ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীপনায় জড়িতদের শেকড় একসূত্রে গাঁথা

দেশে আইএস জঙ্গী না থাকলেও ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৭ জুলাই ২০১৬

দেশে আইএস জঙ্গী না থাকলেও ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশে আইএসের কোন সক্রিয় কর্মকা- নেই। কিন্তু আইএস ভীতি ভর করে আছে। ইতোমধ্যে দেশে যেসব জঙ্গীপনার ঘটনা ঘটেছে, তার বেশ কয়েকটির দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের মতে, আইএস ভীতি সঞ্চার লক্ষ্য নিয়ে এ জাতীয় বিবৃতি আইএসের নামে প্রেরণ করা হয়ে থাকে। সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশভিত্তিক কোন তৎপরতায় তাদের কোন ফায়দা হবে না। তবে পরোক্ষভাবে এ দেশীয় মৌলবাদী ধর্মান্ধ বিশেষ করে সরকারবিরোধী ইসলামের ব্যানারে থাকা নানা গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীদের আইএসের যোদ্ধা বানানোর তৎপরতা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে জঙ্গী হামলায় নিহত, আহত এবং গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে তদন্তে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র শনিবার জনকণ্ঠকে জানায়, দেশে জঙ্গীপনায় জড়িতদের শিকড় একসূত্রে গাঁথা। মূলত জামায়াত-শিবির এবং উগ্রবাদী কিছু ইসলামী ব্যানারের কথিত রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণদের জঙ্গীপনায় জড়িত করার তৎপরতা চলছে বহু আগে থেকে। এ প্রক্রিয়ায় কত যুবকসহ জঙ্গী উন্মাদনায় উদ্বুদ্ধ বিভিন্ন বয়সের লোকজন, বিভিন্ন পথে আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ নানান স্থানে সশস্ত্র জঙ্গীপনার ট্রেনিং নিয়েছে- তার কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর সরকার পক্ষ থেকে জঙ্গীদের চিহ্নিত করার জন্য নানান পন্থায় অগ্রসর হচ্ছে গোয়েন্দারা। জঙ্গীপনার যে উন্মাদনা মাদ্রাসাভিত্তিক ছাত্রদের মধ্যে প্রোথিত ছিল, তা কী করে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশেষ করে ধনাঢ্য ব্যক্তির সন্তানদের মাঝে বিস্তৃতি ঘটেছেÑ এটা নিয়ে ব্যাপক তদন্ত শুরু হয়েছে। দেশে জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহরির, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হামজা ব্রিগেডসহ নানান নামে যেসব সংগঠন সরাসরি জঙ্গীপনার সঙ্গে জড়িত, এদের জন্মকাহিনী তদন্তে বেরিয়ে এসেছে মূল রুট জামায়াত-শিবির থেকে আসা দুর্ধর্ষ ক্যাডার বাহিনী। এরাই বিভিন্ন নামে নানানভাবে নানান স্থানে জঙ্গীপনার বিস্তৃতি ঘটাতে তৎপর হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রসমূহে জানানো হয়, দেশব্যাপী সব জেলায় একযোগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জেএমবির আত্মপ্রকাশের পর ঘটে গেছে নানান ঘটনা। গ্রেফতার হয়েছে বহু জঙ্গী। বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে কেউ কেউ। মামলা হয়েছে অসংখ্য। কিন্তু এসব মামলার সিকি পরিমাণও নিষ্পত্তি ঘটেনি। উত্তরবঙ্গ ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী ট্রেনিংয়ের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত জঙ্গীরা টার্গেট করছে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থাপনা এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। ইতোমধ্যে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মিশন এরা সম্পন্ন করেছে। জড়িত জঙ্গীদের কেউ কেউ ধরা পড়ে পুলিশী রিমান্ডে যেসব তথ্য দিয়েছে তাও প্রচারমাধ্যমে চলে এসেছে। এতে প্রতীয়মান এসব জঙ্গী সংগঠনের শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত হয়েছে এবং এসব জঙ্গীর অধিকাংশ শুরুতে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার হিসেবে সংশ্লিষ্ট ছিল। বর্তমান সরকার জামায়াত-শিবিরের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে একদিকে যেমন কঠোর মনোভাব নিয়েছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ট্রাইব্যুনাল করে বিচার কাজ সম্পন্ন করছে। ইতোমধ্যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকরও হয়েছে। এ বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবির চক্র নানান পথে নানান কায়দায় নানান তৎপরতা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিদেশে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে লবিস্ট নিয়োগ করেও সরকারকে দমানো যায়নি। ফলশ্রুতিতে গোয়েন্দাদের মতে, এরা এখন জঙ্গীপনার ব্যানারে সন্ত্রাসী তৎপরতায় নেমেছে এবং তা জোরালো অবস্থানে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল সংস্থাকে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স অবস্থান গ্রহণ করার নির্দেশনা প্রদানের পর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট সব পয়েন্টে নজরদারি কঠোর হওয়ায় এরা তেমন সুবিধা করতে পারছে না। এছাড়া গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের নীলনক্সা এবং নেতাদের নাম-পরিচয় উদ্ঘাটিত হওয়ার