ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কিবরিয়া পিনু

সুফিয়া কামাল ও তাঁর গল্পে জীবনমুখী চেতনা

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ১৫ জুলাই ২০১৬

সুফিয়া কামাল ও তাঁর গল্পে জীবনমুখী চেতনা

সুফিয়া কামালের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটি গদ্যগ্রন্থ কেয়ার কাঁটা। এটি চৌদ্দটি গল্প ও একটি নাটক নিয়ে রচিত। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার আগে এই গ্রন্থের কয়েকটি গল্প সওগাত, বুলবুল, জয়ন্তী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের গল্পগুলো হলোÑ কেয়ার কাঁটা, যে নদী মরু পথে হারালো ধারা, বিজয়নী, সান্ত¡না, অপমান না অভিমান, শামা-পরওয়ানা, কমলের ব্যথা, সে এক তপস্যা, মধ্যবিত্ত, দু’ধারা, সত্যিকার, যদি ব্যথী না আসিবে, সসাগরা। এই গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে- নূরজাহান নামক একটি নাটক। গ্রন্থটি কবি বেনজির আহমদ ১৯৩৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেছিলেন। ‘কেয়ার কাঁটা’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। এ সংস্করণের প্রকাশক কবিপুত্র শাহেদ কামাল। সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালে, তাঁর সৈনিক বধূ নামের গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে বরিশালের তরুণ পত্রিকায়। বয়স তখন তাঁর মাত্র ১২ বছর। আর গল্পগ্রন্থ কেয়ার কাঁটা যখন প্রকাশিত হয়- তখনও তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৬ বৎসর। গল্পগুলোতে তাঁর জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন, সমাজ পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলো পরিণত জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, সুফিয়া কামাল বেঁচে ছিলেন দীর্ঘদিন- প্রায় ৮০ বছর। গল্পগুলোতে তরুণ বয়সের জীবনানুভূতি ও পর্যবেক্ষণ স্বাভাবিকভাবে এসেছে, তবুও গল্পের বুনন, ভাষা ও জীবন আবিষ্কারের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে গল্পগুলো হয়ে উঠেছে সেই সময়কালের নিরিখে উল্লেখযোগ্য, বিশেষভাবে মুসলিম মহিলা কথাসাহিত্যিকদের রচিত গল্পের ধারায় বিশিষ্ট। কেয়ার কাঁটা এবং বইটির লেখিকা হিসেবে সুফিয়া কামাল সম্বন্ধে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। কেয়ার কাঁটা যখন রচিত হয় সে সময় বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প ছিল খুবই সীমিত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র এক্ষেত্রে পথিকৃত। বেগম রোকেয়াও কয়েকটি গল্প লেখেন যা প্রকাশিত হয়েছিল নবনূর, সওগাত, নওরোজ এবং মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। তাঁর বিখ্যাত ইংরেজি গল্প ঝঁষঃধহধ’ং উৎবধস প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে মাদ্রাজের ঞযব ওহফরধহ খধফরবং, গধমধুরহব পত্রিকায়। সেই সূত্রে ‘কেয়ার কাঁটা’র এবং বিশেষ করে এ স্তরের ছোটগল্পের লেখিকা হিসাবে