ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করাই উদ্দেশ্য ;###;দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী জড়িত ;###;অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে এরাই ;###;উন্নয়ন অগ্রযাত্রা রোধ ও শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করাই মূল লক্ষ্য

উত্থান চেষ্টার নেপথ্যে ॥ জামায়াতী ঘরানার লোকদের মদদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৫ জুলাই ২০১৬

উত্থান চেষ্টার নেপথ্যে ॥ জামায়াতী ঘরানার লোকদের মদদ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গুলশানে এবং শোলাকিয়ার ঈদের জামাতের প্রবেশ পথে জঙ্গীদের হিংস্র ও বর্বর হামলার জঙ্গীবাদী কার্যকলাপের বীজ অনেক আগেই বপন করা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করা তথা স্বাধীনতাকে বিপর্যস্ত করার জন্য ইসলামী জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীগুলো তৎপরতা শুরু করে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করাই এই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। অর্থায়ন এবং পৃষ্ঠপোষকতা আসছে এদের কাছ থেকেই। বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব প্রমাণে মরিয়া এই যৌথ শক্তি। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা রোধ এবং আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের এজেন্ডা এখন তাদের সামনে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক পুরোপুুরি ভেঙ্গে দিয়ে লক্ষ্যার্জনে তারা কাজ করে যাচ্ছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের অদূরে হামলার ঘটনা ঘটানো হয়। নতুন নতুন জঙ্গী সংগঠনের আবির্ভাব ঘটানো এই গোষ্ঠীর পুরনো কৌশল। সম্প্রতি হুজি, জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, আনসার আল ইসলামের পর দৌলাতুল ইসলাম। তারও আগে ছিল নানা নামে। গুলশান হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত একটি রুমালে নতুন সংগঠনটির নাম এসেছে দৌলাতুল ইসলাম। আদৌ এ নামে কোন জঙ্গী সংগঠন আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে প্রকৃতপক্ষে জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা বাড়েনি। নাম বদলানো তাদের পুরনো কৌশল। যখনই কোন জঙ্গী সংগঠন আলোচনায় আসছে, তখনই তারা নাম পাল্টে ফেলছে। হত্যাকা-সহ নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের আড়াল করতেই এমন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। ঘন ঘন নাম পাল্টানো জঙ্গী সংগঠনগুলোর আদি কৌশল। গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সূত্রপাত শুরু হয় ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকেই। স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই পরাজিত শক্তি টিকে থাকার নানা কৌশল অবলম্বন করে সংগঠিত হতে থাকে। বাংলাদেশে যে ক’জনকে জঙ্গীবাদের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাদের সবাই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। অনেকেই দলটির নেতা। এদের মধ্যে অন্যতম মুফতি এসকে আব্দুস সালাম। এই জঙ্গী নেতা সব জঙ্গী সংগঠনকে শেষ মুহূর্তে একবারের জন্য হলেও সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সব জঙ্গী সংগঠন নিয়ে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (আইডিপি) নাম ধারণ করে নির্বাচন কমিশন থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে জোরালো চেষ্টাও করেছিলেন। আইডিপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাইয়ে দিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও চেষ্টা হয়েছিল। এ খাতে বহু অর্থ খরচ করেছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রটি। সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা সফল করতে পারেনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রটি। আফগান যুদ্ধ ও বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের সম্পর্ক ॥ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের প্রবক্তাদের একজন মাওলানা এসকে আব্দুস সালাম। তার পিতার নাম এসকে মাজহার আলী (মৃত)। বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট থানার পানশীবাড়ি গ্রামে। আব্দুস সালাম বগুড়া জেলার শেরপুর থানাধীন ফাতেমা-তুজ-জোহরা মহিলা মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ১৯৭৮ সালে দাওরা হাদিস পড়তে পাকিস্তানের লাহোরের জামিয়া আশরাফিয়া মাদ্রাসায় (কওমী মাদ্রাসা) ভর্তি হন। এর এক বছর পরেই ১৯৭৯ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ চলে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তান থাকাকালে ১৯৮৬ সালে আব্দুস সালাম প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ চলার সময় সম্মেলনের ডাক দেন আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদাপ্রধান ওসামা বিন লাদেন। আফগানিস্তানের খোস্ত শহরের সেই সম্মেলনে বিদেশী যোদ্ধা হিসেবে এসকে আব্দুস সালাম ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ও কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তার প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটে। লাদেনের কথায় বাড়তি মনোবল পেয়ে তিনি সাহসী যোদ্ধা হিসেবে আফগান যুদ্ধে অংশ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আফগানিস্তানের খোস্ত শহরের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে একে-৪৭ রাইফেলসহ ভারি অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এরপর পুরোদমে যুদ্ধ ময়দানে নামেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাংলাদেশী সাথী শেখ ইসমাইল, মঞ্জুর হাসান, পাকিস্তানের করাচীর বাসিন্দা শাহাদৎ হোসেন ও আব্দুর রহমান নিহত হন। যুদ্ধ থেকে তিনিসহ বাংলাদেশী নাগরিক আব্দুর রহমান ফারুকী ও পাকিস্তানী নাগরিক আলমাস জীবিত ফিরেন। পরবর্তীতে আলমাস পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নী দাঙ্গায় নিহত হন। ১৯৮৭ সালে আবার তিনি আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের লাহোরের সেই মাদ্রাসায় ফিরে যান। এ মাদ্রাসা থেকেই ১৯৮৮ সালে দাওরা হাদিস পাস করেন। ১৯৮৮ সালের নবেম্বরে আবার আফগান যুদ্ধে অংশ নেন। টানা প্রায় তিন মাস যুদ্ধ করেন। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার তিনি পাকিস্তানের করাচীতে চলে যান। ওই বছরের মার্চে তিনি করাচী থেকে বাংলাদেশে ফেরেন। আহলে হাদিস আন্দোলন ও জঙ্গীবাদ বিস্তার ॥ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব আহলে হাদিস আন্দোলন শুরু করেন। এই শিক্ষকের স্বপ্ন বাংলাদেশে একদিন খেলাফত অর্থাৎ ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হবে। এমন লক্ষ্য নিয়েই তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন অবস্থা চলার সময় আফগান যুদ্ধ থেকে দেশে ফেরার পর শীর্ষ ছয় জঙ্গীসহ হুজি নেতা মুফতি হান্নানও আহলে হাদিস আন্দোলনে যোগ দেন। ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া শীর্ষ ছয় জঙ্গীর মধ্যে জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানির তথ্য মোতাবেক আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীসহ বিদেশী কূটনৈতিক মহল আহলে হাদিস আন্দোলনকে পুঁজি করে। তারা ১৯৯০ সালে আহলে হাদিসকে নানাভাবে সহায়তা করতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় তাওহীদ ট্রাস্ট। ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক গালিব আর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রেজাউল করিম। পরবর্তীতে ফান্ডের টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে অধ্যাপক রেজাউল করিম আলাদা হয়ে যান। ওই ট্রাস্টের নামে আসা অর্থ দিয়ে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, গাইবান্ধাসহ ওই অঞ্চলের গ্রামেগঞ্জে মসজিদ, মাদ্রাসা ও মক্তব তৈরি হতে থাকে। পরবর্তীতে আহলে হাদিস আন্দোলন মতপার্থক্যের কারণে ভেঙ্গে যায়। অধ্যাপক গালিব চেয়েছিলেন মানুষকে বুঝিয়ে ইসলামের পথে আনা। একপর্যায়ে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। কিন্তু আফগান ফেরত যোদ্ধাদের মতামত বুঝিয়ে শুনিয়ে মানুষকে ইসলামের পথে আনা কঠিন। আর সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব নয়। এমন মতপার্থক্যের কারণেই আফগান ফেরত যোদ্ধারা বিশেষ করে শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও মুফতি হান্নান আহলে হাদিস আন্দোলন থেকে বেরিয়ে নানা জঙ্গী সংগঠন তৈরি করেন। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হুজির (হরকত-উল-জিহাদ) জন্ম ॥ ১৯৮৯ সালে আফগান যুদ্ধ থেকে যশোরের বাসিন্দা আব্দুর রহমান ফারুকী দেশে ফেরার পরেই শুরু হয় বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সাংগঠনিক গোড়াপত্তন। তিনি দেশে ফিরেই হরকাতুল জিহাদিল ইসলামী নামে একটি দল গঠন করেন। পরবর্তীতে দলটি হরকত-উল-জিহাদ অব বাংলাদেশ সংক্ষেপে হুজিবি নাম ধারণ করে। পরে হুজিবিই হুজি নাম ধারণ করে। আব্দুর রহমান ফারুকী দলটির আমির নিযুক্ত হন। দল গঠন করার পর পরই ১৯৮৯ সালে আব্দুর রহমান আবার আফগানিস্তানে চলে যান। এ সময় আরেক আফগান ফেরত যোদ্ধা মুফতি আব্দুল হাই দলের ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানের নজীবুল্লাহ সরকারের সঙ্গে আফগান মুজাহিদদের এক ভয়াবহ যুদ্ধে আব্দুর রহমান ফারুকী নিহত হন। এরপর থেকেই আফগান ফেরত যোদ্ধা কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার বাসিন্দা মুফতি আব্দুল হাই হুজির স্থায়ী আমির নিযুক্ত হন। আফগান যুদ্ধে কত বাংলাদেশী অংশ নিয়েছিলেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের ১ হাজার ৮০ জন অংশ নিয়েছিলেন বলে বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৯২ সালে আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধ করার পর দেশে ফেরেন একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা হামলায় কারাবন্দী মুফতি হান্নান। তিনি ১৯৯৩ সালে প্রায় ৩ হাজার আফগান ফেরত মুজাহিদকে নিয়ে ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলায় জাগো মুজাহিদ নামের একটি সংগঠনের নামে অফিস খোলেন। পরবর্তীতে মুফতি হান্নান হুজিতে যোগ দেন। ১৯৯৩ সালে মুফতি আব্দুস সালামকে হুজির আমির নিযুক্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালে আফগান ফেরত যোদ্ধা কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের বাসিন্দা মুফতি শফিকুর রহমানকে হুজির আমির নিযুক্ত করা হয়। এদিকে ১৯৯৫ সালে শীর্ষ ছয় জঙ্গীর মধ্যে অন্যতম শায়খ আব্দুর রহমান হুজিবিতে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে হুজির বিরুদ্ধে জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে। এ সময় হুজি নেতৃবৃন্দ সরকারের চোখ ফাঁকি দিতে হুজিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এরপর হুজিকে আড়াল করতে নাম পাল্টিয়ে ইসলামী দাওয়াতে কাফেলা ও সর্বশেষ ইসলামী গণ আন্দোলন নাম দেয়া হয়েছিল। হুজি থেকে তা আমির উদ্্ দ্বীনের জন্ম যেভাবে ॥ হুজি বিলুপ্ত ঘোষণার পর ১৯৯৪ সালে দলটিতে যোগ দেয়া আফগান ফেরত যোদ্ধা মুফতি মাওলানা আব্দুর রউফ দলটি ছেড়ে চলে যান। পরে তিনি তা আমির উদ্ দ্বীন নামে একটি নতুন জঙ্গী দল গঠন করেন। তিনি দলটির আমির হন। দলটির বর্তমানে যৎসামান্য কার্যক্রম রয়েছে। তা আমির উদ্-দ্বীন থেকে ইসলামী জিহাদ আন্দোলন ॥ ১৯৯৪ সালে চাঁদপুর জেলার হাইমচরের বাসিন্দা আফগান ফেরত যোদ্ধা আবু জিহাদ হুজিতে যোগ দেন। আবু জিহাদ মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে জিহাদের দাওয়াত দেয়া ও জঙ্গীদের অস্ত্রগোলাবারুদের ট্রেনিং দিতেন। চট্টগ্রামের নাইক্ষ্যংছড়ির গহিন জঙ্গলের জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে ১৯৯৬ সালে যে ৪১ জঙ্গী ট্রেনিংরত অবস্থায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, আবু জিহাদ তাদের অন্যতম। দুই বছর পর জামিনে কারামুক্ত হন তিনি। এরপর নিজের নাম আবু জিহাদ অনুসারে ‘ইসলামী জিহাদ আন্দোলন’ নামে একটি জঙ্গী দল গঠন করেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় খায়রুল কুরুন নামে তার একটি নিজস্ব মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসা ছাড়াও খায়রুল কুরুন ফাউন্ডেশন নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এ মাদ্রাসা থেকেই ইসলামী জিহাদ আন্দোলন ও ফাউন্ডেশনের আড়ালে জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বর্তমানে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম তেমন নেই বললেই চলে। আহলে হাদিস ভেঙ্গে ধাপে ধাপে জেএমজেবি ও জেএমবি সৃষ্টি হয় ॥ শীর্ষ ছয় জঙ্গীর মধ্যে শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ তার অনুসারীরা আহলে হাদিস আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন আফগান ফেরত যোদ্ধা বর্তমানে কারাবন্দী মুফতি হান্নান। আহলে হাদিস থেকে বেরিয়ে যাওয়া শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও মুফতি হান্নান আহলে হাদিসের তাওহীদ ট্রাস্টে থাকা বিপুল অঙ্কের টাকার অর্ধেক পান। প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ ৪শ’ কোটি টাকা বলে জানা যায়। শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে বেশকিছু জঙ্গী চলে আসেন। বাকিরা আহলে হাদিস আন্দোলনের সঙ্গে থেকে যান। ভাগের টাকা দিয়ে শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই জেএমজেবি (জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ) নামে দল গঠন করেন। সেটি ১৯৯৮ সালের কথা। দলটির নেতৃত্বে থাকেন শায়খ আব্দুর রহমান। সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে থাকেন সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই। পরবর্তীতে জেএমজেবিই জেএমবি নাম ধারণ করে। জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার আতাউর রহমান সানির তথ্য মোতাবেক, জেএমজেবি গঠনের সময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ একসঙ্গে ২ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। এছাড়া ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) যুগপৎ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। পুরো দেশে নেটওয়ার্ক তৈরিসহ হামলা চালাতে ব্যয় হয়েছিল ১২শ’ কোটি টাকা। এসব টাকা এসেছে বিদেশ থেকে। বাংলাদেশের অনেক এনজিও এর সঙ্গে জড়িত। ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার চাপের মুখে জেএমজেবিকে নিষিদ্ধ করে। পরবর্তীতে জেএমবিকেও নিষিদ্ধ করা হয়। যেভাবে জামায়াতে ইসলামী জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয় ॥ জঙ্গী সংগঠনটির আমির মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পায়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কারাবন্দী আমির সাইদুর রহমান জাফর ১৯৫৯ সালের ১৪ আগস্ট বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানাধীন কুজাপুর এলাকার মীরপুরবাজার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী আব্দুল মতিন। মায়ের নাম রুজোনুন্নেছা। মৌলভীবাজার দারুল উলুম ও সিলেট দরগা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। পড়ার সময়েই ১৯৭৭ সালে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরে যোগদান করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্র শিবিরের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। ছাত্র শিবিরের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি থাকা অবস্থায়ই ১৯৮০ সালে তিনি মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা তরিকুন্নেছার সঙ্গে প্রথম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম ঘরের সন্তানরা হচ্ছে শামীম ওরফে সুমন (২৫), নাসিম (১৯), ফাহিম (১৭), বাশার ওরফে নাইম ও শিরিন। বাশার জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। ১৯৮১ সালে সাইদুর রহমান জামায়াতে ইসলামীর মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ১৯৮৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর মৌলভীবাজার জেলা শাখার আমির নিযুক্ত হন। একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য হন। জামায়াতে ইসলামীর নেতা থাকা অবস্থায়ই দলের নির্দেশেই তিনি জেএমবিতে যোগ দেন। যদিও জামায়াতে ইসলামী এমন অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করে আসছে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালে সাইদুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জেএমবির শতকরা ৮৫ ভাগ সদস্য ছাত্র শিবিরের। যদিও এমন অভিযোগ মিথ্যা বলে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির দাবি করে থাকে। জেএমবি থেকে হিযবুত তাহরীর ॥ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। তাকে বাংলাদেশের আধুনিক জঙ্গীবাদের জনকও বলা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন নব্বইয়ের দশকে তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান। সেখানেই তিনি হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে তিনি জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়াতে শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে ফেরেন। যোগ দেন পুরনো কর্মস্থলে। ২০০২ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে তিনি বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের শাখা গঠনের চেষ্টা করতে থাকেন। তার সঙ্গে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ। দুই শিক্ষকের সঙ্গে যোগ দেন হালের আলোচনায় থাকা বেসরকারী নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক শেখ তৌফিক। পরে উত্তরার একটি এনজিও কার্যালয়ে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে হিযুবত তাহরীর। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠকের মধ্যদিয়ে দলটি আনুষ্ঠানিক কার্যকম চালু করে। দলটির দলীয় কার্যক্রম চালাতে ছাত্রশিবির সহায়তা করে। ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ২৩৪ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের খায়রুন্নেসা ভবনের নিজস্ব ঘাঁটিতেই দলটিকে দলীয় কার্যক্রম চালানোর জন্য অফিস দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ সব সরকারী-বেসরকারী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম এখনও চালু আছে। জঙ্গী সংগঠনটির সঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, হুজি, জেএমবি, লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মোস্তফা, উলফা, কমতাপুর লিবারেশন ফ্রন্ট, আফিস রেজা কমান্ডো ফোর্সসহ দেশী-বিদেশী বহু উগ্র ও জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিযবুত তাহরীরকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৩টি দেশে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ। আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ॥ ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নিজ বাড়ির সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় প্রকৌশলী রাজীব হায়দার শোভনকে (৩৭)। তিনি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। রাজীবের জানাজা আদায়কারীকে হত্যার হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সাবেক কর্মী শফিউর রহমান ফারাবী। তিনি গ্রেফতার হন। তার তথ্য মতেই একে একে গ্রেফতার হয় রাজীবের হত্যাকারী নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), এহসান রেজা ওরফে রুম্মন (২৩), নাইম শিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজ (২২)। তারা আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানায়, ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই তারা রাজীবকে হত্যা করেছে। তারা আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য। দলটির আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানি। এরপর রাহমানীসহ দলটির অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধ জেএমবি ও হিযবুত তাহরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া বেশ কিছু সদস্য মিলে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম গঠন করে। এটি ২০০৯ সালের কথা। দলটি বাংলাদেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে সশস্ত্র বিপ্লব করছে। দলটির সার্বিক তদারকি করতেন জেএমবির কারাবন্দী আমির জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই ইজাজ ওরফে কারগিল। মুফতি ইজাজ জামায়েতুল মুসলিমীন নামের একটি উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের বাংলাদেশ শাখার আমির ছিলেন। এ সংগঠনটির আন্তর্জাতিক আমির জর্দান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শেখ আবু ইসা আলী আররিফাই আল হাশেমী আল কোরাইশি-ই-আবু ইসা। আবু মুসা ২০০২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি প্রথম দলটির