পর নিজেরা এখন আত্মরক্ষার পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এরপরও চোরাগোপ্তা হামলার তৎপরতা রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানানো হয়, এরা আইএস ভীতির বিষয়টি জনমনে ছড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে। বিদেশী, খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী, হিন্দু পুরোহিত সেবায়েতসহ দেশের ব্লগার ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের নৃশংস কায়দায় হত্যার মাধ্যমে এরা জানান দিতে চায় আইএস জঙ্গীদের আদলে তাদের তৎপরতা চলছে। কিন্তু সরকার বারবার আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের মানুষকে নিশ্চিত করেছে দেশে আইএসের কোন তৎপরতা নেই। যারা এ জঙ্গী কর্মকা- চালাচ্ছে এরা মূলত অতীতে সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাও পোড়াও হত্যা-গুমসহ নানান অপকর্ম চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে এখন এ পথ বেছে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে চলে যাওযায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তৎপর হয়েছে। গুলশান হামলার পর সরকার পক্ষে তাৎক্ষণিক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত হয়েছে। যদিও এ ঘটনায় ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে দুঃখজনকভাবে নির্মম ও পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এর আগে দেশে এতবড় ঘটনা আর হয়নি। ফলে সরকার জঙ্গীপনার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে নড়েচড়ে বসেছে। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সদস্য দেশগুলোকে আশ্বস্ত করেছে এই বলে যে, এদেশে জঙ্গীপনার শেকড় উপড়ে ফেলতে যা যা করণীয় এবং বিদেশীদের যেসব সহযোগিতা প্রয়োজন সবই নেয়া হবে। ওই গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মোসাদের সঙ্গে বিএনপির এক নেতার বৈঠকের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আন্দাজ করা যায় এরা দেশে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে না পেরে কোন পর্যায়ে গিয়ে চেষ্টা তদবির চালাচ্ছে। যে ইসরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই, সেই ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বিএনপির ওই নেতার বৈঠকের নেপথ্যে কারা রয়েছেন, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এ নিয়ে ব্যাপক তদন্ত চলছে। সূত্র জানায়, ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি নিজেদের অবস্থান সংহত করতে একদিকে জামায়াতকে যেমন হাতে নেয়, তেমনি জামায়াতের মাধ্যমে জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা চাঙ্গা হতে থাকে; যা ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গেছে। মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজের একশ্রেণীর ছাত্রদের মগজধোলাই ও অর্থ সহযোগিতার বিনিময়ে এবং এর পাশাপাশি ধর্মকে ব্যবহার করে আয়ত্তে এনে সহিংস সন্ত্রাসের পথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করছে। এই জামায়াত-শিবির নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে তাদের ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছে। জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং হিযবুত তাহরিরের যেসব ক্যাডার জঙ্গীপনায় জড়িত হয়ে সহিংস তৎপরতা চালাচ্ছে এবং এদের মধ্যে যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে তাদের অধিকাংশ এসেছে জামায়াত-শিবির থেকে। সঙ্গত কারণে সূত্রমতে, এদের আসল গোড়া ওই জামায়াত-শিবির। যাদের রাজনীতি রগ কেটে পৈশাচিক উন্মত্ততা প্রকাশের ঘটনার মাধ্যমে। জামায়াত-শিবির ইসলামের নামে রাজনীতি করে বলে প্রচার করলেও মূলত সহিংস পথে এরা ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এরা একবার ক্ষমতার স্বাদও পেয়ে যায়। ভবিষ্যতে এ ধরনের আশা তিরোহিত হওয়ার পর এদের বড় একটি অংশ এখন জঙ্গীপনায় জড়িত হয়েছে। বিভিন্ন নামে সংগঠন বানিয়ে এরা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে। ঘটনা ঘটানোর পর আইএসের নামে বিবৃতি দিয়ে দেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক ভীতি সঞ্চার সৃষ্টির অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের তথ্য রয়েছে। এর পাশাপাশি এরা মিয়ানমার থেকে বৈধ ও অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত করাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর ঘাঁটি গেড়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার ঘটনাও উদ্ঘাটিত হয়েছে। সর্বশেষ এসব জঙ্গী কক্সবাজার অঞ্চলের সকল শ্রেণীর হিন্দুদের অবিলম্বে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যা নিয়ে ওই অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে একধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে। তবে পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে ভীতসন্ত্রস্তদের আশ্বস্ত করেছে।
×