ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাইসুল সৌরভ

ভুলবার নয় ভিয়েতনাম

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৫ জুলাই ২০১৬

ভুলবার নয় ভিয়েতনাম

ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে এশিয়ার একটি আন্তর্জাতিক আইন সমিতির আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তাই সম্মেলনের অন্তর্জালে একটি গবেষণা প্রবন্ধের সারাংশ পাঠিয়ে দিলাম দূরদূরুবুকে। কিছুদিনান্তে ওপার থেকে সাড়া এল সম্মেলনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে। ভিয়েতনাম সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার সেই শুরু। এমনিতে খুব একটা ধারণা ছিল না দক্ষিণ চীন সাগরের পাড়ে বিস্তৃতির পাখা মেলে শুয়ে থাকা লম্বাটে দেশটি সম্পর্কে। শুধু জানতাম তৈরি পোশাক খাতে এই দেশটি আমাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী । চাল রফতানিতে দ্বিতীয় কৃষিপ্রধান এক দেশ, যারাও নাকি উন্নয়নের মিছিলে শামিল হতে বাংলাদেশের মতো করেই ছুটছে প্রাণপণে। ইন্টারনেট ঘেঁটে আরও জানলাম চলতি সময়ের লু হাওয়াও আমাদের মতোই সেখানেও উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। ভিয়েতনাম ভ্রমণে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নিরাপত্তা ছাড়পত্র প্রয়োজন পড়ে। আয়োজকদের মাধ্যমে সেসব জোগাড় করে ভিসাপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ করে গত ১৩ তারিখে পিঠে দুটি ডানা লাগিয়ে হ্যানয়ের পথে উড়াল দেয়া। ঢাকা থেকে হ্যানয় সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় যাত্রা বিরতিসহ আকাশে উড়ে উড়েই চলে গেল বার ঘণ্টা। তাই সূর্য যখন হ্যানয়ের মধ্য গগণে তখন যেয়ে নামলাম নৈ বেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। নেমেই দে ছুট সম্মেলন পানে। সম্মেলন যে শুরু হয়েছে আগের রাতেই। বিমানবন্দর থেকে শহরের দিকে যেতে যেতেই মুগ্ধ করল হ্যানয়। প্রশস্ত, পরিষ্কার রাস্তা। ঢাকার মতো অসহ্য জট নেই; অযথা ভেঁপুর আওয়াজ নেই। রাস্তার পাশ দিয়ে উদ্যান, ফাঁকা মাঠ, অদূরে অনুচ্চ দালান। এদের বেশিরভাগ বাড়িগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ওপরের তলার ছাদ টিনের চালের মতো মাঝখানে উঁচু হয়ে দুধারে ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া। ঢাকার মতো সুউচ্চ ঘিঞ্জি বিল্ডিং না থাকলেও তাতে আভিজাত্যের কমতি নেই। সাধারণেই সে অসাধারণ! যে কোন সম্মেলনের উপরি পাওনা হলো না চাইলেও নানা দেশের, নানান বর্ণের, জাতের মানুষের সঙ্গে সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়ে যাওয়া। সম্মেলনের আয়োজক প্রতিষ্ঠান এশিয়া কেন্দ্রিক হলেও অংশগ্রহণকারীর দল মোটেই এশিয়াতে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তাবৎ দুনিয়ার বৈচিত্র্যের মেলবন্ধন প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সেখানে। মূলত আন্তর্জাতিক আইনের বহুমাত্রিকতা এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্ব ও অবস্থান-ই ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। সম্মেলনে যোগ দিয়ে নিজের গবেষণাকর্ম সবার সামনে তুলে ধরা মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও এ যাত্রার অন্যতম বড় অনুষঙ্গ ছিল ভিয়েতনামের মানুষ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে নিজের পরিচয় ঘটানো। যে ভাবনা সেই কাজ। যাত্রার শুরুতে প্রস্তুতি ছিল হ্যানয় এবং তার আশপাশের অনন্য নিদর্শনসমূহ ঘুরে দেখা। কিন্তু হ্যানয়ে পা রেখে জানলাম ভিয়েতনামের বিখ্যাত নেতা হো চি মিনের নামে নাম রাখা শহরে না গেলে ভিয়েতনাম ভ্রমণ যে বৃথা। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত; আর কালবিলম্ব নয়, সেদিন রাতেই হো চি মিনের পানে ডানা লাগিয়ে আবার উড়াল দেয়া। আসলেই তাই; হো চি মিনের সঙ্গে হ্যানয়কে মেলান দায়। সচারচার যা ঘটে এখানে তার উল্টো। হ্যানয় কাগজে-কলমে ভিয়েতনামের রাজধানীর তকমা পেতে পারে; কিন্তু ভিয়েতনামের পর্যটনের রাজধানীর নাম হো চি মিন! হ্যানয় কিছুটা শান্ত-নিরিবিলি শহর। আর পাঁচটা রাজধানী শহরের মতো না। রাত দশটা নাগাদ সেখানে নেমে আসে নির্জনতা। আর তার ঠিক উল্টো হলো হো চি মিন। যে শহর কখনও ঘুমায় না; বরং রাতে যার রূপ উপচেপড়ে। সব আনন্দ-উচ্ছ্বাস রাতের অপেক্ষায় প্রহর গোনে। আর সমগ্র শহরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত যে জায়গা তার নাম ভুইবেন। কপালগুণে আমাদের আবাসও সেই ভুইবেনে। মধ্যরাতে হো চি মিনের মাটি স্পর্শ করার পর কিসের নিস্তব্ধতা? সমস্ত যৌবন নিয়ে যেন এ শহর পর্যটকদের আগমনকে স্বাগত জানানোর জন্যই অপেক্ষায় রয়েছে। সেই রাতেই তাই আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা এবং বিনোদনের সকল আয়োজন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা! কয়দিনের যাত্রা ক্লান্তির সঙ্গে সকালের অলস ঘুম যোগ হওয়ায় পরদিন তাই হোটেলের ব্যবস্থাপনায় শহর দর্শনের আয়োজন মিস করে উপায়ন্ত না পেয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ছুটে চলা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কী প্রতাপের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করে ভিয়েতনামের উপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে এনেছিল তারই সাক্ষী যুদ্ধাবশেষ জাদুঘর। ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্রের উত্থানে আতঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ফ্রান্সকে লেলিয়ে দিয়ে সুবিধে করতে না পারায় পরবর্তীতে নিজেই দেশটির উপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে দখলের অপচেষ্টার নিমিত্তে সাধারণ নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ৬৬-তে শেষ হলেও বাংলাদেশকেও যুক্তরাষ্ট্রের মদদে একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে দিনানিপাত করতে হয়েছিল। জাদুঘরের একপ্রান্তে স্পষ্ট বাংলায় লেখা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)’র একটি শুভেচ্ছা বার্তা ‘বিজয়ী ভিয়েতনাম লাল সেলাম, হো চি মিন লাল সেলাম’ শোভা পাচ্ছে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে অনাকাক্সিক্ষতভাবে বাংলা পোস্টার শোভা পেতে দেখা যে কী গর্বের তা এর আগে অনুভূত হয়নি। জাদুঘরের একপ্রান্তে যুদ্ধাবন্দীদের অত্যাচারের সামান্য নিদর্শন প্রদর্শনের ব্যবস্থা। আর