সুফিয়া কামালের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উপরন্তু, সমকালীন আবেদন, সর্বকালীন প্রাসঙ্গিকতা এবং সমাজের বিভিন্ন প্রশ্ন, সমস্যা ও চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ কেয়ার কাঁটা আজকের পাঠকের মনেও খুব সম্ভব রেখাপাত করবে। সুফিয়া কামালের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কবিতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তা সত্ত্বেও তাঁর গদ্য পড়লে এ কথাটি পরিষ্কার হয় যে কোন লেখার প্রকৃত মূল্য নির্ভর করে লেখার ওপর, সংখ্যার বা পরিমাপের ওপর নয়। কেয়ার কাঁটা প্রকাশের পর সমসাময়িক মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক আজাদ, দৈনিক স্টার অব ইন্ডিয়া ইত্যাদি পত্রিকায় বইটির উচ্চ-প্রশংসিত সমালোচনায় এ সত্যটি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। মাসিক মোহাম্মদীতে বলা হয় : ‘ইহাকে গদ্য-কাব্য বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। গল্প-সাহিত্যে নজরুলের ব্যথার দান ও রিক্তের বেদন ছাড়া এর সমতুল্য এই বাংলা ভাষায় আর নাই বলিলেও চলে। ...বাংলা কবিদের মধ্যে ইনি নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ একথা পাঠকগণ জানেন। ...কেয়ার কাঁটা পড়িয়া সকলেই আমাদের মত স্বীকার করিতে বাধ্য হইবেন, কবিতার মত তাঁর গল্প রচনাও সুমধুর সুন্দর। যে কয়টি গল্প এই গ্রন্থে প্রকাশিত হইয়াছে তাহার সব কয়টিই আমরা মুগ্ধ-বিস্ময়ে এক নিঃশ্বাসে পাঠ করিয়াছি।... মনে হয় নারীর অন্তর-রহস্যের এমন সুমধুর বর্ণনা বাংলার আর কোন গল্পগ্রন্থে স্থান পাইয়াছে কিনা সন্দেহ। লেখিকার গদ্য-রচনাও তাঁহার কবিতার মত মনোহর। এ গ্রন্থকে অনায়াসে গদ্য-কাব্য নামে অভিহিত করা যায়।’ (মাসিক মোহাম্মদী, কলিকাতা, শ্রাবণ ১৩৪৫। ‘সুফিয়া কামাল’, সেলিম জাহাঙ্গীর, নারী উদ্যোগ কেন্দ্র, ঢাকা, ফাল্গুন ১৩৯৯, পৃ. ৬০১। সুফিয়া কামালের কেয়ার কাঁটা গ্রন্থে যেসব গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে, তার বেশিরভাগ গল্পের বিষয়বস্তু উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারে অবস্থানকারী মানব-মানবীর প্রেম, সংসার, সম্পর্ক ও মানসিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বিশেষভাবে মানব-মানবীর চিরকালীন সহজাত সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে এ গ্রন্থের গল্পগুলো অনেকটা উজ্জ্বল ও বিকশিত। নারী ও পুরুষের যৌবনকালীন অনভূতি ও রোমান্টিকতা এ গল্পগুলোতে উন্মুখ হয়েছে বিস্তৃতভাবে, তবে তৎকালীন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের বিভিন্ন অনুসঙ্গ ও চিত্র গল্পগুলোতে আমরা লক্ষ্য করি। শহরের বর্ণনার সাথে সাথে গ্রামের পটভূমিও রয়েছে এসব গল্পে। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের দেখা মেলে বিভিন্নভাবে। রাজনৈতিক ঘটনা ও প্রসঙ্গ জোরালো ও বিস্তৃতভাবে না থাকলেও এসেছে দু’একটি গল্পের বর্ণনায়। কেয়ার কাঁটা গল্পে লেখক গ্রাম ও শহরের পটভূমিতে গল্পের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তাঁর গল্পে গ্রাম যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে শহর। লেখক নিজেও গ্রাম ও শহরে বেড়ে উঠেছেন, সে কারণে গ্রাম ও শহর জীবনের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন গল্পের বর্ণনায় এসেছে। সুফিয়া কামালের গল্পে নদীমাতৃক দেশের গ্রামীণ দৃশ্য এভাবে এসেছেÑ ‘ভাটির দেশের বর্ষার নদী, মাঠে নদীতে একাকার, নদীর বুকে গৈরিক আভাস মাঠের বুকে শ্যামলতার রূপ নয়নাভিরাম। নৌকা ভেলা ডিঙ্গিতে মানুষের আনাগোনা। এদিক হইতে মনে হয় দিগন্ত নামিয়া নদীকে চুম্বন করিতেছে, কিÑ নদী রবিকরস্নাত হইয়া পুলকে ফুলিয়া উঠিয়াছে বুঝিবার উপায় নাই। জ্যোৎ¯œা রাতের দৃশ্য আরও অপরূপ। চাঁদে নদীতে প্লাবন জাগিয়াছে, প্রতি তরঙ্গ বক্ষে চাঁদ ভাসিয়া গড়াইয়া হাসিয়া মিশিয়া খেলা করিতেছে। ...পরিপূর্ণ নদী, কল্লোল শব্দ নাই আপন পূর্ণতায় আপনি নিঃশব্দ মহীয়ান। কয়দিন হইতে বৃষ্টি নাই ঝরঝরে খরা। জ্যোৎস্নার যেন বান ডাকিয়াছে।’ (গল্প : সসাগরা) অথবা গ্রাম ও শহরের পাশাপাশি বর্ণনায় গ্রামের প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্ব এভাবে উচ্চকিত হয়Ñ ‘গঞ্জের পাশ দিয়া নদী বহিয়া চলিয়াছে। সপ্তাহের দুইটি হাটের পশরা বহিয়া নৌকা চলে। যাওয়া আসা, আসা যাওয়া। নদীর ওপারে শহর ছোট মফস্বল শহর। এপারে ওপারে হাত ছানাছানি চলেÑ ঘর, কারখানার চিমনি এপারে চাহিয়া থাকে বনানী শীর্ষের সবুজ শ্যামল পত্র সম্ভারের পানে এপারের পাখির ঝাঁক অদৃশ্য হইয়া যায় ওপারের সৌধমালার অন্তরালে। সমারোহ ওপারে যতই থাকুক, সুষমা এপারেই।’ (গল্প : সসাগরা) মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই নাজুক যে, স্বজনের চিকিৎসা করার জন্য ধারদেনা ও সোনাদানা বিক্রি করে ফেলতে হয়Ñ এমনি চিত্র ‘মধ্যবিত্ত’ গল্পের বর্ণনায়Ñ ‘না, পারলাম না। জয়! আমার জয়নাব বাঁচল না। ছুটি নিলাম, ধার করলাম। দু’চার গাছা সোনার চুড়ি বালা যা ছিল তা বিক্রি করলাম কিন্তু জয়নাব বাঁচল না।’ (গল্প : মধ্যবিত্ত) সুফিয়া কামালÑ এই গল্পগ্রন্থের অনেক গল্পেই নারী-পরুষের যৌনসম্পর্ক, প্রেম উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। সহজাত ও স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্ক দেহজকামনায় কখনও কখনও বিকশিত হয়েছে অবলীলায়। এ ধরনের প্রকাশ সুফিয়া কামালের গল্প রচনারকালে অনেকটা সাহসী ও অভিনব। মুসলিম নারী হিসেবে গল্প রচনা করতে গিয়ে জীবনসত্যের আলো আঁধারীতে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে শুধু অন্ধকারে তিনি রেখে দেননি, বরং প্রকাশ্যে আলোয় তুলে ধরেছেনÑ এইদিক থেকে ছোট গল্পকার হিসেবে সুফিয়া কামাল অনেকটা সফল। আমরা জানিÑ গল্পকাররা নতুন চেতনা ও মূল্যবোধকে ভিত্তি করে জীবনের অনেক অপ্রকাশিত ও গোপন এলাকা উন্মোচন করে থাকেন, একজন এগিয়ে থাকা সচেতন মানুষ হিসেবে। নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও