ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঝিনাইদহে জঙ্গীদের মেসে নিবরাসের সঙ্গে আবিরও ছিল

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৭ জুলাই ২০১৬

ঝিনাইদহে জঙ্গীদের মেসে নিবরাসের সঙ্গে আবিরও ছিল

এম. রায়হান, ঝিনাইদহ থেকে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার অন্যতম নায়ক নিহত নিবরাস ইসলাম ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গী আবির হাসানের অবস্থান ছিল ঝিনাইদহে। তারা দু’জনই ঝিনাইদহ শহরের সোনালীপাড়ার মেসে থাকত। তাদের সঙ্গে ছিল আরও ৬ জন। এ ৮ জনের মধ্যে স্থানীয় কিছু যুবক ছবি দেখে নিবরাস ইসলাম ও আবির হাসানকে শনাক্ত করতে পারলেও বাকিদের কারও পরিচয় জানাতে পারেনি। তবে তারা সবাই জঙ্গী বলে ধারণা এলাকাবাসীর। এদের মধ্যে নিবরাস ইসলাম সাইদ নামে ও আবির হাসান শাওন নামে পরিচিত ছিল। নিবরাস ইসলাম আবির হাসানকে তার খালাত ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিত। শহরের অত্যন্ত জনবহুল পাড়ায় দীর্ঘ প্রায় ৪ মাস জঙ্গীদের বসবাসের খবর চাউর হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতি দেখা দিয়েছে। পুরো পাড়ায় চলছে সুনশান নীরবতা। ঘর থেকে নারি-পুরুষ খুব একটা বের হচ্ছেন না। ঘরের ভিতরে থেকে কথা বলছেন নারীরা। পাড়ার একটি ছোট মাঠে জঙ্গী নিবারস ইসলাম ও আবির হাসানকে যারা ফুটবল খেলতে দেখেছেন এমন কয়েকজন যুবক ছবি দেখে তাদের চিনতে পারেন বলে জানিয়েছেন। শনিবার সরেজমিন সোনালীপাড়ার একাধিক নারী-পুরুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিবরাস ইসলাম সাইদ পরিচয়ে যখন আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলত তখন মাঠের ধারে আবির রহমান ওরফে শাওন চুপচাপ বসে থাকত। কখনও কখনও সে ছোট ছেলেদের সঙ্গে টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলত। অনেকের ধারণা ওই মেসের ৮ জনই হয়ত জঙ্গীবাদের সাথে জড়িত থাকতে পারে। তবে এ ব্যাপারে পুলিশ কিছু জানে না বলে জানিয়েছে। তারা মুখে কুলুক এটেছেন। ঝিনাইদহ শহরের সোনালীপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য কওছার আলীর বাড়ির আঙিনায় উঁচু দেয়ালঘেরা গাছ-পালা বেষ্টিত নিরিবিলি পরিবেশে টিনের চালার ৪ রুমবিশিষ্ট একটি মেস। বর্তমানে ওই এলাকায় জন-মানুষের নিস্তবদ্ধতা। বাড়িটির গেট ও জানালা দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ। ওই পাড়া ঘুরে বিভিন্ন মানুষকে জঙ্গীদের ছবি দেখালে কয়েকজন যুবক তাদের চেনেন কথা জানান। সোনালীপাড়ার কলেজছাত্র মোবিনুল ইসলাম হৃদয় জানান, আমি যশোর বিএএস শাহীন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমাদের বাসা সংলগ্ন পাড়ার ছোট একটি ফুটবল খেলার মাঠ। লেখা-পড়ার অবসরে সে হৃদয় ওই ফুটবল খেলা করত। আমরা ১৮-২০ জন ছেলে ফুটবল খেলতাম। আমাদের সাথে প্রায়ই ফুটবল খেলত নিবরাস ইসলাম ওরফে সাইদ। তার সাথে থাকত আবির হাসান ওরফে শাওন। আমি আগে তাদের চিনতাম না। পরে ছবি দেখে চিনেছি যে সাইদ পরিচয়দানকারী ব্যক্তি জঙ্গী নিবরাস ইসলাম ও শাওন