আছে আমেরিকার ব্যবহৃত সমরাস্ত্র। দেখলে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না; এই বিশাল অস্ত্রের মুখে দরিদ্র ভিয়েতনাম কিভাবে জয় ছিনিয়ে এনেছিল? আসলে অন্যায্য যুদ্ধ যুগে যুগে নিঃস্ব-দরিদ্রের মনোবলের কাছে কালে কালে পরাভূত হয়। যেমনটা হয়েছিল ৭১-এও! জাদুঘর ঘুরে দেখে শেষ করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলা কু চি গুহার দিকে। শহর থেকে বাসে প্রায় দুঘণ্টার যাত্রাপথ কু চি টানেল। টানেল দেখতে যাওয়ার পথে দেখা হলো যুদ্ধের ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়ান বর্তমান প্রজন্মের ভিয়েতনামিসদের তৈরি কারুপণ্য ও উৎপাদন কৌশল। তবে টানেল দর্শন স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভিয়েতনামিসদের গুহা তৈরির কৌশল, সেখানে কাটান জীবন বা যুদ্ধ জয়ের রণনীতি জানার জন্য নয় বরং আমাদের গাইডের নিদারুণ বর্ণনা, দেশের প্রতি তার মমত্ব, চূড়ান্ত রকমের মজা করতে জানা আর তাঁর ইতিহাস জ্ঞানের দরুণ! কী করেনি সে? যেমন চোস্ত তাঁর ইংরেজী, তেমন গানের গলা; তেমনি সে জানিয়েছে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ভিয়েতনামিসদের সম্পর্কে ধারণা দিয়ে, একই শহরের দুই নামের ইতিহাস জানিয়ে আর তাঁর প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব দিয়ে সে মুগ্ধ করেছে আমাদের। গাইড হলে এ রকম-ই হওয়া উচিত। অথচ প্রথম দেখাতে মনে হয়েছিল অশিক্ষিত বাসকর্মী হয়ত এক! ভিয়েতনামিসরা ইংরেজীতে খুব একটা পারঙ্গম না, তাতে আপাত অসুবিধা হলেও যোগাযোগ থেমে থাকে না। সবকিছুর শেষে দিনান্তে মানুষে মানুষে যোগাযোগের পথে ভাষা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নইলে এই ভরা গ্রীষ্মে ভিয়েতনামে কেন পর্যটকে গমগম করবে? আফসোস হয় শুধু যখন দেখি ঈশ্বর আমাদেরকেও করুণা করতে কার্পণ্য করেননি; কেবল আমাদের নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতায় পর্যটন শীল্পের যে বিশাল বাজার সে বাজারে আমরা এখনও অপাঙতেয়! হো চি মিনের পূর্ব নাম আসলে সাইগন। এখনও কেউ কেউ সে নামে তাকে। হো চি মিন তাঁর মত্যুর পূর্বে জানিয়ে গিয়েছিলেন সাইগন তাঁর জন্মভূমি না হলেও তিনি সাইগনেরই সন্তান এবং সাইগন একদিন ভিয়েতনামের অংশ হবেই। তখন তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাইলে যেন সাইগনের নাম হো চি মিন নামে নামাঙ্কিত করা হয়। সেই থেকে এ শহরের এই দুই নামেই পরিচিত। তবে ভিয়েতনামিসদের যে গুণের প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে তা এঁদের সারল্য এবং পরোপকারিতা। ইংরেজীর দক্ষতা কম থাকলেও জাতি হিসেবে এঁরা যথেষ্ট সভ্য। নইলে কি আর রাতের বেলা ফাঁকা রাস্তায় কেউ ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলে? অন্তত এ বেলায় বাঙালীর মতো অসভ্যতা দেখায় না তাঁরা। আর যে বিষয়ে এঁরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা হলো ট্যাক্সি ব্যবস্থাপনায়। মুঠোফোনে এ্যাপের মাধ্যমে যে কোন শহরেই ট্যাক্সি ডাকার ৬ মিনিটের মধ্যেই ট্যাক্সি আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে আপনার দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হবে। সবই মিটার ট্যাক্সি, তাই অযথা দরাদরির কোন প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের তুলনায় ট্যাক্সি সেবা অনেক সস্তাও বটে। অথচ এই দেশে ট্যাক্সির টিকেটটিও দেখতে পাওয়া এখন ভাগ্যের বিষয়। আর খরচ এবং দামাদামির প্রসঙ্গ না হয় না-ই তুললাম। যে দেশের বিমানবন্দরে নেমে ঠিকমতো ট্যাক্সি সেবাটিই পাওয়া যায় না, সে দেশের অপরিচিত গন্তব্যে যেতে অচেনা কোন ভিনদেশী কোন ভরসায় আসতে চাইবে? তবে ভিয়েতনামে সে অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি। নারীরা নীতিনির্ধারণে এখনও উপেক্ষিত। ভিয়েতনামিস ছেলেরা বয়সী বা মোটা মেয়েদের বিয়ে করতে চায় না। কন্যার পিতাদের তাই মেয়েকে রোগা রাখতে তটস্থ থাকতে হয়। তবে নারীরা সেখানে পুরুষের তুলনায় দুর্দান্ত পরিশ্রমী এবং কর্মঠ। সন্তান লালন, ঘরের কাজ এবং উপার্জন সমানতালে করে যায় তাঁরা! তবে এঁরা অন্যদের মতো কারও সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে তথাকথিত ভদ্রতা দেখায় না। প্রথম দেখাতেই তাই ত্ারা বয়স জানতে চাইবে। কারণ বয়সে বড় হলে তাঁকে এক নামে সম্বোধন করে সম্মান জানাবে আর ছোট হলে ভিন্ন নামে ডেকে হৃদ্যতা বাড়াবে। কত টাকা বেতন পায় তাও নির্দ্বিধায় শুধাবে। কারণ যে বেশি আয় করে সে চেষ্টা করবে অন্যের জন্য ভাল আয়ের ব্যবস্থা করার। এই হলো ভিয়েতনামিসদের স্বভাব! তবে এঁদের বেশিরভাগই নির্দিষ্ট কোন ধর্মের অনুসারী নয়। পূর্বপুরুষদের পূজা করায় তাদের ধর্ম। ক্ষুদ্র কিছু জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মানুসারী। এসবই আমাদের মহান গাইড এ্যালেক্সের কাছ থেকে ধার করা জ্ঞান নিয়ে বর্ণনা করা। তবে এঁদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই আর কিছু না থাকলেও একটি করে স্কুটি আছে। স্কুটিই তাদের মূল বাহন। যারা ধনী তাদের নিজস্ব গাড়ি রয়েছে। গাড়ি এখানে আভিজাত্যের প্রতীক। সঙ্গত কারণেই তাই গণপরিবহন সেভাবে চোখে পড়েনি। আবার ফিরে আসা যাক যুদ্ধ গুহার গল্পে। মূলত ফ্রান্স যুদ্ধের সময় শুরু হয়েছিল কু চি’র গভীর জঙ্গলে প্রায় ২৫০ কি.মি. দীর্ঘ গুহা তৈরির কাজ যার আরও বিস্তৃতি ঘটে মার্কিন আগ্রাসনের সময়। কু চি হলো বিষাক্ত গাছ। কু চি বৃক্ষের আধিক্য থাকায় মার্কিনীরা এই এলাকার নামও সে অনুসারে রেখেছিল। যোদ্ধারা গুহার মধ্যেই জীবনযাপন করত। তাদের প্রাত্যহিক কর্মাদি, খাওয়া-দাওয়া, যুদ্ধ পরিকল্পনা সবই চলত গুহাতে। সেনারা ব্যবহার করত টায়ারের তৈরি জুতো। প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিতে যার অগ্রভাগ থকত বিস্তৃত আর পশ্চাৎ সূচাল। গুহায় কোন মার্কিন সেনা প্রবেশ করলে জুতোর গন্ধে প্রতিপক্ষকে চেনা যেত। কারণ টায়ারের জুতো গন্ধ ছড়াত না, অন্যদিকে বৃষ্টিস্নাত ভেজা এলাকায় মার্কিনীদের জুতো ভিজে দুর্গন্ধ ছড়াত; ফলে আলোবিহীন গুহায় সহজেই শত্রু ঘায়েল করা যেত। এ ছাড়াও গুহার চারপাশে বিভিন্ন জায়গায় গুপ্ত ফাঁদ পাতা থাকত শত্রুদের বাগে আনতে। সবশেষে যুদ্ধগুহা পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর! ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বর্তমানে ২০ মিটারের মতো ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। তা পাড়ি দিতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! যুদ্ধ-বিগ্রহের নিদর্শন দর্শন শেষে হোটেলে ফিরে পরের দিনের ভ্রমণের বন্দোবস্ত করে উ™£ান্তের মতো শয্যার জোগাড় যন্ত্র করা। কিন্তু হায়! বিধিবাম। পরেরদিন সকালে আমার সফরসঙ্গী ভুইবেনে এক বাঙালীর দেখা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সফরের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ছুটে চলল তার আবাসপানে। আসলে বেচারা এই কয়টা দিন ভিয়েতনামের অপরিচিত রসনায় অর্ধাহারে-অনাহারে কাটিয়ে বাঙালীর দেখা পেয়ে তার দেয়া গরুর মাংস ভুনা খাওয়ার নিমন্ত্রণ ফেলতে পারেনি। ফলস্বরূপ ভ্রমণ শিকেয় উঠলেও আগে থেকে নিশ্চিত করায় নির্ধারিত ফি থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। যাই হোক, অতঃপর দেশী ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাংলায় প্রাণখুলে কথা চালিয়ে তার স্থানীয় বন্ধুর সহায়তায় দিনভর চলল টুকটাক কেনাকাটা। বেলাশেষে পুনরায় হ্যানয়ে পথে উড়াল দেয়া। ভিয়েতনাম সফরের শেষদিন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হা লং বে’র অপরূপ রূপের আস্বাদনে বাসযোগে প্রাতেই গমন করা। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সে রূপের লেশ দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য হলো! প্রকৃতি যেন রূপের ডালি সাজিয়ে বসে আছে যেন হা লং বে-তে। ছোটবড় প্রায় দুই হাজার দ্বীপ রয়েছে এই উপসাগরে। যাদের নামও বেশ অদ্ভুত! একটার নামতো মোরগ যুদ্ধ দ্বীপ! হা লং বে’র একপাড়ে রয়েছে পর্যটকদের জন্য কায়াক চালানোর ব্যবস্থা। দুজন মিলে কায়াক চালাতে চালাতে পাড়ি দিয়ে দেয়া যায় ছোট্ট সুরঙ্গ। কী চমৎকার সে নিসর্গ! শহুরে জীবনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে ডুব দিতে মন চায় হা লং বে’র স্বচ্ছজলে। জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে আর মধ্যাহ্নভোজন সারতে সারতে সাগরের রূপ চুপি চুপি আস্বাদন করার মধ্যে যে স্বর্গীয় প্রশান্তি রয়েছে তা এই প্রথম উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হলো। তবে বিস্ময়ের শেষ এখানেই নয়। সাগরপাড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব নিয়ে দাঁড়ান বিশাল সুরঙ্গ। জেলেরা বাঁদরের দলকে অনুসরণ করে এই সুরঙ্গ আবিষ্কার করেছিল। সুরঙ্গটি চমৎকারভাবে সাজিয়েছে পর্যটন কর্তৃপক্ষ এবং তুলে ধরেছে ভিয়েতনামী ঐতিহ্য। তবে ভিয়েতনাম সম্বন্ধে যে প্রসঙ্গ না পাড়লে এ ভ্রমণ কাহিনী অসম্পূর্ণ থাকবে তা হলো তাদের মুদ্রা। এদের মুদ্রার নাম ভিয়েতনাম ডং বা সংক্ষেপে ঠঘউ। যার সর্বনিম্ন নোটটি ১ হাজার মূল্যমানের এবং সর্বোচ্চটির মূল্যমান ৫ লাখ মাত্র! নোটের অঙ্ক থেকেই অনুমেয় কতটা মূল্য আসলে নোটগুলো বহন করে! বঙ্গ টাকার একটি নোটের বিনিময়ে এদের প্রায় ২৮৫টি নোট পাওয়া যাবে আর শত ডলারের মার্কিন মুলুকের নোটের বিনিময়ে পাওয়া যাবে ২২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডং! তবে শুধু আমরা না; অনেক পর্যটককেই দেখেছি নতুন এসে ডংয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অবশেষে ত্রাতা হয়ে পাওনাদারকেই কাছা দিয়ে ডংয়ের হিসাব মেলাতে মাঠে নামতে হচ্ছে।
×