ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এম. নজরুল ইসলাম

অন্ধকারে ঢেকে থাকা ১৬ জুলাইয়ের ভোর

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৬ জুলাই ২০১৬

অন্ধকারে ঢেকে থাকা ১৬ জুলাইয়ের ভোর

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। ফিরে ফিরে আসে ইতিহাস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও তার ব্যতিক্রম হবে কেমন করে? আমরা যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই জীবনের সিংহভাগ তাঁকে থাকতে হয়েছে কারা অভ্যন্তরে। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের এই মহান নেতাকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানের চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধুর মতোই যেন ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকে। দেশের মানুষ যখন অধিকারবঞ্চিত, ১৯৮১ সালে তিনি চেপে বসা শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশে ফিরেছিলেন। দাঁড়িয়েছিলেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের পাশে। যেমন দাঁড়িয়েছিলেন জাতির পিতা, ঠিক সে রকমই। তারপর পদ্মা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার চলার পথটা সহজ ছিল না কোন দিনই। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশবিরোধী জামায়াত নিয়ন্ত্রিত বিএনপি জোট ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যাতে তাদের পক্ষে কাজ করে তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই পাকা করে ফেলেছিল প্রায়। মানুষের অধিকার হরণের সেই কূটকৌশল রুখে দিতেই মানুষকে পথে নামার আহ্বান জানিয়েছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ নেমে এসেছিল পথে। সেই সময়ের সুযোগ নিয়ে চেপে বসে নতুন এক শাসকগোষ্ঠী। তাঁদের শর্তের বেড়াজালে নতুন করে আটকে যায় বাংলাদেশ। মানুষের অনেক অধিকারই তখন উপেক্ষিত হয়। চেপে বসা শাসকদের চরিত্র এ রকমই হয়। সেখানে মানুষ উপেক্ষিত থাকে। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা চেপে বসা শাসকদের পছন্দ নয়। মানুষ নয়, অন্তরালের অন্য কিছু যখন ক্ষমতার নিয়ামক হয়, তখন জনমত যে উপেক্ষিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব তখন অপরাধ হয়ে দেখা দেয়। এমনটিই ঘটেছিল ২০০৭ সালে। চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী তখন মানুষের কণ্ঠরোধ করেছে। সবকিছুই তখন চলেছে শর্তের বেড়াজালে। অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার নামে কেড়ে নেয়া হয়েছিল সে সময়। মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্রনেত্রী শেখ হাসিনা যখন মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে সোচ্চার, তখনই রুদ্ধ করা হলো তাঁকে। দিনটি ছিল ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই। নতুন এক রাজনৈতিক প্রহসন সে রাতে যেন সম্প্রচারিত হলো। দেশের মানুষ রাত জেগে সে প্রহসন দেখেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার তখনকার বাসভবন সুধাসদন ঘিরে রেখেছে যৌথ বাহিনী। মানুষের কাছে খবরটি পৌঁছে যেতে মোটেও সময় লাগেনি। এর পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো আদালতে। এমন সময়ে যা হয়, কারাগারেই যেতে হলো তাঁকে। যেখানে তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়, সংসদ ভবনের সেই বাসভবনটি আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। অর্থাৎ আগে থেকেই পরিকল্পনা করে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের এমন অনেক ঘটনাই তো ঘটেছে। দিনের পর দিন তাঁকে থাকতে হয়েছে কারান্তরে। এমনকি নিজের মেয়ের বিয়ের দিনও তিনি ছিলেন কারাগারে। বাবাকে কারাগারে যেতে ও আসতে দেখেছেন তিনি। কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখাও করতে গেছেন। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তাঁকেই যেতে হলো কারাগারে। এভাবেই বাবার ইতিহাস ফিরে এলো তাঁর জীবনে। এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে জেল জুলুম নতুন কোন ঘটনা নয়। মহৎ রাজনীতিকরা কারাগারে বসেই তাঁদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছেন, এমন অনেক নজির আছে। জননেত্রী শেখ হাসিনাও নির্জন কারাবাসকালে অলস সময় কাটাননি। কারাগারের নির্জনতাকে তিনি তাঁর সৃজনশীল রাজনৈতিক চিন্তায় সময় পার করেছেন। তাঁর চরিত্রের যে বিষয়টি সবারই নজর কাড়ে তা হচ্ছে তাঁর গভীর প্রত্যয়। দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ জননেত্রী গভীর সঙ্কটেও তিনি জনগণের কল্যাণ চিন্তা করেন। সেই চিন্তার প্রতিফলন এরই মধ্যে ঘটেছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। এক স্মৃতিচারণে জননেত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার যে পরিকল্পনা, তা সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাগারে নিঃসঙ্গ দিনগুলোতেই তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়েছিল, একদম একা। আমি জানি আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলা, আমি যাতে নির্বাচন করতে না পারি, আরও অনেক রকম পরিকল্পনা ছিল বা আমি যেন আর রাজনীতিতে থাকতে না পারি সেই ধরনের অনেক ষড়যন্ত্র। ...সেই সময় বসে বসে আমি লিখে রেখেছিলাম, ২০০৮-এর মধ্যে নির্বাচন হলে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় তাহলে দেশের জন্য কী করব? ...২০১১ সালে আমরা কী করব, ২০১২ সালের মধ্যে কী করব, ২০১৩ সালের মধ্যে কী করব, ২০১৪ সালে মধ্যে, ২০১৫ সালের মধ্যে কী করব, এভাবে আমি প্রত্যেকটা বিষয় লিখে রেখেছিলাম।’ সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গত সাত বছরে তাঁরই নেতৃত্বে অনেকটাই এগিয়েছে বর্তমান সরকার। বাকি সময়ের আগেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারেও তো আশাবাদী জননেত্রী শেখ হাসিনা। স্মৃতি হাতড়ে তিনি আরও জানিয়েছেন, কারাগারে যাওয়ার সময় একটি খাতা সঙ্গেই নিয়েছিলেন তিনি। পরে আরও কিছু খাতা কিনিয়ে নেন। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। আজকের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে অনেক কালো অধ্যায় পার হয়ে আসতে হয়েছে। এখনও বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চলতে হচ্ছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, শেখ হাসিনার পায়ে পায়ে পাথর। সেই পাথর সরিয়ে শেখ হাসিনা গত সাত বছরে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এক সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনও থেমে নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গভীর এক ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশ। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তারই রেশ। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। বঙ্গবন্ধুকন্যাই পারেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরে উন্নয়নের নতুন পথে শনৈ শনৈ এগিয়ে নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর এখন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৬ জুলাই ইতিহাসের সেই কালো দিনটিকে স্মরণে রেখে আমাদের নতুন করে শপথ নিতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের বিস্ময় হবে, এ বিশ্বাস আমাদের সবার। ১৬ জুলাইয়ের মতো অন্ধকারে ঢেকে থাকা ভোর নয়, সত্যিকারের আলোয় উদ্ভাসিত দিন আসবেই আসবে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী ও মানবাধিকারকর্মী [email protected]
×