ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রনিস শহরে ট্রাক হামলায় নিহত ৮৪;###;রহামলাকারী শনাক্ত;###;রতিনদিনের জাতীয় শোক

ফের রক্তাক্ত ফ্রান্স

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৬ জুলাই ২০১৬

ফের রক্তাক্ত ফ্রান্স

নাজিম মাহমুদ ॥ আট মাসের ব্যবধানে ফের রক্তাক্ত হল ফ্রান্স। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ১১টায় দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় অভিজাত নিস শহরে হাজার হাজার মানুষের ওপর ৮০ কিলোমিটার বেগে চলা ১৯ টনের একটি ট্রাক তুলে দিয়ে অন্তত ৮৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে দুই শতাধিক লোক। সরকারী ছুটি থাকায় বাস্তিল দিবসের উৎসবে যোগ দিতে এসব লোক শহরটির ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বিখ্যাত প্রমেনেদ দেজাঙ্গল চত্বরে জড়ো হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ৫২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের মধ্যে মার্কিন, সুইস ও রুশ নাগরিক রয়েছে। তবে নিহতদের মধ্যে কোনও বাংলাদেশী নেই। এ ঘটনায় আজ শনিবার থেকে ফ্রান্সজুড়ে তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। হামলাকারীর নাম মোহাম্মদ লাওয়েজ বুলেল বলে জানা গেছে। ৩১ বছর বয়সী বুলেল তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক। হামলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। ট্রাকটির ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ দুইটি কালাশনিকভ রাইফেল, একটি বাইসাইকেল, বুলেট, গ্রেনেড, একটি মোবাইল ফোন ও কিছু নকল অস্ত্র উদ্ধার করেছে। ফরাসি পুলিশ বুলেলের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে। ফ্রান্সজুড়ে শুক্রবার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। ফ্রান্সের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে শুক্রবার তুরস্কও তাদের পতাকা অর্ধনমিত রাখে। খবরে বলা হয়েছে, ঘাতক বুলেল নিস শহরেই থাকতেন এবং পুলিশের কাছে অল্প পরিচিত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ না থাকলেও পুলিশের নথিতে তার বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত মামলার প্রমাণ আছে। স্ত্রীকে তালাক দেয়ার দায়ে একবার জেলখাটেন বুলেল। তবে ফরাসি গোয়েন্দাদের কাছে তেমন পরিচিত ছিলেন না তিনি। তবে তিনি ঠিক কী কারণে এই হামলা চালালেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ফরাসি কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে জানিয়েছে। এই ঘটনায় শুক্রবার বিশ্বনেতারা এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ ও প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েলস ভালস নিস শহর পরিদর্শন করেছেন। প্যারিসে এক জরুরী বৈঠক শেষে নিসের উদ্দেশে রওয়ানা হন তারা। বৃহস্পতিবারের এই ঘটনার পর ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও ব্রিটেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফ্রান্সের জরুরী অবস্থার মেয়াদ আরও তিনমাস বাড়ানো হয়েছে। এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওলাঁদ, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে, জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মেরকেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং, রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ আরব নেতারা নিন্দা জানিয়েছেন। মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা এ ঘটনাকে কাপুরুষোচিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্যারিসে ইসলামী স্টেট জঙ্গীদের হামলায় ১৩০ জন নিহত হওয়ার আট মাসের মাথায় ফ্রান্সজুড়ে জরুরী অবস্থার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। কোন জঙ্গীগোষ্ঠী প্রাথমিকভাবে হামলার দায় স্বীকার করেনি। খবর বিবিসি, এএফপি, আলজাজিরা ও লা মঁদের। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওলাঁদ বলেছেন, নিস শহরে জনতার ওপর ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যাকা-ের ঘটনা স্পষ্টত একটা সন্ত্রাসী হামলা। হামলার দায় এখন পর্যন্ত কেউ স্বীকার না করলেও ওলাঁদ ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার দেশের ভূমিকা জোরদারের অঙ্গীকার করেন। শুক্রবার টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে তিনি আইএসের কথা উল্লেখ করে বলেন, কোন কিছুই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের আগ্রহ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। আমরা ইরাক ও সিরিয়ায় আমাদের পদক্ষেপ আরও জোরদার করব। আমাদের মাটিতে যারা আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে তাদের ওপর আমরা হামলা অব্যাহত রাখব। ওলাঁদ বলেন, নিহতদের মধ্যে অন্তত ১০টি শিশু রয়েছে। তিনি বলেন, এটা যে সন্ত্রাসী হামলা, তা অস্বীকার করার জো নেই। ভাষণে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের অঙ্গীকার করেন তিনি। দেশে বিরাজমান জরুরী অবস্থা আরও তিন মাস চালু রাখার ঘোষণা দেন ওলাঁদ। তিনি বলেন, যা ঘটেছে তাতে ফ্রান্স আতঙ্কিত। ফ্রান্স যখন স্বাধীনতার প্রতীক জাতীয় দিবস পালন করছিল তখন এ হামলা চালানো হয়। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের কথা দিলাম, ফ্রান্স সর্বদা শক্তিশালী হবে।’ ওলাঁদ আরও বলেন, ফ্রান্স মারাত্মকভাবে হামলার শিকার। এ ধরনের হামলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যা যা করা দরকার, তা করা হবে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস ভয়াবহ এ হামলায় নিহতদের স্মরণে শনিবার থেকে তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণার কথা জানিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গত ১৩ নবেম্বর কার্যকর হওয়া জরুরী অবস্থা আগামী অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বিবৃতিতে বলেন, পুরোনো বন্ধু ফ্রান্সের পাশে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় আছে। আমরা জানি এই হামলা ও প্রাণহানির ক্ষত ফ্রান্সকে অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হবে। সুন্নি মুসলিমদের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ মিসরের আল আজহার শুক্রবার এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদমুক্ত করতে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে। কায়রোভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এসব পাপিষ্ঠ সন্ত্রাসী হামলা ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আল-আজহার সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করতে এবং বিশ্বকে এর অশুভ প্রভাব মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছে।’ খবরে বলা হয়েছে, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ইউক্রেন, সিঙ্গাপুর ও জামার্নীসহ অন্যান্য দেশের ফরাসি দূতাবাসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিহতদের স্মরণ করেছে এসব দেশের নেতা ও সাধারণ জনগণ। হামলাকারী বুলেল সম্পর্কে ফরাসি গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, তিন সন্তানের জনক বুলেল তার স্ত্রীসহ নিস শহরে বাস করতেন। হামলার আগে কয়েকবার তিনি নিজ দেশ তিউনিসিয়া সফর করেছেন। তবে তিউনিসিয়ায় তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজের কোনও অভিযোগ নেই। আবার ধর্মের প্রতিও তার বেশি ঝোঁক ছিল না। এ ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমরা আনন্দের উৎসবে মেতেছিলাম। আকাশজুড়ে আতশবাজির খেলা চলছিল। ঠিক এ সময় তেড়ে এল ঘাতক ট্রাক। উৎসবে যোগ দেয়া মানুষের সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। উৎসবের আনন্দ-রজনী নিমিষে পরিণত হয় ‘আতঙ্কের রাতে’। ঝরে যায় ৮৪টি প্রাণ। তিনি বলেন, ১৯ টনের একটি ট্রাক জনতার ওপর উঠিয়ে দেয়া হয়। প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত ট্রাকটি টেনে নিয়ে যায় চালক। এ সময় ট্রাকের ভেতর থেকে গুলিও চালায় চালক। বৃহস্পতিবার ঘটনার অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক ডেমিয়েন আলেমান্ত বলেছেন আতশবাজি শেষে চিৎকার ও কান্নাকাটির শব্দ শোনার সময় আমি সাগড়পাড়ে ছিলাম। সেকেন্ডে মধ্যে দেখতে পাই, বিশাল সাদা রঙের একটি ট্রাক উন্মাদের মতো ছুটছে; যাতে অনেক বেশি মানুষকে চাকার নিচে পিষে ফেলা যায়। ট্রাকটি যেখান দিয়ে যাচ্ছিল সেখান দিয়েই ছিটকে পড়ছিল মানুষ; যে শব্দ আর কান্না আমি শুনেছি তা কখনও ভুলব না।” নিসের স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াসিম বোলেল জনতার ওপর দিয়ে ট্রাকটি চলে যাওয়ার ঘটনা দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, রাস্তার সব জায়গায়াই পড়ে ছিল লাশ আর লাশ। হামলার পর নিরাপত্তার কড়াকড়ি, হাত মাথার উপরে রেখে রাস্তা পার হয় নাগরিকরা স্থানীয় জনসংযোগ কর্মকর্তা সিলভি টোফিন জানান, নগরীর সাগর তীরবর্তী পাঁচতারকা হোটেল প্যালাইস ডি লা মেডিটির‌্যানির কাছের ফুটপাথের পাশ দিয়ে যাওয়া দীর্ঘ রাস্তায় জড়ো হওয়া উৎসবমুখর মানুষের ওপর দিয়ে চলে যায় ট্রাকটি। কাছের একটি হোটেল থেকে মর্মান্তিক ওই ঘটনা দেখতে পাওয়ার কথা জানান ব্রিটিশ পর্যটক কেভিন হ্যারিস। তিনি বলেন, প্রচণ্ড চিৎকার ও কান্নাকাটির শব্দে বারান্দায় গিয়ে দেখি, রাস্তায় পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। দেহগুলো সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। আশপাশে অনেক পুলিশ এবং এ্যাম্বুলেন্সও আছে। কিন্তু এটা ভয়ানক, খুবই ভয়ানক দৃশ্য।
×