ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শত বছর ধরে সচল নারিন্দার বিগ্রহ মন্দিরের কুয়াটি

হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর কুয়ার ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১৬ জুলাই ২০১৬

হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর কুয়ার ঐতিহ্য

আনোয়ার রোজেন ॥ ‘তোমার কাছে চাই নি কিছু, জানাই নি মোর নাম- তুমি যখন বিদায় নিলে, নীরব রহিলাম। একলা ছিলেম কুয়ার ধারে- নিমের ছায়াতলে, কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে। আমায় তারা ডেকে গেল, ‘আয় গো, বেলা যায়।’ কোন্ আলসে রইনু বসে- কিসের ভাবনায়।’ পঙতিগুলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কুয়ার ধারে’ কবিতার। একসময় বাঙালীর ঘর-সংসার ছিল কুয়াময়। একালের কবিরা নিজেদের দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন। কুয়া ছিল বলেই না রবীন্দ্রনাথ অমন সুন্দর একটা কবিতার কথা ভাবতে পেরেছিলেন! হাজার বছরের আবহমান বাঙালীর পানীয় জলের উৎস এই কুয়ার ঐতিহ্য বর্তমানে প্রায় হারিয়েই গেছে। আজকাল প্রত্যন্ত পল্লীতেও কুয়ার দেখা মেলে না। গভীর-অগভীর নলকূপ জায়গা নিয়েছে কুয়ার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসের) ছয় বছর আগের এক জরিপের তথ্যেও কুয়ার হারিয়ে যাওয়ার চিত্র স্পষ্ট। ২০১০ সালে দেশে পানীয় জলের উৎস হিসেবে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ কুয়া ব্যবহার করতেন। দেশজুড়ে কুয়া ও এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা যে দিনে দিনে কমেছে, সেটা সহজেই অনুমেয়। তবে হারিয়ে যাওয়ার এই যাত্রার মধ্যেও কিছু কিছু কুয়া এখনও স্বমহিমায় টিকে আছে। ইট-কংক্রিটের জঞ্জালে খোদ রাজধানীতেই আছে এমন গুটিকয়েক কুয়া। সবই পুরান ঢাকায়। এরমধ্যে নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডের শ্রী শ্রী মধুসূধন নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের ভেতর অবস্থিত কুয়াটি সচল রয়েছে শত বছরেরও বেশি ঐতিহ্য নিয়ে। এছাড়া কুলুটোলার ২২ নং জাস্টিস লাল মোহন দাস লেনে একটি এবং প্যারীদাস রোডে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন কুয়া রয়েছে। মাটির উপরি স্তর থেকে স্বচ্ছ জলের স্তর পর্যন্ত গভীরে খোঁড়া গোলাকার কূপ- এই কূপ থেকেই কুয়া। কুয়ার সমার্থক শব্দ ইঁদারা। এর অপভ্রংশ রূপ ‘ইন্দিরা’। আবার বাংলায় ‘পাত’ শব্দটি ‘ছোট’ অর্থে ব্যবহার হয়। এই পাতের সঙ্গে কুয়া শব্দটি যোগ হয়ে পাতকুয়া শব্দটি এসেছে। সাধারণত পানীয় জলের অগভীর কূপই পাতকুয়া। এই অগভীরে খোঁড়া গোলাকার গর্তের ভেতরে বালি-পাথর ও সিমেন্টের তৈরি কিংবা পোড়ামাটির তৈরি গোলাকার পাট, কখনও বাঁশের তৈরি খাঁচা বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহার হতো। তাই পাতকুয়া কোথাও কোথাও পাটকুয়া নামে পরিচিত, মজার ব্যাপার হলোÑ এককালে খুব কমসংখ্যক মানুষের মুখে কুয়া শব্দটি শোনা যেত। এই কুয়া, কুয়া নয়, ‘চুয়া’ হয়েই উচ্চারিত হতো সর্বসাধারণের মুখে মুখে। একসময় নদীবিধৌত বাংলা যেন ছিল একটা জলাধার। এই উন্মুক্ত জলের উৎস ছেড়ে বাংলার মানুষ কবে থেকে পানযোগ্য পানির জন্য কুয়ার ব্যবহার শুরু করে তার ইতিহাস এখনও প্রচ্ছন্ন। তবে সম্রাট অশোকের সময়ে প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার্থে পাতকুয়া খননের ইতিহাস জানা যায়। পরবর্তীতে শের শাহর আমল ও মোগল আমলে মুসাফির ও পথিকদের জন্য মহাসড়কের পাশে এবং বসত এলাকার পাড়ায় পাড়ায় অধিকসংখ্যক মানুষের জন্য একটি করে পোড়ামাটির বেষ্টনী দেয়া কুয়া নির্মিত হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। বিংশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত ব্যবহারের দিক থেকে কুয়ার ইতিহাস, সমৃদ্ধ ইতিহাস। পাটের বেষ্টনীসমৃদ্ধ এ সময়ের পাতকুয়া ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উদ্যোগে জেলার