কার্যক্রম চালু করেছিলেন। ইজাজ পাকিস্তানের একটি জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাকিস্তানী বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। এরপর থেকেই দলটির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছেন সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টাকারী বহিষ্কৃত মেজর জিয়া। দলটি আল কায়েদার অনুরূপ আদর্শ, নীতি এবং কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে। সেই লক্ষ্যে তারা ৪ থেকে ৫ জন করে একেকটি ছোট ছোট গেরিলা সিøপার সেল গঠন করে। সেলগুলোই একেকটি হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটেনে গিয়ে গ্রেফতার হন। আবু মুসা ও ইজাজের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য হিসেবে উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে ২০০৮ সালে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তেহজীব, রেজওয়ান শরীফ, নাফিস ও মইনউদ্দিন ইয়েমেনে গমন করে। তাদের সঙ্গে আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ঘনিষ্ট সহযোগী সামির খানের যোগাযোগ হয়। সেখানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ২০০৯ সালে রেজওয়ান শরিফ ইয়েমেনে গ্রেফতার হন। তেহজীব ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাকালে গ্রেফতার হন। তার ২০ বছরের কারাদ- হয়। আর নাফিস যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হয়ে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। বর্তমান সরকার আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নামের জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আনসার আল ইসলাম ॥ প্রকৌশলী রাজীব থেকে শুরু করে বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা ও ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপ, ঢাকার বেগুনবাড়িতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশ, প্রকৌশলী ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিত রায়, জাগৃতি প্রকাশনার প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলায় তিন জনকে হত্যাচেষ্টা, চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও ইউএসএআইডিতে কর্মরত জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাসহ পুরোহিত, ধর্মযাজক, পাদ্রিসহ অসংখ্য খুনের ঘটনায় আনসারুল্লাহ বাংলাটিম জড়িত বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স বিবৃতি দেয়। আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে নাম পাল্টিয়ে আনসার আল ইসলামের নামে বিবৃতি আসতে থাকে। নতুন জঙ্গী সংগঠন দৌলাতুল ইসলাম ॥ সর্বশেষ গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যার ঘটনায়ও বিবৃতি আসে সাইট ইন্টেলিজেন্সের তরফ থেকে। ঘটনাস্থল থেকে একটি সাদা রুমাল উদ্ধার হয়। সেই রুমালে দৌলাতুল ইসলাম নামের একটি জঙ্গী সংগঠনের নাম লেখা ছিল। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, রুমালের লেখা অনুযায়ী দৌলাতুল ইসলাম গুলশান হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায়। যদিও তদন্তে এখন পর্যন্ত সংগঠনটির কোন অস্তিত্ব মেলেনি। এ নামে আদৌ বাংলাদেশে কোন জঙ্গী সংগঠন ছিল কিনা বা আছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। সব জঙ্গী সংগঠনই এক সুতোয় গাঁথা। যুদ্ধাপরাধী ও তাদের তৎপরতা যতদিন বাংলাদেশে থাকবে ততদিনই এদেশে জঙ্গীবাদ থাকবে। তাদের তৎপরতাও থাকবে। আনসারুল্লাহ বাংলাটিম আলোচনায় আসায় জঙ্গী সংগঠনটি তাদের কর্মকা- আড়াল করতে বর্তমানে আনসার আল ইসলাম নাম ধারণ করেছে। মূলত দুইটি একটি সংগঠন। গ্রেফতার এড়ানো থেকে শুরু করে গোয়েন্দাদের দিকভ্রান্ত করা এবং তদন্ত ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার অপকৌশল হিসেবে জঙ্গী সংগঠনগুলো ঘন ঘন নাম পাল্টিয়ে থাকে। এটি জঙ্গী সংগঠনগুলোর আদি কৌশল। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে প্রকৃত হত্যাকারীরা নিজেদের আড়াল করতে এবং পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে দৌলাতুল ইসলাম নাম লিখে যেতে পারে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের গবেষণা মোতাবেক বাংলাদেশে জঙ্গীসহ উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের সংখ্যা ১২৫টি। এর মধ্যে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনসহ ৪০টির বিরুদ্ধে জঙ্গীবাদের যোগসূত্র থাকার অভিযোগ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী দেশের প্রতিটি জঙ্গী ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠনকে এখনও সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও দলটি বরাবরই এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করে আসছে। যেভাবে চলে জঙ্গী সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম ॥ চলতি বছরের ২৬ জুন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের দাওয়াতী সেলের শীর্ষ নেতা রাজধানীর গে-ারিয়া থানাধীন ফরিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোঃ নাইম ওরফে সাইফুল ইসলাম ওরফে সাদ (৩০) ও রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানাধীন আল আরাফা ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক সোহেল আহম্মেদ ওরফে সোভেল (৩২) গ্রেফতার হন। তারা একাধারে নেতা, তত্ত্বাবধায়ক ও কর্মী। রিমান্ডে তারা জঙ্গী সংগঠনটির সদস্য সংগ্রহ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত শিক্ষক সাদ নিজেও নরসিংদীতে প্রথম আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের এমনই এক দাওয়াতী শাখার টার্গেটে পড়েন। আর সোহেল খুলনায় জঙ্গী সংগঠনটির দাওয়াতী শাখার টার্গেটে পড়েন। এরপর তারাও আস্তে আস্তে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হন। তাদের কয়েক দফায় পরীক্ষা হয়। পরীক্ষায় তারা অপারেশনাল ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানোর জন্য অযোগ্য বিবেচিত হন। তবে তারা দাওয়াতী কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত বলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর থেকেই দুই শিক্ষককে জঙ্গী সংগঠনটির দাওয়াতী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। জঙ্গী সংগঠনটির দাওয়াতী, সদস্য সংগ্রহ, মারকায, ট্রেনিং, টার্গেটকৃত ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ ও স্থানান্তর, মিলিটারি, প্রযুক্তি, পরিকল্পনা ও মিডিয়া সেল রয়েছে। প্রতিটিই সিøপার সেল। এরমধ্যে প্রথম ধাপে রয়েছে দাওয়াতী সেল। এ সেলের সদস্যদের অধিকাংশই মাদ্রাসার তরুণ শিক্ষক। তারা একদিকে যেমন ভাল শিক্ষক, আরেকদিকে ভাল বক্তা। তাদের বয়ান মধুর। অধিকাংশ শিক্ষকই সুদর্শন। একেকটি দাওয়াতী সেলে এক থেকে পাঁচজন পর্যন্ত সদস্য থাকে। দ্ইু শিক্ষক দাওয়াতী সেলের হয়ে কাজ করতেন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে ঘুরে ঘুরে অতিরিক্ত ধর্মভীরু যুবকদের টার্গেট করতেন। ওয়াক্ত নামাজ আদায় শেষে টার্গেটকৃত যুবকদের পবিত্র কোরান-হাদিসের বয়ান শোনার আহ্বান জানাতেন। টার্গেটকৃত যুবকদের বয়স বিশ থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে শারীরিক গঠন বিবেচনা করে ত্রিশ বছর বয়সের যুবকদেরও টার্গেট করা হতো। নামাজের পর যারা বয়ান শোনার জন্য থাকেন তাদের প্রথমে একটি মৌখিক তালিকা করা হয়। অর্থাৎ তাদের নাম কৌশলে মনে রাখেন দাওয়াতী সেলের সদস্যরা। এভাবেই মসজিদের ভেতরেই অন্তত সপ্তাহখানেক বয়ান চলে। সর্বশেষ যারা টিকে থাকেন তাদের চূড়ান্তভাবে জঙ্গী সংগঠনটির দাওয়াত দেয়া হয়। যারা দাওয়াত গ্রহণ করেন তাদের আলাদা তালিকা করা হয়। যারা গ্রহণ না করেন তাদেরও একটি তালিকা করা হয়। তাদের ওপর নজর রাখা হয়। দাওয়াত গ্রহণকারীদের নিয়ে যাওয়া হয় মারকাযে (নিরাপদ আস্তানায়)। এসব আস্তানা দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা ও অভিজাত বা নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত। ঢাকায় থাকা মারাকাযগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন মাদ্রাসার ভেতরে অবস্থিত। কারণ ধর্মীয় অনুভূতির কারণে মাদ্রাসায় সাধারণত কোন সময়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায় না। এছাড়াও ঢাকার অপেক্ষাকৃত দুর্গম স্থানে মারকায স্থাপন করা হয়। মাদ্রাসা ছাড়া অন্যান্য মারকাযগুলোর অধিকাংশই ঢাকার চারদিকে বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসা বাড়িতে অবস্থিত। মারকাযগুলোতে যাওয়া নতুন সদস্যদের উদ্দেশে আরও বয়ান দেয়া হয়। সেখানে চূড়ান্ত জিহাদের দাওয়াত দেয়া হয়। যারা দাওয়াতে যাওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত বলে দাবি করেন, তাদের পৃথক তালিকা করা হয়। তাদের নামে একটি বিশেষ পরিচয়পত্র খুলে দেয়া হয়। সেই পরিচয়পত্রে আসল নামের পরিবর্তে ছদ্ম নাম দেয়া হয়। ছদ্মনাম সংগঠনের তরফ থেকে দেয়া হয়। যারা জিহাদে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রথমে শারীরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কমান্ডো ধাপের সেই ট্রেনিং। শারীরিক প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়। এরপর তাদের পাঠানো হয় চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় থাকা জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। দ্বিতীয় ধাপে চাপাতি ও অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং করানো হয়। এরপর তাদের পাঠানো হয় জঙ্গী সংগঠনটির সামরিক হেডকোয়ার্টারে। সেখানেই হয় চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ। সামরিক শাখার কমান্ডার সরাসরি সেই প্রশিক্ষণ দেখভাল করেন। এরপর তাদের একেক জনকে একেক জেলায় পাঠানো হয়। প্রতিটি সিøপার সেল তৈরি করা হয় ৫ থেকে ৬ জনের সমন্বয়ে। সিøপার সেলের সদস্যরা শপথ অনুযায়ী সেলের অন্য সদস্যদের প্রকৃত নাম পরিচয়, বাড়িঘরসহ কোন কিছুই জানতে চাইতে পারবে না। এরপর তাদের পাঠানো হয় নির্দিষ্ট টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে হত্যা বা টার্গেটকৃত জায়গায় নাশকতা চালাতে। তাদের বাসা ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করে সংগঠনটির আরেকটি সেল। আরেকটি সেল সিøপার সেলের কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ করে থাকে। টার্গেটকৃত ব্যক্তির গতিবিধি, অবস্থান, ছবি, যাবতীয় ঠিকানা, অবস্থান, কোন কোন সময় অপারেশন চালানোর জন্য সুবিধাজনক তা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করে থাকে সংগঠনটির প্রযুক্তি শাখা। প্রযুক্তি শাখা অপারেশনে যাওয়ার ও বের হওয়ার সুবিধাজনক রাস্তার ম্যাপও সরবরাহ করে। প্রতিটি সিøপার সেলে একজন করে হাদী (সামরিক নেতা) থাকেন। হাদীরা সাধারণত সরাসরি হত্যাকা-ে অংশ নেন না। তিনি সরেজমিনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পুরো অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। অপারেশন শেষ হওয়া মাত্র যে যার যার মত আগ থেকেই নির্ধারিত জায়গায় আত্মগোপনে চলে যান। সাধারণত মাসখানেক আগে সিøপার সেলগুলোকে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে হত্যার জন্য পাঠানো হয়। অনেক সময় টার্গেট কঠিন হলে বেশি সময়ও নিয়ে থাকে। গুলির শব্দে লোকজন জড়ো হওয়ার ঝামেলা থেকে রেহাই পেতেই জঙ্গীরা হত্যাকা-ে চাপাতি ব্যবহার করে থাকে। আর নিজেদের রক্ষা করতে সঙ্গে পিস্তল বা রিভলবারের মত ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। অপারেশনাল সেলের সদস্যদের সবাই সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। তারা অপারেশন চালাতে গিয়ে মারা গেলে শহীদের মর্যাদা পাবে বলে সংগঠনের তরফ থেকে বলা হয়ে থাকে। জঙ্গীবাদ ঠেকাতে সরকারের উদ্যোগ ॥ জঙ্গীবাদের উৎস জানার পাশাপাশি এর বিস্তার ঠেকাতে ব্যাপক তৎপরতা চলছে। দেশের বিশেষ বিশেষ মসজিদ ও মাদ্রাসার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নামাজ আদায় শেষে মসজিদে কারা বয়ান করছেন, আর কারা বয়ান শুনছে তাদের বয়স ও লেবাস সম্পর্কে জানতে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই তুলনামূলক বেশি। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গী দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সময় মতো পারদর্শিতা দেখাতে পারলে তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জঙ্গী অর্থায়ন ঠেকাতে বিশেষ নজরদারি চলছে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এছাড়াও সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয়ভাবেও জঙ্গীবাদ ঠেকাতে নানা কার্যক্রম চলছে।
×