ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিলন কান্তি দে

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ এক যে ছিলেন রণজিৎ বিশ্বাস

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১৫ জুলাই ২০১৬

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ এক যে ছিলেন রণজিৎ বিশ্বাস

রণজিৎ কুমার বিশ্বাস- মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে এক মূর্তিমান লেলিহান শিখা, হঠাৎ দপ্ করে নিভে গেল। রণজিৎ বিশ্বাস- নানা বর্ণ নানা গোত্রের এই সমাজে প্রান্তিক অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষগুলোর জন্য এক নির্ভয় কলমসৈনিক, সেই লেখনী আচমকা থেমে গেল। তিনি ছিলেন বিদ্যমান আর্থসামাজিক টানাপোড়েনে নিত্যনতুন শব্দ সৃজনের নিপুণ খেলোয়াড়। খেলাটা দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল। আরও নানা মাত্রিকতায়, নানা আলোকচ্ছটায় তাঁকে বিভূষিত করা যায়। কোন লাভ নেই তাতে। কারণ রণজিৎ বাবুর মতো বাংলার হতভাগ্য সন্তানরা দায়বদ্ধতার মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য যে কল্যাণকর কাজগুলো সম্পন্ন করে যান, আমাদের দুর্ভাগ্য, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বোধ ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদে বড় একটা দেখা যায় না। ‘মরণোত্তর’ শব্দটি বড্ড সেকেলে। স্বীকৃতি, পুরস্কার, সম্মাননা- যা কিছু দিতে হবে জীবদ্দশায়, নগদে। সেই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি শুভ্র, সুন্দর, কল্যাণের প্রতীক এবং ‘শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক’ হিসেবে খ্যাতিমান রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’- কবির এই বাণী চিরন্তন। এর পরেও কোন কোন মহিমময় মৃত্যু আমাদের ভাবায়, কাঁদায়। ‘রণজিৎ বাবু আর নেই’- হাজার হাজার ভক্ত পাঠক শুভাকাক্সিক্ষ, দূরের ও কাছের মানুষ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিচিত সবার কাছে এই শোকবার্তাটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কেননা, কাল-সময়-নির্ঘণ্ট অনুযায়ী তীর্যক ও শাণিত লেখালেখির মধ্য দিয়ে সংখ্যাতীত মানুষের নিশ্বাসে প্রশ্বাসে ছিলেন প্রয়াত রণজিৎ বিশ্বাস। চাকরি জীবনে তার স্থায়ী বসবাস ছিল সচিবালয়ে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব থাকাকালে অবসরে যান তিনি। শুনেছি, সচিব হিসেবেও তিনি ছিলেন খুবই অমায়িক, সহযোগীপরায়ণ ও কর্তব্যনিষ্ঠ। আমলা ছিলেন বটে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতার মজ্জাগত ঔপনিবেশিক চরিত্র তার মধ্যে দৃশ্যমান হয়নি কখনও। সে-যাক, সরকারী উর্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করবেন আজীবনের সতীর্থরা। তবে তাঁর সম্পর্কে অবিসংবাদিত সত্য কথা একটাই। তিনি আমার মতো অনেকের মনে শ্রদ্ধার স্থায়ী আসনে মহিমান্বিত হয়ে থাকবেন একজন মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে। কারণ গল্প, প্রবন্ধ, পত্রিকায় কলাম- যা কিছু লিখেছেন, সবটাই মানুষের কল্যাণের জন্য। মোহগ্রস্থ ও বিপথগামীদের সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য। তিনি ছিলেন সাম্প্রতিককালের একজন লোকপ্রিয় রম্য লেখক। প্রতি সপ্তাহে কোন না কোন জাতীয় কিংবা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিকে তাঁর লেখা বিশেষ মর্যাদায় প্রকাশিত হতো। দৈনিক জনকণ্ঠেও প্রচুর লিখেছেন তিনি। তাঁর সর্বশেষ লেখা ‘লেখকের রাহাখরচ: ভাবনালোকের