জনবহুল অঞ্চলে পাতকুয়া বসানো হতো। নব্বই দশকের প্রথম থেকেই নলকূপের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে কুয়ার ব্যবহার কমে আসে, চাপা পড়ে পাতকুয়ার কৌলিন্য। কালের ধারাবাহিকতায় নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডের কুয়াটিও কৌলিন্য হারিয়েছে। কুয়াটি গভীর। কিন্তু এর গভীরতা সম্পর্কে যেমন সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারলেন না তেমনি এর খোঁড়ার ইতিহাস সম্পর্কেও বর্তমান ব্যবহারকারীরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানেন না বলে জানান। যেটুকু জানা যায় সেটি হলো, কুয়াটির পত্তন হয়েছিল মথুরামোহন চক্রবর্তীর সময়ে। মথুরামোহন আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের অগ্রদূত শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯০১ সালে ভারত উপমহাদেশের প্রথম আয়ুর্বেদ গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলিতে শক্তি ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তখন নারিন্দার এই স্থানটিতে শক্তি ঔষধালয়ের কর্মীরা থাকতেন। ধারণা করা হয়, কর্মীদের সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দিতেই মথুরামোহন ওই সময় কুয়াটি খনন করে দেন। এ প্রসঙ্গে শ্রী শ্রী মধুসূধন নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের বর্তমান কমিটির সভাপতি শান্তিভূষণ দে’র ছোটো ভাই মিলন কান্তি দে জনকণ্ঠকে বলেন, জন্মের পর থেকেই কুয়াটি দেখছি। আমার বয়স এখন ৬০। ছোটবেলায় আমার বাবাকে কুয়াতলায় রোজ স্নান করতে দেখতাম। আমরাই এখানকার সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা। তবে এটির প্রকৃত খননকাল আমাদের জানা নেই। নারিন্দা, ওয়ারী, পাটুয়াটুলিজুড়ে বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন মথুরামোহন। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে বিপুল সম্পত্তি পেছনে ফেলে মথুরামোহন ও তার পরিবারের সদস্যরা কলকাতায় পাড়ি জমান। তখন থেকেই কুয়াটি অভিভাবকহীন। কুয়া ও মন্দির সংলগ্ন এলাকাটি বর্তমানে দেবোত্তর সম্পত্তি। সরেজমিনে দেখা যায়, কুয়াটি বর্তমানে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরের প্রবেশপথের মুখেই প্যাঁচানো সিঁড়ির দোতলা বাড়ি, আরেকটু সামনে সাবেকি আমলের আরও একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির ঠিক সামনে মন্দির। এই মন্দিরের পেছনেই কুয়ার অবস্থান অনেকটা কোণঠাসা পর্যায়ে। কুয়াতলার একপাশে অনেকে হাঁড়ি-পাতিল আর থালা-বাসন মাজনের অপেক্ষায়। আরেক পাশে প্লাস্টিকের বড় বালতিতে সদ্য কাচা কাপড়ের স্তুপ। কুয়াতলা বেশ পিচ্ছিল। বোঝাই গেল, ব্যবহারকারীরা শুধু ব্যবহারই করেন, কুয়ার যতœ নেন না। মধ্যবয়স্ক একজনকে দেখা গেল, দড়িতে বাঁধা ছোটো বালতিতে করে স্নানের জল তুলছেন। পাশে একটি শিশু তার স্নান শেষ হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। দড়ি আর বালতির সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ১২ ফুট। অর্থাৎ ইট-সিমেন্টের বাঁধানো বেষ্টনী থেকে কুয়ার ভেতর জলের ওপরের স্তর পর্যন্ত গভীরতাও ১২ ফুট। কুয়ার গায়ে শ্যাঁওলার জমাট পুরো স্তর। একাধিক জায়গায় গজিয়ে ওঠা ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ যেন কুয়া ফুঁড়ে বেরিয়ে উঠতে চাইছে। মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমল দেব জানালেন, সর্বশেষ গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কুয়াটির সংস্কার হয়েছিল। এরপর আর সংস্কার না হলেও ঈশ্বরের কৃপায় এটি টিকে আছে। কুয়ার জল এখন আর কেউ পান করেন না। তবে মন্দির সংলগ্ন ২২-২৩ টি পরিবারের শতাধিক মানুষ স্নান, থালা-বাসন মাজা ও কাপড় কাচার কাজে কুয়াটি প্রত্যহ ব্যবহার করে থাকেন। কুয়া কাটা বিষয়ে পারদর্শী মিস্ত্রির সন্ধান চলছে। শীঘ্রই এটির সংস্কার কাজ শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
×