ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এদের অনেকেই আফগান যুদ্ধ ফেরত ॥ চরাঞ্চলে গোপনে প্রশিক্ষণ

উত্তরাঞ্চলের নিখোঁজ তরুণরাই জঙ্গী হামলা চালাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৬ জুলাই ২০১৬

উত্তরাঞ্চলের নিখোঁজ তরুণরাই জঙ্গী হামলা চালাচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ ঢাকার গুলশানে হামলায় বগুড়ার দুই জঙ্গী থাকার পর শোলাকিয়ার হামলাতেও বগুড়ার এক জঙ্গীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। জঙ্গী ঘাঁটি হিসাবে পরিচিতি পাওয়া উত্তরাঞ্চলের নিখোঁজ তরুণ যুবকরা যে বিভিন্ন হামলায় অংশ নিচ্ছে এই বিষয়টি সামনে এসেছে। এই সব জঙ্গীর অনেকেই আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া তাও আঁচ করা গেছে। ইতোমধ্যে বগুড়ায় নিখোঁজ অন্তত ৩০ জনের মধ্যে তিন জন আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাও উদঘাটিত হয়েছে। তারাই দেশে ফিরে জঙ্গী রিক্রুট করে গোপন জায়গায় বিশেষ করে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এদিকে বগুড়ার সন্ত্রাসগুলোতে দিনে দিনে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। পুলিশও মাঝে মধ্যেই আধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করছে। জঙ্গীদের বিষয়ে খোঁজ খবর করে জানা যাচ্ছে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ঘটনাগুলোর প্রকৃত তদন্ত না হওয়া এবং গ্রেফতার করার পরও অভিযুক্তরা কোনভাবে ছাড়া পাওয়ায় জঙ্গীরা সুযোগ খুঁজে মাঠে নামছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হচ্ছে গলদঘর্ম। অবশ্য পুলিশের সূত্রগুলো বলছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলায় অংশ নেয়া ৫ জনের মধ্যে দুইজনই বগুড়ার। শাজাহানপুর উপজেলার খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল ওরফে বাঁধন ও ধুনটের গোসাইবাড়ি চিথুলিয়া গ্রামের শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলের বাড়ির আশপাশের লোকজন জানায়, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কেউ তবলিগে যাওয়ায় কথা বলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আর ফেরেনি। তাদের খবর নিতে গিয়ে মেলে নানা তথ্য। বগুড়া পুলিশের খবর, গত ক’বছরে নিখোঁজ ১৭ জনের তালিকা তাদের কাছে আছে। তারা কোথায় তা জানতে অনুসন্ধান চলছে এবং পুলিশ তাদের খুঁজছে। বিভিন্ন সূত্রের খবর, নিখোঁজের সংখ্যা কারও মতে ২৩ জন কারও মতে ৩০ জন। দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ঘটনায় বিশেষ করে রংপুরে জাপানী নাগরিক হত্যা, পাবনায় ক্রিশ্চিয়ান যাজক হত্যা, রংপুরের কাউনিয়ায় খাদেম হত্যা, বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা হত্যা চেষ্টা, দিনাজপুরের কান্তজীর রাসমেলায় ও ইসকন মন্দিরে বোমা হামলা, রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রীস্টান ব্যক্তিকে হত্যা, দিনাজপুরে ইতালির নাগরিককে হত্যা চেষ্টা, সৈয়দপুর মাজারে খাদেম হত্যা চেষ্টা, পঞ্চগড়ে মঠ প্রধানকে হত্যা, গাইবান্ধায় হিন্দু ব্যবসায়ী হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা করে মুসল্লি হত্যা, ঢাকায় কয়েকজন ব্লগারও প্রকাশককে হত্যার প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে তথাকথিত জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ সংক্ষেপে জেএমবি এবং কোন জঙ্গী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। ঘটনা ঘটার সঙ্গেই পুলিশ হন্যে হয়ে জঙ্গী খোঁজে। তারপরও ঘটনা ঘটে। গুলশানের আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার আগে পুলিশ ঘোষণা দিয়ে সারাদেশে জঙ্গী দমন অভিযান চালায়। তারপরও জঙ্গীদের হামলা ঠেকানো যায়নি। হলি আর্টিজানের ঘটনার পরই শোলাকিয়ার ঘটনা যে একই সূত্রে গাঁথা তাও প্রমাণ হচ্ছে। গুলশানের পর শোলাকিয়ার ঘটনায় গ্রেফতার করা শফিকুলের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে ঘটনায় জঙ্গীদের সঙ্গে আজাদুল কবিরাজ নামের একজন আছে। যার বাড়ি বগুড়া। এই জঙ্গীরা প্রত্যেকেই মোটরসাইকেল চালাতে পারদর্শী এবং চর এলাকায় নির্বিঘেœ মোটর সাইকেল চালায়। উত্তরাঞ্চলের যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের বিভিন্ন চরে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই প্রশিক্ষণদাতাদের মধ্যে যে আফগান যুদ্ধ ফেরতরা আছে তাও জানা যাচ্ছে। বিশেষ করে বগুড়ার জঙ্গীদের সন্ধান করতে গিয়ে আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া কয়েকজনের নাম আসে। যারা নিখোঁজ রয়েছে। বগুড়া পুলিশ যাদের খুঁজছে তাদের মধ্যে ধুনটের মথুরাপুর ইউনিয়নের পীরহাটি গ্রামের আবু মোতালেব মজনু (২৫) দেড় মাস ধরে নিখোঁজ। সে আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশে ফেরে। এই মজনু জঙ্গী সংগঠন তথাকথিত লস্করে তৈয়্যবার বাংলাদেশ শাখার সদস্য। বছর কয়েক আগে ঢাকার রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের বোমা হামলায় সে গ্রেফতার হয়। পরে সে