ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানের কাছেই এক মাস আগে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৬ জুলাই ২০১৬

হলি আর্টিজানের কাছেই এক মাস আগে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় জঙ্গীরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁয় ও হামলাকারী জঙ্গীরা গুলশানেরই একটি বাড়িতে ভাড়া ছিল। মাত্র এক মাস আগে তারা বাড়িটির একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। মাসিক ভাড়া প্রায় বিশ হাজার টাকা। বাড়ির মালিক প্রবাসী। মূলত একজন কেয়ারটেকার বাড়িটি দেখভাল করেন। এই কেয়ারটেকারের কাছ থেকেই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় জঙ্গীরা। এরপর সেখানেই চলে হামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। বাড়িটির ওই কেয়ারটেকারকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গুলশানের যেসব রাস্তায় চেকপোস্ট নেই, সেসব রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে ঘটনাস্থলে পৌঁছে হামলাকারীরা। চেকপোস্ট এড়াতে হামলকারীদের প্রায় তিন কিলোমিটার ঘুরতে হয়েছিল। বিভিন্ন সড়ক ঘুরে গাড়িতে করেই হামলাকারীরা ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছে। এরপর হেঁটে রেস্তরাঁয় প্রবেশ করে। তারপর চালায় স্মরণকালের ভয়াবহ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলশান হামলার চক্রান্ত অনেক আগের। ধাপে ধাপে চূড়ান্ত হামলার প্রস্তুতি চলে। সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গুলশানের একটি বাড়ির একটি ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় জঙ্গীরা। বাড়িটি শনাক্ত হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে কেয়ারটেকারকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এক উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, হামলাকারীদের সহযোগী একটি গ্রুপ ছাত্র পরিচয়ে মাসিক প্রায় বিশ হাজার টাকায় কেয়ারটেকারের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়। ভাড়া নেয়ার সময় বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে ভাড়াটিয়ারা যেসব ছবি ও তথ্য দিয়েছে তা পুরো ভুয়া। ভাড়া নেয়ার পর থেকেই ফ্ল্যাটে ছাত্রবেশী হামলাকারীদের যাতায়াত শুরু হয়। বাড়ির মালিক প্রবাসী হওয়ায় এবং কেয়ারটেকার সার্বিক বিষয় দেখভাল করায় ফ্ল্যাটে কারা যাতায়াত করত তার তেমন কোন খবরই রাখতেন না। তবে হামলার পর হামলাকারীদের ছবি মিডিয়ায় প্রকাশের পর ছবির ব্যক্তিরা ওই ফ্ল্যাটে যাতায়াত করেছে বলে কেয়ারকেয়ার জানান। সূত্র বলছে, ফ্ল্যাটটি ঘটনাস্থল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। যথেষ্ট কাছেই বলা চলে। এরপর সেই ফ্ল্যাটেই আস্তে আস্তে মজুদ করা হয় অস্ত্রগোলাবারুদ। ফ্ল্যাটটিকে জঙ্গীদের ভাষায় মারকাজ বলা হয়। অর্থাৎ নিরাপদ আস্তানা। আস্তানায় যাতায়াত শুরু করে হামলায় অংশগ্রহণকারীরা। সেখানেই চলে হামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ঘটনার দিন সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই হামলাকারীরা ভারি ভারি ব্যাগ নিয়ে নামে। বাড়ির কেয়ারটেকারের ধারণা, হয়তো তারা ঈদের ছুটিতে দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন অথবা বাড়ি যাচ্ছেন। এজন্যই অনেক কাপড় চোপড়সহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নেয়ার কারণে ব্যাগ ভারি হয়েছে। এজন্য তিনি তাদের তেমন কোন কিছু জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন মনে করেননি। তারা একটি গাড়িতে করে রওনা হয়। গুলশানের বেশিরভাগ রাস্তায়ই চেকপোস্ট রয়েছে। এজন্য তারা আগে থেকেই যেসব রাস্তায় চেকপোস্ট নেই, সে সব রাস্তা রেকি করে রাখে। সে মোতাবেক চেকপোস্টবিহীন রাস্তা দিয়ে তারা ঘটনাস্থলের দিকে যেতে থাকে। সর্বশেষ তারা গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালের সামনের রাস্তা হয়ে পার্ক রোড ধরে ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছে। হলি আর্টিজানের কাছে গিয়ে তারা নেমে যায়। বাসা থেকে হলি আর্টিজান কাছে হলেও, শুধুমাত্র পুলিশের চেকপোস্ট এড়িয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে হামলাকারীদের অন্তত তিন কিলোমিটার রাস্তা ঘুরতে হয়েছে। এজন্য তাদের যথেষ্ট সময় লেগেছে। সোজা বা শর্টকাট রাস্তায় যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে অনেক আগেই হামলার ঘটনা ঘটতে পারত। যেসব রাস্তা ব্যবহার করে হামলাকারীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে, সেসব রাস্তায় বা তার আশপাশে থাকা বাসা, বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনায় থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব ফুটেজের পর্যালোচনা চলছে। তাদের সহযোগী হিসেবে অনেকেই সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন। তাদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। সন্দেহভাজনদের মধ্যে শাওনের মৃত্যু হয়েছে। আর আহত অবস্থায় সন্দেহভাজন হিসেবে চিকিৎসাধীন রয়েছে জাকিরুল ইসলাম (২২) ও নজরুল সারেন (৫০)। হামলাকারীরা বিভিন্ন পথ ঘুরে অবশেষে হেঁটে গত ১ জুলাই রাত পৌনে নয়টার দিকে গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের গুলশান লেক সংলগ্ন হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় ঢোকে। ঢুকেই অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এরপর দেশী ও বিদেশীদের আলাদা করে। নিচতলায় ছুরিকাঘাতে, গলা কেটে ও গুলি করে ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানী, এক ভারতীয় ও দুইজন দেশী নারীসহ মোট ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরদিন সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোরা সাঁজোয়া যান নিয়ে অভিযান চালায়। অভিযানে কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় ১৩ জিম্মিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। অভিযানকালে ছয় হামলাকারী নিহত হয়। উদ্ধার হয় অত্যাধুনিক অস্ত্রগোলাবারুদ। ত্রিশটি মোবাইল ফোনসহ বহু আলামত। সেসব আলামত নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, ঘটনাটির সঙ্গে দেশী ও আন্তর্জাতিক চক্রের জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। কারণ সাইট ইন্টেলিজেন্স আগেই হত্যার দায় স্বীকার করে ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে আগাম ঘোষণা দেয়। আর অপারেশন শেষে উদ্ধারও হয় ২০ জনের লাশ। যা যথেষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। তবে গুলশানের হামলার মধ্যদিয়ে দেশ আরও বড় ধরনের হামলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীদের আরও বড় ধরনের কোন হামলার পরিকল্পনা ছিল বলে সার্বিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে। গুলশান হামলার পর দেশের মানুষের মধ্যে যে ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে এবং যেভাবে দেশী- বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা তৎপর রয়েছে, তাতে আর বড় ধরনের কোন হামলার হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট কম বলে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এই কর্মকর্তা বাড়ির ঠিকানা, বাড়ির মালিকের অবস্থান ও কেয়ারটেকার সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়েছে।
×