ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কমেছে ব্যাংকিং চ্যানেলে সন্দেহজনক লেনদেন

জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত কয়েকজন চিহ্নিত, আছে নজরদারিতেও

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৭ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত কয়েকজন চিহ্নিত, আছে নজরদারিতেও

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারিতে ব্যাংকিং চ্যানেলে কমেছে সন্দেহজনক লেনদেন। তবে বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়নের সাম্প্রতিক বেশিরভাগের যোগান এসেছে হুন্ডির মাধ্যমে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্যসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু প্রবাসী বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা, এতিমখানা ও মসজিদের নামে এসব অর্থ পাঠিয়েছেন। দেশে এই অর্থ আসার পর বিতরণ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের মাধ্যমে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে জঙ্গীদের হাতে অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও। এছাড়া ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে দেশে পণ্য এনে বিক্রি করে জঙ্গী ও নাশকতামূলক কর্মকা-ে বিনিয়োগ করার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। উগ্রপন্থীরা সম্প্রতি যে ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে অপারেশন করছে, তাতে বেশ বড় ধরনের অর্থ ‘বিনিয়োগ’ করতে হয়েছে। প্রায় প্রতিটি অপারেশনে একাধিক বিদেশী অস্ত্র, বোমা তাদের হেফাজতে থাকে। এসব সংগ্রহ করতে মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে জঙ্গী উত্থানের পেছনে অর্থদাতাদের খোঁজে ব্যাপক তৎপরতা চালালেও এখন পর্যন্ত তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতাকে সন্দেহে এনে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তারা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন এনজিও অর্থের বড় যোগানদাতা। এ ছাড়া সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ীরাও অর্থায়ন করছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে বিক্ষিপ্তভাবে জঙ্গী হামলা হলেও গুলশান ও শোলাকিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় দেশকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, অর্থদাতাদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করা গেছে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশের ভেতরে ও বাইরে বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ আনছেন তারা। সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (এফআইইউ) সিঙ্গাপুরের মানি লন্ডারিং অথরিটির মাধ্যমে সে দেশে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশী জঙ্গীদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এ সংক্রান্ত একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে দেখা যায়, সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত বাংলাদেশী জঙ্গীরা সেখানে কর্মরত বাংলাদেশী প্রবাসীদের কাছ থেকে ধর্মীয় কর্মকা-ে ব্যবহারের জন্য নানাভাবে চাঁদা সংগ্রহ করেছে। এছাড়া এতিমখানা পরিচালনার জন্যও তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছে। ধর্মীয় কাজ বলে প্রবাসীরাও অর্থ দিয়েছেন। এসব অর্থের একটি অংশ তারা সে দেশে নিজেরা ব্যবহার করেছে। বাকি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছে দেশে। সেগুলো স্থানীয় জঙ্গীরা ব্যবহার করেছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে প্রবাসীদের অর্জিত অর্থের পুরো অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না। এর একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে চলে আসছে দেশে। বৈদেশিক মুদ্রা থেকে যাচ্ছে সেদেশে। এর একটি অংশ জঙ্গীরা ব্যবহার করছে। একই কায়দায় প্রবাসীদের কাছ থেকে মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেও জঙ্গীরা অর্থ সংগ্রহ করছে। এর বাইরেও বিভিন্ন এনজিও ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও জঙ্গীরা অর্থ সংগ্রহ করছে। দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, জঙ্গী অর্থায়নের শেকড় অনেক গভীরে। টিএফআইতে বিভিন্ন সময় জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে উগ্রপন্থীদের অর্থায়নের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার হাফেজ সালাহুল ইসলামকে বিভিন্ন দফায় টিএফআইতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জানান, কক্সবাজারে মাদ্রাসার নামে অনুদানের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে অর্থ আনা হয়। ওই অর্থের কিছু উগ্রপন্থীদের হাতে গেছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা আসার পর মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ ও এমক্যাশের মাধ্যমে সেই অর্থ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এস এ পরিবহনের মাধ্যমেও বড় অঙ্কের টাকা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা যায়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন এজেন্টের কাছে টাকা স্থানান্তর হয়েছে। এছাড়া অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও টাকা স্থানান্তর হওয়ার নজির পাওয়া গেছে। এসব অর্থ স্বাভাবিক লেনদেনের চেয়ে অনেক বেশি। যাদের মধ্যে টাকার লেনদেন হয়েছে তাদের মধ্যে কোন ব্যবসায়িক যোগাযোগ নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই লেনদেনকে সন্দেনজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিশেষ করে এজেন্টগুলো সন্দেহজনক লেনদেন করে থাকে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এজেন্টদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে সম্প্রতি কয়েকটি টিম মাঠপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বেআইনী লেনদেন করায় একটি প্রতিষ্ঠানের শতাধিক এজেন্টের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। নতুন তদন্তে কোন অনিয়ম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোঃ রাজি হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গী অর্থায়নের কোন সংশ্লিষ্টতা কোথাও পাওয়া গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট থেকে খোঁজখবর নেয়া হয়। এর অংশ হিসেবেই এখন নানা ধরনের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে নতুন নতুন টিম পাঠিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। গুলশান ও শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার সঙ্গে জড়িত ৭ ব্যক্তির অর্থের উৎস সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (এফআইইউ) থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই জঙ্গীদের নামের তালিকা ও ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন ওই তালিকা ধরে তাদের নামে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে কোন হিসাব আছে কিনা, থাকলে সেগুলোতে কেমন লেনদেন হয়েছে, এসব হিসাবের সঙ্গে আর কাদের লেনদেন হয়েছে সেসব তথ্য খুঁজে বের করা হবে। এ বিষয়ে অচিরেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে চিঠি দেয়া হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এফআইইউর ডেটা ব্যাংকে সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত থেকেও যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে এদের স্বনামে বা বেনামে কোন তথ্য আছে কিনা। সূত্র জানায়, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক উর্ধতন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন।
×