ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ॥ এরদোগান নিজেকে ধরে রাখলেন

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৭ জুলাই ২০১৬

তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ॥ এরদোগান নিজেকে ধরে রাখলেন

ফ্রান্সের অবকাশযাপন শহর নিসে ভয়াবহ হামলার রেশ না কাটতেই তুরস্কের টিভি স্ক্রিনের স্ক্রলে ভেসে ওঠে নতুন আরেকটি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো খবর। শুক্রবারের সূর্যাস্তের পর বসফোরাস সেতুসহ ইস্তানবুল ও আঙ্কারার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ। সপ্তাহখানেক আগে বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার পর নতুন করে আর একটি চমকে দেয়ার মতো ঘটনা। শঙ্কিত তুরস্কবাসী খবরের সত্যতা জানতে ঠায় তাকিয়ে রইলেন টিভি পর্দায়। রাত গভীর হতে জানা গেল আসল খবর। সন্ত্রাসী নয় বরং এ হলো সেনাঅভ্যুত্থান! তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ ঘটনাকে অভ্যুত্থান বলতে নারাজ। তার মতে, এটা হলো সেনাবিদ্রোহ। ১৯৬০ সালের পর এ নিয়ে তিনবার এমন বিদ্রোহের সম্মুখীন হলো দেশটি। তবে এবারের বিদ্রোহটি ছিল তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বিশ্বের বর্তমান ভয়াবহ সঙ্কট তুরস্কের ভূমিকা হলো অত্যন্ত মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের অভিবাসন ও আইএস দমনে দেশটির আন্তরিক পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল গোটা বিশ্ব। বিশ্ব রাজনীতিতে তুরস্কের ইতিহাস বহু পুরনো ও গৌরবময়। উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে দেশটি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়। প্রতিষ্ঠা করে অটোমান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্য। আধুনিক মানব ইতিহাসে দেশটি ১৬ শতক পর্যন্ত তামাম দুনিয়ায় নিজেদের আধিপত্য বজায় ও ক্ষমতা অক্ষুণœ রাখে। ভিয়েনা, ক্রিমিয়াসহ শাসন করে পৃথিবীর নানা অঞ্চল। ১৭ শতকে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয় সে শক্তি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ভেঙ্গে পড়ে গোটা তুর্কি সাম্রাজ্য। যুদ্ধে পরাজয়ের পর নিজ দেশের ভূ-খ-ের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশটি, যার প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফা কামাল পাশা। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সংবিধানের ভিত্তিতেই তিনি দেশটি প্রতিষ্ঠা করেন। মোস্তাফা কামাল পাশা ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা সকলেই ছিলেন সেনা সদস্য। এ কারণে দেশটির অঘোষিত অভিভাবকের আসনে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া তুরস্কের শাসনতন্ত্রে যেকোন ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শাসনক্ষমতার সর্বেসর্বার অধিকারী ছিল সেনাবাহিনী। ১৯৬০, ১৯৭১ এবং ১৯৮০ সালে শাসনক্ষমতার পালাবদলে ভূমিকা রাখে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকেও (একেপি) সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষমতায় যেতে বেগ পেতে হয়। তাই তুরস্কে সেনাবিদ্রোহ কিংবা অভ্যুত্থান নতুন কোন ঘটনা নয়; বরং তার ইতিহাস বেশ পুরনো। কিন্তু শুক্রবারের বিদ্রোহের কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। কেননা সেনাবাহিনীর কোন্ অংশ এ বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত, তা অস্পষ্ট। তবে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের প্ররোচনায় এ বিদ্রোহ হয়েছে। যাদের নেতা মার্কিন মদদপুষ্ট ধর্মপ্রচারক ফেতুল্লাহ্ গুলেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এ বিদ্রোহের জন্য ওই ধর্ম প্রচারককে দায়ী করেছেন। ফেতুল্লাহ্ গুলেনের নিজস্ব বাহিনী ছাড়াও সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগে তার প্রচুর সমর্থক এবং প্রভাব রয়েছে বলে জানা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য সব পক্ষকেই শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের পক্ষে নিজেদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে বিশ্ব পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে। কারণ, তুরস্ক পৃথিবীর ভূরাজনীতি ও সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার। আইএসবিরোধী শিবিরেও যার ভূমিকা মুখ্য। বর্তমান বিশ্বে তুরস্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোগান। অবশ্য বহির্বিশ্বে তিনি যথেষ্ট বিতর্কিতও বটে! কারণ তার মদদেই জন্ম আইএস জঙ্গীর। তার বিরুদ্ধে নিজ দেশের গণতন্ত্র ও বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার অভিযোগও কম নয়। শোনা যায়, ইসলামিক স্টেট থেকে গোপনে তেল কিনে ইউরোপে বিক্রি করতেন এরদোগান ও তার পরিবারের সদস্যরা। এরদোগানের হাত ধরে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক ধর্মীয় শাসনের দিকে ঝুঁকেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান তো আছেই। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কুর্দিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই তুরস্কের বর্তমান অস্থিরতা। আর এ অস্থিরতার জন্য দায়ী একজন ব্যক্তি; তিনি প্রেসিডেন্টে এরদোগান। যিনি ১৯৯৪ সালে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হন। ধর্মীয় অসহিষ্ণু বক্তব্যের জন্য মেয়র থাকাকালীন দশ মাস কারাভোগও করতে হয় তাকে। এমনকি বন্ধ করা হয় জনসম্মুখে তার ভাষণ। ২০০১ সালে তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ (একেপি)। আব্দুল্লাহ্ গুলকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় দলটি, যারা দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় তুরস্কের ক্ষমতায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার আগে তুরস্কে দুইবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন সাবেক এই মেয়র। যিনি ছিলেন পেশায় একজন ফুটবলার। ২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর দুইবার শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করেন এই জনপ্রিয় শাসক। ২০১২ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিও করেছিলেন এরদোগান। হেঁটেছিলেন সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের পথে। তার হাত ধরে তুরস্ক পুনরায় অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। নতুন করে তৈরি করা হয় বিদেশনীতি। তবে সে আশায় গুড়েবালি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত পাল্টে ফেলেছেন নিজেকে। দীর্ঘস্থায়ী শাসনের জন্য করেছেন ক্ষমতা কুক্ষিগত। যার বিরোধে দীর্ঘ দিনের সতীর্থ আহমেদ দেভুতুগলুকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়। শুধু দেশে নয়, তার কারণে সম্পর্ক খারাপ হয় দীর্ঘদিনের মিত্রদেশ জার্মানির সঙ্গেও। আর্মেনিয়ার গণহত্যা স্বীকৃতি দেয় জার্মানির পার্লামেন্ট। ২০১৩ সালে অবশ্য এরদোগানের দীর্ঘ শাসন এবং দুুনীর্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তুরস্কবাসী। কিন্তু কঠোর হাতে দমন করেছেন সেই গণঅভ্যুত্থান। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ক্ষমতা যত দীর্ঘ হচ্ছে, ততই অস্থির হয়ে উঠছে তুরস্ক। ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি সেনাবাহিনীকে তুরস্কের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। শাস্তি দিয়েছেন সিনিয়র অফিসারদের; যারা তাকে বাধা দিয়েছিল ক্ষমতায় যেতে। কিন্তু সেনাবাহিনী কখনই তার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পায়নি। তার জনপ্রিয়তার ভয়ে মাথাও তোলেনি। বর্তমান ঘটনায়ও সেনাবাহিনীর একটি বিরাট অংশ তার সর্মথক। তারা ফাইটার প্লেন দিয়ে ভূপাতিত করে বিদ্রোহীদের হেলিকপ্টার। ঘিরে রাখে বিদ্রোহে অংশ নেয়া সদস্যদের। ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৭৫৪ সেনা সদস্যকে। আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে বিদ্রোহীদের একটি অংশ। তবে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তার ছুটি কাটানোর স্থানেই বোমা হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। সেখান থেকে আগেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। শনিবার সকালে ইস্তানবুলে এসেই এ বিদ্রোহে অংশ নেয়া সেনা সদস্যদের কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন এরদোগান। সেনাবাহিনীর একটি সংখ্যালঘু অংশের প্ররোচনায় এ বিদ্রোহ হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
×