ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৫ জুলাই ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ বেশ আনন্দঘনই ছিল ঈদের দিনগুলো। লম্বা সরকারী ছুটি দারুণ কাজে লাগাতে দেখা গেছে রাজধানীবাসীকে। ফাঁকা ঢাকায় নতুন পোশাক পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন ছেলে-বুড়ো সকলে। আত্মীয়-পরিজনের বাসায় নেমন্তন্ন খেয়েছেন। এই করতে করতেই ছুটি শেষ। ঈদ করতে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। গাঁয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোর পর ফিরে এসেছেন তারাও। ফলে ফাঁকা ঢাকা আর নেই। চিরচেনা রূপে ফিরেছে ঢাকা। সব ধরনের অফিস আদালত খুলেছে। এখন আবারও সকাল ৯টায় শুরু হয়ে সরকারী অফিস চলছে ৫টা পর্যন্ত। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ক্লাস চলছে পুরোদমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হবে রবিবার থেকে। গণপরিবহনের সংখ্যা বেড়েছে। যারপরনাই ব্যস্ত সড়ক। যথারীতি শুরু হয়ে গেছে যানজট। তবে ঈদ উদ্যাপনের যে আনন্দ এখনও লেগে আছে চোখে মুখে। বর্ষার বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে রক্ত। হয়ত ধুয়ে গেছে; কিন্তু শোক কাটেনি। ভয়ঙ্কর ক্ষত বুকে। মানবিক মানুষের মাতম থামছে না। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর ভেতর যে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকা-, এখনও বেদনায় ডুবাচ্ছে রাজধানীবাসীকে। গত ১ জুলাইয়ের ঘটনায় বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা স্তম্ভিত। এদিন কী অবলীলায় হত্যা করা হলো বিদেশীদের! বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশকে ভালবেসে এসেছিলেন যারা, যারা উন্নয়ন সহযোগী, বন্ধু সুহৃদ যারা, খুন করা হলো সকলকে। এ দেশের যারা, যারা এমনকি ইসলাম ধর্মাবলম্বী তাদেরও ইসলামের নামে খুন করা হলো! কী যে কষ্টের ছিল একেকটি মৃত্যু! না, কিছুতেই ভুলতে পারছেন না নগরবাসী। এতবড় অন্যায় কী করে সম্ভব? ভেবে পাচ্ছেন না তারা। অতিথিপরায়ন বাঙালীর মাথা লজ্জায় নুয়ে আছে। একটু খেয়াল করলেই সেটি অনুমান করা যায়। অনুভব করা যায়। আলো জল হাওয়া যেন প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে- বড় অন্যায় হলো। বড় অন্যায়। সাধারণ মানুষও বিষণœ; ব্যাকুল। কিছুই তারা করতে পারেননি। তাই হয়ত শোকটাই বড় হয়ে সামনে আসছে। সমব্যথী মানুষ প্রতিদিনই ছুটে যাচ্ছেন গুলশানে। না, হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ পর্যন্ত পৌঁছা যাচ্ছে না। এখন রেস্তরাঁটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আশপাশের রাস্তায় কাঁটাতারের ব্যারিকেড। যেন বুকেও বিঁধে আছে কাঁটাতার। আর তাই প্রতিদিন বহু মানুষ হলি আর্টিজানের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াচ্ছেন। হাতভর্তি করে আনা ফুল বিছিয়ে দিচ্ছেন ৭৯ নম্বর সড়কের এক কোণে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ব্যক্তিগতভাবে আসছেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা ছেলে-মেয়েদেরও ছুঁয়ে গেছে এই শোক। ফুল হাতে তারাও আসছে। এখানে নিহত মানুষগুলোর ছবি সংবলিত ডিজিটাল ব্যানার টানানো হয়েছে। একাধিক ব্যানারে লেখা- উই আর স্যরি। ফুল দিতে আসা মানুষগুলোও সেদিকে সজল চোখে তাকিয়ে থাকছেন। ব্যথিত মুখগুলো দেখে মনে পড়ে যায় জাতীয় সঙ্গীতের সেই চরণ- মা, তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি...। গুলশান ট্র্যাজেডির পর রাজধানী ঢাকার প্রতিদিনের জীবনে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। কারও সঙ্গে পাছে নেই এমন মানুষও নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছেন। কোন কারণ হয়ত নেই। তবু এক ধরনের আতঙ্ক তাদের তাড়া করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, জঙ্গীরা আরও হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক ছন্দে নেই ঢাকার জীবন। বিশেষ করে গুলশানের কূটনৈতিকপাড়া এখনও থমথমে। বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, বিদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তারা খুব জরুরী কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে চাইছেন না। সামান্য দূরত্বে যেতেও পুলিশের সহায়তা চাইছেন তারা। বিদেশীদের অনেকেই দীর্ঘকাল ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন। কারও চাকরি; কেউ ব্যবসা নিয়ে আছেন। দূর দেশের নাগরিক হলেও, এ শহর তাদের খুব চেনা। অথচ গুলশানের ঘটনা বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে। গুলশান ও বারিধারা এলাকায় গত কয়েক দিন ঘুরে এমন ধারণা হয়েছে। এসব এলাকার কিছু রাস্তা আপাতত বন্ধ রয়েছে। আগে কূটনৈতিক, দাতা ও সাহায্য সংস্থার গাড়ি তল্লাশি করা হতো না। বর্তমানে সব গাড়িই তল্লাশির আওতায় আনা হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিসহ সব পর্যায়ের ভিআইপিদের যানবাহনও প্রয়োজনে তল্লাশি করা হবে বলে জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে বদলে গেছে প্রতিদিনের জীবন। গুলশানে হামলার পর গোটা রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ঢেলে সাজানোর প্রয়াস চোখে পড়ছে। এখন শহরের বিভিন্ন সড়কে পুলিশের চেকপোস্ট। এসব চেকপোস্টে র‌্যাব, বিজিবি, এপিবিএন, এসপিবিএন ও আনসারের চৌকস সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের এ দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসব চেকপোস্টে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক শনাক্ত করতে থাকবে মেটাল ডিটেক্টরসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। এরই মাঝে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনার নিরাপত্তা নতুন করে পরীক্ষা করার কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় সংসদ ভবনের নিরাপত্তা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। গত বুধবার সংসদ ভবন এলাকার নিরাপত্তা আরও জোরদারের পাশাপাশি সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছেন ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া। শিল্পকলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করা এখন দুরূহ কাজ হয়ে গেছে! নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে কয়েকগুণ। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনেও এত পুলিশ আগে দেখা যায়নি। এখন টিকেট কাউন্টারের সামনে অস্ত্র হাতে দায়িত্ব পালন করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এভাবে প্রায় সব সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেই জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা।
×