পরিচয়দানকারী ব্যক্তি জঙ্গী আবির হাসান। আবির ওরফে শাওনকে সাইদ তার খালাত ভাই বলে আমাদের কাছে পরিচয় দিত। তিনি আরও জানান, নিবরাস ইসলাম ছিল খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। আর আবির থাকত চুপচাপ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, আবির হাসান ওরফে শাওন নিবরাস ইসলামের সাথে সব সময়ই ঘুরে বেড়াত। প্রায় প্রতিদিন ফুলবল খেলার মাঠে আসত। রোজার মাসে তারা দু’জনেই রোজা রেখেছে। পাশের মসজিদে ইফতার করত। পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলত। একাধিক কিশোর আবির হাসানের ছবি দেখে বলেন, এর নাম শাওন বলে আমরা জানি। নিবরাস ইসলাম ওরফে সাইদ যখন ফুটবল খেলত তখন তার সাথে সে এসে মাঠের এক পাশে বসে থাকতো। আমরা পত্রিকা ও টিভিতে ছবি দেখে জানতে পেরেছি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় নিহত আবির হাসান ও নিবরাস ইসলাম এই মেসে ছিল শাওন ও সাইদ পরিচয়ে। এছাড়া ওই মেসের বাকিরাও জঙ্গী হতে পারে বলে তাদের ধারণা। এ ছাড়া ওই মেসে প্রতিদিন মোটর সাইকেলে লোকজন যাতায়াত করত। মেসের মালিক সোনালীপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য কওছার আলী। শনিবার তার বাড়িতে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও কেউ ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসেননি। ফলে তাদের পরিবারের কারও সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। কওসার আলীর প্রতিবেশী তানিয়া ভিলার মালিক তানিয়া জেসমিন বলেন, আমাদের বাড়ির পাশে এই মেস। এক বছর আগে মেসটি চালু করা হয়। এই মেসের ৪টি কক্ষে মোট ৮ জন ছিল। সোনালীপাড়া জামে মসজিদের পাশেই এই মেস। মেসে যারা ছিল তাদের মধ্যে দু’জনের নাম শোনা যাচ্ছে। আমি তাদের চোখে দেখিনি। এদের মধ্যে দুজনকে আমাদের মসজিদের হুজুর (ইমাম) রোকনুজ্জামান মেস ঠিক করে দেন। ২৮ রমজানের আগেই মেস থেকে ৮ জনই চলে যায়। এর পর আর কেউ ফিরে আসেনি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ওই মেসে যারা ছিল তাদের কারণে আজ ভাল মানুষ বিপদে পড়েছেন। প্রতিবেশী অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য কওসার আলী ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি রোজার শেষ দিকে বাড়ির পাশের মসজিদে ১০ দিন এতেকাফে ছিলেন। ঈদের আগের রাতে বাড়িতে আসেন। তার দুই ছেলে বিনসার আলী ও বিনজির আলী কলেজে পড়াশুনা করে। তাদের চলা ফেরায় আমি কোন খারাপ কিছু দেখিনি। তিনি বলেন, আমরা সাংবাদিকদের বলছি এক ধরনের তারা লিখছেন অন্য ধরনের। প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাক, এ ঘটনায় ভাল মানুষ যেন বিপদে না পড়ে বলে দাবি করেন তিনি। প্রতিবেশী হোমিও চিকিৎসক সেলিনা আক্তার বলেন, মেসে যারা ছিল তাদের মধ্যে আমি নিবরাস ইসলাম ওরফে সাইদকে চিনি। সাইদ আমার কাছ থেকে গত ২৫ জুন দুই বোতল গেস্ট্রেজিল সিরাপ কিনে নিয়ে যায়। সে আমাদের পাড়ায় খোলামেলা ঘোরাফেরা করে বেড়াত। তাকে প্রায়ই ফুটবল খেলার মাঠে দেখা যেত। তিনি আরও বলেন, নিবরাস ওরফে সাইদ কোন সময় একা ঘুরত না। তার সাথে সব সময়ই একটি ছেলে থাকত। সে ছেলেই আবির হাসান কিনা আমি সঠিক বলতে পারছি না বলে তিনি জানান। তবে সে একটু চুপচাপ থাকত। তিনি আরও বলেন, আমাদের মসজিদের ঈমাম সাহেব অনেক জানাশোনা মানুষ। তিনি অনেক জ্ঞানগর্বের কথা বলতেন। মসজিদ সংশ্লিষ্ট বাসা হওয়ায় তার কুৎবা আমি শুনে বুঝতে পারতাম। তার খুৎবায় অনেক ইঙ্গিত বুঝা যেত। যে ধরনের কথা বলা উচিত নয় সে ধরনের কথা হুজুর বলতেন। একই পাড়ার রং মিস্ত্রি নাজমূল হাসান বলেন, আমি সাইদ বলে যাকে চিনতাম সে আসলে সাইদ নয়, তার নাম নিবরাস। গুলশান হামলার পর ছবি দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি। তার সাথে তার খালাত ভাই থাকতো। পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলার সময় প্রায়ই দেখা হতো। পরিচয় জানার পর এখন তিনি হতবাক হয়ে পড়েছেন। ভয় আতঙ্ক কাজ করছে তাদের মধ্যে। সরকারী কেসি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ও সোনালীপাড়ার মোকাররম হোসেনের ছেলে নওরজামিন বর্ষণ একই কথা জানান, তিনি বলেন ছবি দেখে আমি চিনতে পেরেছি ‘আমি সাইদ নামে যে ছেলেকে চিনতাম সে আসলে সাইদ নয়, তার নাম নিবরাস ইসলাম’। তার সাথে আমরা ফুটবল খেলতাম। সে ভাল ইংরেজী বলতে পারত। ইংলিশ গান শুনার জন্যও আমাদের বলত। হটাৎ কিছুদিন আর খেলতে আসত না। এরপর গুলশান আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার ঘটনার পর ফেসবুক, পত্রিকা ও টেলিভিশনে ছবি দেখে জানতে পারলাম এই সাইদই নিবরাস ইসলাম। সোনালী পাড়ার মোঃ কাওছার আলী বলেন, আমাদের পাড়ায় জঙ্গীদের অবস্থানের খবর আমি শুনেছি। এ ধরনের খবর জানার পর থেকে ভয়ে আতঙ্কে আছি। বাড়ি থেকে বের হতে গাঁ ছমছম করছে। আমি জানতে পেরেছি মেসে ৮জন ছিল। তাদের মধ্যে দুজন জঙ্গী। বাকি ৬ জন কারা কোথা থেকে এসেছে তা আমি বলতে পারছি না বলে তিনি জানান। ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তবে তাঁরা খোঁজ খবর নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, গত ৬ মাসে ঝিনাইদহে দু’জন হোমিও চিকিৎসক, একজন পুরোহিত ও একজন সেবায়েতসহ ৪ জনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এদের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালুহাটির গ্রামের হোমিও চিকিৎসক ছমির উদ্দিন খাজা (৭০), ১৫ মার্চ কালীগঞ্জের হোমিও চিকিৎসক হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক (৪৫), ৭ জুন করাতিপাড়া গ্রামের পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী (৭০) ও ১ জুলাই কাষ্টসাগরা গ্রামের শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল বিগ্রহ মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস গোসাইকে (৫০) কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করা হয়। প্রতিটি হত্যাকা-ের ধরন প্রায় একই ধরনের। এ সব হত্যাকা-ের মোটিভ পুলিশ উদ্ধার করেছে বলে কিছুদিন আগে পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল। তবে জঙ্গী মেসের ব্যপারে পুলিশ মুখে কুলুক এটেছে।
×