কিংবা নানাভাবে ভয় দেখিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসবের ভিডিও চিত্র ধারণ করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কিংবা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনাগুলো আমাদের শিহরিত, আতঙ্কিত করছে। আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসম্মানের ভয়ে গোপন রাখা হয়। আত্মহনন কিংবা এ ধরনের কিছু হলে কেবল সে ক্ষেত্রে তা প্রকাশ পায়। পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাপে শান্তি আর আনন্দময় সেই মডেল পরিবার আর থাকছে না। স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার বন্ধনে বাসা বাঁধছে কৃত্রিমতা। শিক্ষার প্রসার ঘটছে সত্য, কিন্তু তাতে ‘ফ্রিডম’, ‘ফ্রিনেস’ শব্দগুলো ভাঙ্গনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে, শিল্পায়নও হচ্ছে। মানুষ বাড়ছে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধ।পাল্টে যাওয়া জীবনযাপনে পরিবর্তনগুলোকে পজেটিভভাবে দেখে এর মন্দ প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। নৈতিক অধঃপতন থেকে নিজেকে সচেতন হতে হবে দাম্পত্য জীবনে সাধারণ রক্ষার ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। দাম্পত্য জীবনে সাধারণ ছোটখাটো অনেক ঘটনাই ঘটে। সেগুলোকে আর বেশি এগোতে না দিয়ে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ। নৈতিকভাবে দুর্বল হলেও প্রতারক দুর্বৃত্ত আপনার ওপর সুযোগ নিতে পারে। অতএব, এ ব্যাপারে সব অস্বস্তি, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা, হতশা, অপরাধবোধ কাটিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় প্রাত্যহিক কর্মকা- পরিচালিত করতে হবে। রাতারাতি সব অসঙ্গতি অন্যায় অনিয়ম দূর করা যাবে না এটা মাথায় রেখে পজেটিভ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে ধীরে সুস্থে ভেবেচিন্তে। ছবি : শেখ সাদি মডেল : আকাশ ও মৌ পোশাক : রং বাংলাদেশ মেকআপ : পারসোনা কোরিওগ্রাফি : শাওন রহমান
×