নিবিড় কথা’ যেটি প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুর দু’দিন পর দৈনিক সমকালে। রণজিৎ বাবু কি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পেরেছিলেন এটি তাঁর জীবনের শেষ লেখা হবে! নইলে কিভাবে লিখলেন ‘ভাবনা লোকের নিবিড় কথাগুলো’ এভাবে- ‘একটু ব্যক্তিগত শোনাবে, তবু বলি, এই দুরবস্থায় আমার এই ছোট জীবনে খুব বড় অসুবিধেয় আমাকে বার বার পড়তে হয়েছে বিভিন্নভাবে। এমন অসুবিধেয় লেখক ভুবনের আরও অনেক শিল্পীই পড়েন। কেউ বলেন, কেউ বলেন না, কেউ লেখেন, কেউ লেখেন না। অনেকেই চান না, হালে বিপদকালে আরও বাড়ুক। অনেকেই মনে করেন, আছি তো এখন ভাজাভুজির কড়াইয়ে। সবকিছু খুলে বলতে গেলে তো পড়ে যাব গনগনে আগুনে ভরা ভাটার মাঝে!’ একজন নির্মোহ জীবনশিল্পীর পক্ষেই জীবন সম্পর্কে এমন কথন সম্ভব। লক্ষণীয় যে, পত্রিকায় তাঁর বেশিরভাগ কলামগুলো ছিল ছোট্ট পরিসরে। কিন্তু বিষয়ের গভীরতা ছিল ব্যাপক। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য, নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে বাক্যকে ছন্দময় করে তোলা, যার মধ্যে নাটকীয় আবহ থাকত। পাঠক একঘেঁয়েমিতে অতিষ্ঠ হতেন না। বরং একান্তমনে নির্মল নাট্যরস উপভোগ করতেন। বিদ্রƒপ, কটাক্ষ, শেষ, রঙ্গ-ব্যঙ্গ- এসবই ছিল তাঁর লেখার ভূষণ। শব্দের তীব্র কশাঘাতে জগৎ সংসারের খারাপ মানুষগুলোকে জর্জরিত করতেন। লেখক সত্তার এই অপরাজেয় শক্তি একজন রণজিৎ বিশ্বাসকে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্মরণীয় করে রাখবে অনন্তকাল। সচিবালয়ের প্রাসাদোপম অট্টালিকায় থেকেও তিনি নিজেকে একজন পোড়খাওয়া মানুষ বলে মনে করতেন। এ পোড়খাওয়া আর্থিকগত কারণে নয়। সমাজজীবনের সংকীর্ণতা, অসংলগ্নতা, চারপাশের কুসংস্কার-কূপম-ূকতা যে অন্তর্লোক দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন, যেভাবে দুঃখ ও হতাশার আগুনে তিল তিল করে পুড়েছেন, তারই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বেদনা শব্দকুশলী কারিগরের মতো বয়ান করেছেন পত্রিকার কলামগুলোয়। জঙ্গীচক্রের থাবায় দেশে বইছে রক্তগঙ্গা, নষ্ট রাজনীতির হোলি খেলায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণবলী হচ্ছে, এমন বিভীষিকাময় ‘ত্রাসের রাজত্বে’ সুবোধ বালকের মতো বসে না থেকে রণজিৎ লিখেছেন- ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ স্বৈরাচার, স্বেচ্ছাচার, নৃশংসতার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন তিনি নিজস্ব শিল্প আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে। ’৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় হয়ে গেল সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদীর। তীব্র ঘৃণায় লিখেছেন- ‘হায় বাংলার কুসন্তান, তোরা কেন এ কাজ করতে গেলি। ইতিহাস তো তোদের ক্ষমা করবেই না। বরং তোদের পাপের বোঝা যে তাদের সন্তানদেরই বহন করতে হচ্ছে। কেননা লজ্জায়, বিবেকের তাড়নায় তারা বাইরে বেরুতে পারছে না। সবার সঙ্গে মিশতে পারছে না।’ এভাবে শব্দের চাবুকে চাবুকে যুদ্ধাপরাধসহ সকল অপশক্তিকে নান্তানাবুদ করে ছেড়েছেন তিনি। রণজিৎ বিশ্বাস সম্পর্কে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তরুণ গবেষকরা উৎসাহিত হতে পারেন এ জন্য যে, চলমান ধারার বাইরে থেকে এক বিশেষ আঙ্গিকে নতুন নতুন শব্দ দিয়ে তাঁর বাক্য গঠন প্রক্রিয়ার ওপর আলোচনা-পর্যালোচনার একটা ধারা তৈরি করা। বাংলায় কিছু প্রচলিত শব্দের রণজিৎ কর্তৃক নতুন নামকরণ এরকম : স্ত্রী-‘গৃহকোণসঙ্গিণী’, উঠতি মেয়ে- ‘বিপজ্জনকভাবে বেড়ে ওঠা’, শুভেচ্ছাবাণী-‘হৎকথন’, অতি উৎসাহী-‘প্রজনিষ্ণু’, লেখার ভুল-ত্রুটি-‘ভ্রমকন্টক’, দাড়ি-কমা- সেমিকোলনের যথেচ্ছ ব্যবহার- ‘কেশকীট’। গবেষণায় আরও অনেক বেরিয়ে আসবে। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। লিখনের পাশাপাশি কথনে-বয়ানে-ভাষণেও অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন রণজিৎ বিশ্বাস। সংস্কৃতি সচিব হিসেবে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি এবং জাতীয় জাদুঘরের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হয়ে আসতে হতো। এসব পরিম-লে তিনি ছিলেন অতিশয় জনপ্রিয়। কোন অনুষ্ঠানে রণজিৎ বাবু আসছেন- খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রচুর লোকজনের সমাগম ঘটতো। শুধু তাঁর সৌন্দর্যময় ব্যক্তিত্বের সুন্দর মুখে নতুন নতুন শব্দ তরঙ্গের খেলা দেখার জন্য। বক্তৃতামঞ্চে তিনি এমনভাবে শব্দের মালা গাঁথতেন, মুহূর্তে একরকম শৈল্পিক আবহ তৈরি হয়ে যেত। মুগ্ধ বিস্ময় ঘোরের মধ্যে আটকে থাকা দর্শকরা তখন একেবারেই রণজিৎময়। তিনি কাউকে খুশি করার জন্যে তোষামোদী বক্তৃতা করতেন না কখনও। গঠনমূলক সমালোচনা করতেন, দিক্নির্দেশনা দিতেন। সরকারি গেজেটভুক্ত যাত্রা-নীতিমালার আলোকে ২০১৩ সালের ৪ মে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রথম বারের মতো ১০টি যাত্রাদলকে নিবন্ধিত করে। প্রত্যেক দল মালিকের হাতে নিবন্ধনপত্র তুলে দিয়েছিলেন তদানিন্তন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ বিশ্বাস এন ডি সি। ওই অনুষ্ঠানে সচিব মহোদয় বলেছিলেন, হালে যাত্রার অনেক দুর্নাম শোনা যায়, কিন্তু ঢালাওভাবে এমন অভিযোগ করা ঠিক নয়। যাদের জন্য দুর্নাম হচ্ছে, যাত্রার নামে সেই আগাছাগুলোকে উপড়ে ফেলতে হবে। ২০১৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত সাহিত্যনির্ভর এক নাট্য প্রযোজনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রণজিৎ বিশ্বাস বলেন, রক্ত শুধু দুই গালের ভেতর থাকলেই হবে না। রক্তস্রোত বইয়ে দিতে হবে সমস্ত শরীরে। এর তাৎপর্যময় অর্থ হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতিকে শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক না করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হবে দেশের আনাচে কানাচে। এক সুধী সমাবেশে তিনি একটু কৌতুক করে বলেছিলেন, বটগাছ আমাদের জন্য উপকার এবং অপকারও। উপকার হচ্ছে বটগাছের শীতল ছায়ায় আমরা শান্তি পাই। আর অপকারের দিকটি হচ্ছে বটগাছের আশপাশে অন্য কোন গাছ বেড়ে উঠতে পারে না। অর্থাৎ এ কথার মধ্যে রণজিৎ বাবু বোঝাতে চেয়েছেন আমাদের দেশের অনেক প্রতিভা বড় বড় ব্যক্তিত্বের পৃষ্ঠপোষকতা (বটগাছের ছায়া) না পেয়ে অকালে ঝরে যায়)। রণজিৎ বাবুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক ঘটনা অনেক। সেকথা অন্যত্র, অন্য কোন সময় বলব। আজ শুধু এ মহাপ্রাণ মানুষটির সান্নিধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর একটি মনের কথা জানিয়ে দিই। তাঁর স্বপ্ন ছিল- বাংলাদেশে মানুষ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবে, শুদ্ধ বানানে লিখবে এবং শুদ্ধ ও সুন্দর আচরণের মধ্য দিয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য স্থাপন করবে। রণজিৎ বাবু, মর্ত্যধাম থেকে আপনি এখন অমৃতলোকে। আপনার স্বপ্ন পূরণে প্রস্তুত আমরা। আপনাকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
×