ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশান-শোলাকিয়া হামলা ॥ আটক শফিউলের জবানবন্দীতে চাঞ্চল্যকর তথ্য

‘ব্যাক আপ পার্টির’ চার জেএমবি জঙ্গী আটক

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৫ জুলাই ২০১৬

‘ব্যাক আপ পার্টির’ চার জেএমবি জঙ্গী আটক

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার ‘ব্যাক আপ পার্টির’ চার জেএমবি জঙ্গী আটক হয়েছে। আটককৃত জেএমবির চার জঙ্গী হলো- বাইক হাসান ওরফে নজরুল, জাহাঙ্গীর ওরফে রাজিব গান্ধী, সাদ্দাম ওরফে রুহুল, রিয়াজুল ওরফে মেহেদি। তাদের উত্তরাঞ্চল থেকে আটক করা হয়েছে। তারা রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, রংপুর, নীলফামারী, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৫টি সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা- সংঘটিত করেছে। ঈদের দিন শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার দিন আহতাবস্থায় আটক হওয়ার পর চিকিৎসাধীন জেএমবির সদস্য শাফিউলের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী রাজধানীর গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ব্যাকআপ পার্টির চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও তদন্তে জঙ্গী গ্রুপগুলো সম্পর্কে শোলাকিয়ায় আটক হওয়া জঙ্গী শাফিউলের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে অন্তত ১২টি জঙ্গী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিটি গ্রুপে অন্তত ৭ থেকে ৮ জনের দলের গ্রুপ কিলিং মিশনে অংশ নিচ্ছে জঙ্গীরা। জামায়াত-শিবির থেকে আসা জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশে (জেএমবি) যোগদানকারী ১২টি জঙ্গী গ্রুপের শতাধিক জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক জঙ্গীর নামের তালিকা সংগ্রহ করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাইক হাসান ও সাদ্দাম নামে দুই জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দারা। এছাড়াও বৃহস্পতিবার রাজধানীর উত্তরা থেকে কামরুজ্জামান ওরফে সাগর ও মোঃ রাশেদ গাজী ওরফে রাশেদ নামে জেএমবির দুই জঙ্গী সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। শোলাকিয়ার সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দুই জঙ্গী ও গুলশানের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তিন জঙ্গীকে খোঁজা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় অন্তত ছয়টি জঙ্গী আস্তানার খবর পেয়েছে গোয়েন্দারা। গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মুখে জঙ্গী আস্তানাগুলো গুটিয়ে অনেক জঙ্গী সদস্য উধাও হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিত যে জঙ্গী গ্রুপটি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে সে গ্রুপটি প্রশিক্ষণ নিয়েছে উত্তরাঞ্চলের যুমনার চরাঞ্চল এলাকায়। গত ২৭ জুন যুমনার চরাঞ্চল এলাকা থেকে এ গ্রুপটি আসে রাজধানী ঢাকায়। বনানী এলাকায় এক ভাড়া করা বাড়িতে এসে অবস্থান নেয় তারা। তিন দিন ধরে রেস্তরাঁটি রেকি করে জঙ্গী গ্রুপটি। ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার আগে জঙ্গী গ্রুপটি ইফতারি করেছে। ইফতারি করেছে হলি আর্টিজান বেকারি এলাকার আশপাশের রেস্তরাঁয়। যে গ্রুপটি সরাসরি হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে তাদের ব্যাকআপে ছিল আরেকটি জঙ্গী গ্রুপ। ব্যাকআপ পার্টিতে থাকা তিন জঙ্গীকে খুঁজছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, শোলাকিয়ার হামলার আগে জঙ্গী নেতা জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে চার জঙ্গী আবদুস সাত্তারের বাড়িতে বাসা ভাড়া নেয় জঙ্গী গ্রুপটি। যে চার জঙ্গী বাড়ি ভাড়া নিয়েছে তার মধ্যে আবির রহমান নামে একজন নিহত হয়েছে। শাফিউল নামে আরেকজন গুরুতর আহতাবস্থায় আটক হয়েছে। অপর দুই জঙ্গী শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার পর পালিয়ে গেছে। র‌্যাবের প্রহরার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাফিউলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জঙ্গী গ্রুপগুলো সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, আটক শাফিউলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে উত্তরাঞ্চল এলাকায় বাইক হাসান ও সাদ্দাম নামে দুই জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দুই জঙ্গী গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন জঙ্গীদের নামের তালিকা দিয়েছে শোলাকিয়ার ঘটনার সময়ে আটক র‌্যাব হেফাজতে চিকিৎসাধীন জঙ্গী শাফিউল। শাফিউলের দেয়া তথ্যানুযায়ী রাজধানী ঢাকার মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর ও আশুলিয়ায় জঙ্গী আস্তানা রয়েছে। এসব আস্তানার সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু জঙ্গী আস্তানাগুলোতে কোন জঙ্গী সদস্যকে না পাওয়া গেলেও বুধবার গভীর রাতে উত্তরায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ দুই জেএমবি জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে উত্তরাঞ্চলে গ্রেফতার হওয়া বাইক হাসান ও সাদ্দাম গ্রেফতার হওয়া সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃপক্ষ স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করছে না। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম জেলা ও আশপাশের এলাকার জামায়াত-শিবিরের যুবক ও তরুণরা জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে আত্মঘাতী দলের গ্রুপে যোগ দিচ্ছে। এসব এলাকার জঙ্গীদের বেশিরভাগই খুব বেশি উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান নয়। তবে তাদের সঙ্গে রয়েছে রাজধানী ঢাকার বেশকিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা বিত্তবান ঘরের সন্তান হয়েও জঙ্গী খাতায় নাম লিখিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর তদন্তে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। তাদের প্রশিক্ষণদানের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কেও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, সম্ভাব্য জঙ্গী হামলার আশঙ্কা থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিখোঁজদের তালিকা তৈরি, নিরাপত্তা জোরদার, তল্লাশি অভিযান, চেকপোস্ট, জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ আছে এমন অনেকের নাম তালিকায় উঠে আসছে। গোয়েন্দা জালে অনেক জঙ্গী আটকা পড়ছে। হলি আর্টিজানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ ॥ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, সন্ত্রাসী হামলার আগে রেস্তরাঁটিতে রেকি করার জন্য গিয়ে রেস্তরাঁয় খাবার খেয়েছিল জঙ্গীরা। এ সময় জঙ্গীরা রেস্তরাঁর কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেছে, যা সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়েছে। এজন্য হলি আর্টিজান বেকারির ২৩ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ, তাদের পার্সোনাল ফাইল ইত্যাদির খবর নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও জঙ্গী সন্দেহে সেখান থেকে আটক সাইফুল ও শাওন নামে দু’জন আহতাবস্থায় আটকের পর হাসপাতালে মারা গেছে। বৃহস্পতিবারও হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর কর্মচারী লাজারু সারেন ও জাকিরুল ইসলাম নামে দু’জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তদন্তকারীদের তত্ত্বাবধানে।
×