জামিনে ছাড়া পায়। তার পারিবারিক সূত্র বলছে, মজনু রাজশাহীতে বিয়ে থা করে সেখানেই রয়েছে। তবে পুলিশ তার সন্ধান পায়নি। ধুনটের নিখোঁজ পেঁচিবাড়ি গ্রামের আব্দুস সালাম ৯০’র দশকে আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়। দেশে ফিরে সে জঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দেয়। প্রায় এক যুগ ধরে সে নিখোঁজ। ধুনটের সেইলিবাড়ি গ্রামের আয়নুল হকের সঙ্গে সালাম আফগানিস্তানে গিয়েছিল। দু’জনই ফিরে আসার পর নিখোঁজ। একই এলাকা ধুনটের তারাকান্দি গ্রামের শাহ আলম (২৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। প্রায় এক যুগ ধরে সে নিখোঁজ। দুপচাঁচিয়া উপজেলার মেরাই গ্রামের দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শাহীনুর আলম (২২) মাস ছয়েক আগে ঘর থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। শাহীনুর শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদিকে গুলশানে জঙ্গী হামলার ঘটনায় বগুড়ার শাজাহানপুরের খায়রুল ওরফে পায়েলকে বছরখানেক আগে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় পাশের গ্রাম কামারপাড়ার আব্দুল হাকিম। পায়েল ও হাকিম একই মাদ্রাসার ছাত্র। এই হাকিমও গুলশানের ঘটনার আগে নিখোঁজ হয়। পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখা যায় উত্তরাঞ্চলে বিচারে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের অভ্যুদয়ের আগে ২ হাজার ৩ সালের ১৪ আগস্ট জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে উত্তরমহেষপুর গ্রামে পুলিশের ওপর সশস্ত্র হামলা করে জঙ্গীরা। জয়পুরহাটে কালাইয়ে পীরের আস্তানায় ৩ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। দিনাজপুরের গুড়গোলায় ছাত্রাবাসে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটে। বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পার্বতীপুরে। ২ হাজার ৩ সালে জঙ্গী সংগঠন শাহাদত ই হিকমার আত্মপ্রকাশ ঘটে রাজশাহীতে। পরে তা অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ২ হাজার ৩ সালের ২৭ জুন বগুড়ার জোগারপাড়ায় ট্রাক ভর্তি প্রায় এক লাখ গুলি ও ১শ’ ৭৪ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। এতগুলো ঘটনার কোনটিরই সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে এ বছর এপ্রিল মাসের প্রথমে বগুড়ার শেরপুরের জোয়ানপুর কুঠিরভিটা গ্রামে সন্ধ্যারাতে গভীর শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হলে এলাকা কেঁপে ওঠে লোকজনের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পরে জানা যায়, ওই বাড়িতে বোমা বানানো হচ্ছিল। বোমা বিস্ফোরণে দুইজন নিহত হয়। তারা প্রত্যেকেই জঙ্গী। পুলিশ এই বাড়ি থেকে গ্রেনেড তৈরির বিপুল বিস্ফোরক, গ্রেনেড, বোমার খোলস, ডিটোনেটর, অটো সুইচ ও বিদেশী অস্ত্র উদ্ধার করে। বছর দুয়েক আগে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়ায় এক বাড়িতে র‌্যাব হানা দিয়ে লাইট মেশিন গানসহ আধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করে। কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অভিযানের আগেই তারা পালিয়ে যায়। এই ঠনঠনিয়া এলাকায় বিচারে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া শায়খ আব্দুর রহমান প্রায় এক বছর গোপনে অবস্থান করে। পুলিশ ওই সময়ে তাকে ধরতে পারেনি। পূর্বের ও পরবর্তী ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এটা পরিষ্কার হওয়া যায় কোন ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় ও প্রকৃত অভিযুক্তরা ধরা না পড়ায় এবং ধরা পড়ার পরও ছাড়া পাওয়ায় ঘটনার রেশ বেড়েই চলেছে। হালে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো তা হলো, বগুড়ায় সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। পুলিশ বিচ্ছিন্নভাবে যা উদ্ধার করেছে তার প্রায় সবই আধুনিক ও বিদেশী। মাসকয়েক আগে শাজাহানপুর থেকে মামুন নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বিদেশী একে পয়েন্ট ২২ রাইফেল উদ্ধার করে। এই আধুনিক অস্ত্র কিভাবে এলো তার হদিস পায়নি পুলিশ। গত দুই বছরে বগুড়া পুলিশ একটি শর্ট মেশিনগান (এসএমজি), ৪৫টি বিদেশী পিস্তল, ১০টি রিভলবারসহ ৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র, প্রায় ৫শ’ রাউন্ড গুলি ৫১টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় দুইশ’জনকে। এ থকে ধারণা করা যায় বগুড়ায় অবৈধ অস্ত্রের কারবারও চলছে গোপনে। পুলিশ সব সময়ই দাবি করে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সফল (!)। তারপরও জঙ্গী হামলাসহ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলে জঙ্গীদের কত ঘাঁটি আছে, কোথায় কি ভাবে তারা আত্মগোপন করে আছে, কোন চরে গোপনে জঙ্গী প্রশিক্ষণ হচ্ছে তার কিছুই উদঘাটন করতে পারছে না পুলিশ। বর্তমানে সাধারণ মানুষের অবস্থা এমনই, না জানি কখন কোন খারাপ খবর শুরু করে টিভি চ্যানেলগুলো। ব্রেকিং নিউজ দেখলেই চোখ কান খোলা রেখে বসে।
×