ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তাক্ত ফ্রান্স

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১৮ জুলাই ২০১৬

রক্তাক্ত ফ্রান্স

আবার রক্তাক্ত হলো ফ্রান্স। আট মাস আগের ভয়াবহ জঙ্গী হামলায় আক্রান্ত দেশটি বার বার হামলার শিকার হচ্ছে। জঙ্গীদের শিকড় সম্ভবত অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। মুক্তচিন্তা, খোলামেলা পরিবেশ ও শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির তীর্থস্থান ফ্রান্স। চেনা ফ্রান্সের সেই চিত্রটি গত দেড় বছরে বদলে গেছে। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ব্যঙ্গচিত্রের পত্রিকা শার্লি এবদোর হামলা দিয়ে শুরু। তারপর গত বছরের নবেম্বরে একসঙ্গে ছয়টি স্থানে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এবারে ১৪ জুলাই জাতীয় দিবস পালনকালে নৃশংস অধ্যায়টি সংঘটিত হয়। ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় বাস্তিল দুর্গের পতনের বার্ষিকীতে ইতালির সীমান্তবর্তী ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী শহর নিসে আতশবাজির উৎসবে জড়ো হওয়া জনতার ওপর পঁচিশ টন ওজনের ৮০ কিলোমিটার বেগে চলা ট্রাক তুলে দিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুদের পিষে মারা হয়। সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের দিবস হিসেবে যখন মানুষ তা পালন করছিল, তখন এই বীভৎস হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব বিবেককে কাঁপিয়ে তুলেছে। একজন চালক জনতার মধ্য দিয়ে ভারি ট্রাকটি মাড়িয়ে নিয়ে যায় দু’কিলোমিটার অবধি। ঘটনার একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে ট্রাকচালক নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার আগে চালকও গুলি চালিয়েছে। ট্রাকের ভেতর আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড পাওয়া গেছে। তিউনিসিয়ার বংশোদ্ভূত একত্রিশ বছর বয়সী ফরাসী নাগরিক চালকের পরিচয় উদ্ধার করা গেছে। ধারণা করা যায়, এর পাশাপাশি ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসবিরোধী সামরিক অভিযানে ফ্রান্সের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। তবে প্রশ্ন উঠেছে পরপর এসব হামলার ঘটনা কেন রুখতে পারছে না ফ্রান্সের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো? কেন নিরীহ, অসহায় নাগরিক বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন। জঙ্গীদের সম্পর্কে যে এখনও সজাগ হয়ে ওঠতে পারেনি ফ্রান্স, এই ঘটনা তা প্রমাণ করে। দেশে জরুরী অবস্থা ও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এই নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস ফ্রান্সে। জনসংখ্যার প্রায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মুসলিম। এরা দীর্ঘদিন ধরে বাস করলেও ইউরোপের মূল সমাজ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে গেছেন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা পিছিয়ে আছেন। এদের একাংশের মধ্যে সহজে জিহাদী মতবাদ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে আইএসের মতো জঙ্গী সংগঠন। বিশেষত তরুণদের মধ্যে। সামাজিক মাধ্যমের বিপুল বিস্তারের কারণে সেই কাজ আরও সহজ হয়েছে। আইএস প্রতিষ্ঠার পর ফ্রান্স থেকে সিরিয়ায় যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। ইউরোপ থেকে প্রায় ছয় হাজার জিহাদী সিরিয়া গেছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় অংশ ফ্রান্স থেকে। নিসে যে ধরনের হামলা হয়েছে, স্থানীয় স্তরে সমর্থন না থাকলে এই হামলা চালানো সম্ভব নয়। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। রাতের আকাশজুড়ে যখন ঝিঁঝিয়ে উঠছিল আতশবাজির অগ্নিফুল; তখন মাটিতে মানব হত্যায় লিপ্ত একটি ট্রাক ও তার চালক। নিসেতে ঝরে গেল ৮৪টি প্রাণ। ফরাসী প্রেসিডেন্ট বলেছেন, পুরো ফ্রান্স ইসলামী সন্ত্রাসবাদের হুমকির মধ্যে রয়েছে। এই ঘটনা যে সন্ত্রাসী হামলা তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শক্তিশালী দেশটি মানুষের জীবন রক্ষা করতে কেন পারেনি? সে উত্তর নিশ্চয় তারা দেবেন। সংঘটিতভাবে চালালে এই সন্ত্রাসের শিকার শুধু ফ্রান্স নয়, একার্থে সারাবিশ্বই। আইএস নামক ভয়াবহ ‘বিষফোঁড়া’ তথা দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে যে কোন মূল্যে সারিয়ে তুলতে হবে সারাবিশ্বকে। তা না হলে বিশ্ববিবেক ও মানবতা মুক্তি পাবে না। মিলবে না শান্তির সুবাতাস। বিশ্ব মানবতার কল্যাণের লক্ষ্যে শুভবোধ জাগ্রত রাখা এবং শুভশক্তির ঐক্য খুব জরুরী। নিহতদের স্বজন ও ফ্রান্সের নাগরিকদের প্রতি রইল গভীর সমবেদনা।
×