দেহজ প্রেম এই গল্পগ্রন্থের বিভিন্ন গল্পে নানা মাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে। এ ধরনের উদাহরণÑ ‘সমস্ত পৃথিবী তখন কেঁপে উঠছে। আমি অস্থির হয়ে উঠলুমÑ সখিনা কোথায়? মুহূর্তেই দেখলুম সে দৌড়ে আসছে। বোধ করি এইমাত্র নেয়ে উঠছে, ঘন দীর্ঘ চুল তার সিক্ত। এলায়িত কাপড়খানাকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে সে এসে আমাকে দুই ব্যগ্র বাহুর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল। প্রবল কম্পনে আমাদের ঠিক সম্মুখেই ধরণী দুই ফাঁক হয়ে গেল। তার বুক থেকে একটা উন্মাদ আর্তনাদ আমাদের কণ্ঠস্বরকে লুপ্ত করে দিল। আমি আমার সমগ্র শক্তি দিয়ে লতার মতো, একখ- সুষমার মতো সখিনার দেহটিকে বুকে চেপে ধরে পিছনে সরে গেলাম।’ (গল্প : যে নদী মরু পথে হারালো ধারা) অথবাÑ ‘তারপর তোমার কথামত দেহের দাবি। হ্যাঁ, সেটাও ফেলবার নয়। তুমি তো জান আমি ফ্রয়েডবাদী মেয়ে নইÑ তবুও দেহের দাবি আমি অস্বীকার করব না, কারণ আমার মনেও সাধ ছিল- আমি মাতা হবÑ সু-মাতা, পতœী হবÑ আদর্শ পতœী। এত দেহের দাবি দিয়েই পাওয়া, তাছাড়া কি করে মাতা পতœী হওয়া যায়?’ (গল্প : যে নদী মরু পথে হারালো ধারা) দেহজ কামনার পাশাপাশি দেহ ছাড়া প্রেম কিংবা প্রেমের রঙ্গিন দিনগুলো কখনও কখনও মলিন হয়ে যায়Ñ তার প্রতিভাস এই গ্রন্থের গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে, এমনি উদাহরণÑ ‘দুনিয়ায় ক্ষুধাও আছে তৃষ্ণাও আছে, ক্ষুধা ও তৃষ্ণা এক বস্তুতে মিটে না, সে তুমি জান। ক্ষুধা দেশ পাত্র রুচি অনুসারে ভাতে, পোলাওয়ে, রুটি তরকারিতে মিটান যায় কিন্তু তৃষ্ণা সেই একই বস্তুতে, সকল দেশের সকল যুগের সকল লোকেরা মিটিয়ে আসছেÑ সেই বারি। তাই দেহের ক্ষুধা ভিন্ন যে মনের তৃষ্ণা মিটায়Ñ সে প্রেম-প্রীতি ভালবাসাÑ তাকে দেহের দাবিতে না আনলেও চলে।’ (গল্প : যে নদী মরু পথে হারালো ধারা) আরও উদাহরণÑ ‘কই, কোথায় সেই যৌবনের স্বপন রঙ্গিন দিনগুলি, সেই বাসন্তী হাওয়া, সেই ফাল্গুনী আগুনÑ আর মতিনের তপ্ত হৃদয়ের উচ্ছ্বাস। সবই কি তবে শেষ হইল?’ (গল্প : সান্ত¡না) নারী-পুরুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে ছাড়াছাড়ি, তালাক হয়ে যাওয়া, এরপরও স্বাধীনভাবে চলা, আবার বিয়ে করার ইচ্ছে নিজের ভেতর জেগে তোলাÑ এক ধরনের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতার ইচ্ছে ও প্রেষণা লক্ষ্য করি সুফিয়া কামালের গল্পে, যা স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তির পরিচয় ধারণ করেÑ ‘আমার স্বামী আমাকে কেন ছাড়লেন অথবা আমার স্বামীকে আমিই বা কেন ছাড়লুম সে কথাটা নতুন করে শোনাবার প্রবৃত্তি আর আজ আমার নেই। খোদা যা করেন ভালর জন্য। পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর মেয়ে নেই এটা যেমন আমার স্বামী ভুলেও ভাবেন না, আমারও ভাবা উচিত আমার স্বামী ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক পুরুষ আছেÑ (এটাও প্রতিদিনই টের পাওয়া যাচ্ছে)। আমার ভুল তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না, তার ভুল আমি ভুলতে পারব না, অথচ একসঙ্গে চিরজীবন কাটাতে হবে তার চেয়ে কি এই ভাল না? আর শরায়ও তালাকের বিধান এই অবস্থায় দেয়া হয়েছে। এখন তিনি চারটি বিয়ে করুন, আমি একটি করি তার বাধা নেইত। তবে সেটা যার যার ইচ্ছা অনুসারে।’ (গল্প : যে নদী মরু পথে হারালো পথ) এই গল্পগ্রন্থে বেশি সন্তানের পরিবারের চিত্র রয়েছে, বেশি সন্তান প্রসবের জন্য নারীর স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য নষ্ট হওয়াÑ পাশাপাশি অন্যান্য অসুবিধের কারণে দাম্পত্য-সুখ হুমকির সম্মুখীনÑ এমন চিত্র লেখকের সময়কালে এক ধরনের বাস্তবতা, যে বাস্তবতা তার গল্পের চরিত্রে ও পরিবেশে ফুটে উঠেছে। ‘সেই মতিন ও আমেনা, দীর্ঘ দশ বৎসরের ঝড়-ঝাপটা কাটাইয়া ভরা সংসারের সকল সুখ-দুঃখের ভিতর দিয়া পথ করিয়া এই আজিকার দিনটিতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। কিন্তু জীবনের সেই স্বপন রঙ্গিন চেহারা আজ কোথায়Ñ সেই ফাল্গুনী হাওয়াÑ সেই ফাল্গুনের হোলি খেলাÑ সেই আরব্য উপন্যাসের রাজপুত্র আর রাজকন্যার মায়াপুরী? ছেলে-মেয়েতে এই দশ বৎসরে পাঁচটি। ...মতিন আবার পাশ ফিরিয়া শুইয়াছে। আমেনার বুক কাঁপিয়া উঠিয়াছে। এ যে বহুদিনের সঞ্চিত বিষÑ একটি অসতর্ক মুহূর্তে হঠাৎ বাহির হইয়া পড়িয়াছে। কার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ? এতগুলি সন্তানের মা আমেনারই বিরুদ্ধে নয় কি?’ (গল্প : সান্ত¡না) সুফিয়া কামালের গল্পগুলোতে পারিবারিক সম্পর্ক বেশ গভীরভাবে রয়েছে, পরিবারের মধ্যে বাৎসল্য প্রেমের বিশেষ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। সন্তানের প্রতি মাতার ভালবাসাÑ তা চিরন্তন মাতৃত্ববোধের প্রকাশ, যা গল্পের কাহিনী রচনায় বিশেষ তাৎপর্য বহন করে থাকে, এমনি ভালবাসা সুফিয়া কামালের গল্পকে করেছে আরও মানবিক ও পারিবারিক আবহে উজ্জ্বল। সন্তানের জন্য নারীরা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বহু কষ্ট ও দুর্যোগ নীরবে সহ্য করে থাকেÑ সন্তানকে ভালবেসে অনেক অপূর্ণতাকে মেনে নেয়, স্বামীর অবহেলা-নির্যাতনও সহ্য করে থাকেন নারীরা। সান্ত¡না নামের গল্পে সুফিয়া কামাল নারীর সেই দিগন্তকে উন্মোচন করেছেনÑ মহিমান্বিত ও শাশ্বত অনুভূতিতেÑ ‘পাশে তখনও আয়নাখানা পড়িয়াছিল। আমেনা তাহা আর একবার সম্মুখে টানিয়া লইল। সন্ধ্যায় স্তিমিত আলোকে আর একবার ভাল করিয়া নিজের মুখখানা দেখিতে লাগিল। প্রাণ হাহাকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। কইÑ যৌবনের সে দীপ্তি, সে লাবণ্য আজ কোথায়! নিজের রক্তের বিনিময়ে আজ সে পাঁচটি সন্তানের মাতা। তাহার মুখ আজ বিবর্ণ, মাথার সিঁথির ওপরে টাক পড়িয়াছে, চোখের কোণে কালি ধরিয়াছে। গালের সে নিটোল সৌন্দর্য আর নাইÑ সে সর্বস্ব লুণ্ঠিতা-রিক্তা-সর্বহারা! ছোট খোকাটি হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া আব্দার ধরিল- মা, আমি চুল আঁচড়াবোÑ আমেনা তাহাকে কাছে টানিয়া রইল। চুল আঁচড়াইতে আঁচড়াইতে তাহার মুখটি ভাল করিয়া দেখিতে লাগিল। দেখিতে ঠিক বাবারই মতো চোখ, সেই নাকÑ সেই মুখের হাসি। খোকাকে বুকে লইয়া চুমোয় চুমোয় আমেনা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। ইহাই মতিন তাহাকে দিয়াছেÑ ইহাই আজিকার একমাত্র সান্ত¡না।’ (গল্প : সান্ত¡না) গল্পে সুফিয়া কামাল আত্মানুসন্ধানমূলক দর্শন ও বিবেচনা গল্পের শরীরে টেনে এনেছেন, যা এ ধরনের উক্তিতে প্রকাশ পায়Ñ ‘এমামের তীব্র স্বর শোনা গেল ‘ছাড়ুন। ওকে দেখিয়ে দি মজাটা——’ মাসুমা বললে ‘ছি লোকে কি কুকুরকে কামড়ায়? কুকুরই লোককে কামড়ায়!’ (গল্প: বিজয়নী) কেয়ার কাঁটা গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোর প্লট তৈরি হয়েছে বর্ণনামূলকভাবে কোন চিঠির ভাষ্যে, আবার উত্তম পুরুষের কথনে। কোন কোন গল্পের আকার ছোট, আবার কোন কোন গল্পের আকার বড় হয়েছে, যা বড় গল্প হিসেবে বিবেচনা করা যায়। প্লট গঠনে শিথিলতা আছে, আবার অতিকথনও কোন কোন গল্পকে সংহত হতে দেয়নি। প্রেমের বাক্যবিন্যাসের ক্ষেত্রে আবেগ বেশি মাত্রায় থাকার ফলেÑ তা হয়ে উঠেছে কবিতাক্রান্ত। কেয়ার কাঁটা, বিজয়নী, দুধারা, সান্ত¡না, বিড়ম্বিত, অপমান না অভিমান, সে এক তপস্যা, মধ্যবিত্ত, সসাগরাÑ গল্পগুলোতে ছোটগল্পের বর্ণনাভঙ্গি, সংলাপ, চরিত্র-চিত্রণ ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। এসব শিল্পশর্ত উল্লিখিত গল্পগুলোতে আছে। তবে, শামা-পরওয়ানা ও কমলের ব্যথা নামক গল্প দুুটিকে গল্প না বলে গল্পের আঙ্গিকে ছোট পরিসরে লেখা এক ধরনের আলেখ্য বলা চলে। যে নদী মরু পথে হারালো ধারা চিঠির ভাষ্যে উত্তম পুরুষে লেখা ৪ অংশে ৪টি চিঠির অবতারণামূলক কথনের মধ্য দিয়ে গল্পের সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন আবহ, ঘটনা, চরিত্র ও জীবনযাপনের আলেখ্য এই গল্পের ভেতরে আমরা খুঁজে পাই। সত্যিকার নামের গল্পটিও চিঠির ভাষ্যে লেখা হয়েছে। গল্পগুলোতে যেসব চরিত্র অঙ্কন করা হয়েছে, সেগুলো বেশিরভাগ পারিবারিক আবহে বিকশিত, কোন কোন চরিত্র নারীপ্রেমের জন্য উদ্দীপক ও ভালবাসার বন্ধনকে জীবনের কাক্সিক্ষত বিষয় বলে বিবেচনা করেছে। নারী-পুরুষের ভালবাসা কখনও মিলনাত্মক হয়ে আনন্দময় হয়ে উঠেছে, কখনও বিরহ-বিচ্ছেদের পরিণতিতে হয়ে উঠেছে বিদীর্ণ। তবে গল্পগুলোতে হাহাকার, কষ্ট, দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও জীবনের সংঘাত ভালবাসায় অবগাহন করে ¯িœগ্ধ ও আনন্দময় হয়ে উঠতে চেয়েছে। সুফিয়া কামাল নারী-পুরুষের ভালবাসাকে এসব গল্পে জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। কেয়ার কাঁটা নামক গল্পে নারীর সৌন্দর্য বার বার উচ্চকিত হয়েছে, ফুলের সৌরভে, কাব্যময় বর্ণনায়। যে নদী মরু পথে হারালো ধারা গল্পে নারীর অবদমিত ভালবাসা ও পুরুষের প্রতি আকাক্সক্ষা অনেকটা খোলামেলা বেদনায় জেগে উঠেছে, দেহের দাবি সরাসরি সংলাপে এসেছে। বিজয়নী গল্পে ‘আসমত আলী’ চরিত্রটি পরোপকারী একজন ‘এসডিও’ হিসেবে এসেছে। সান্ত¡না নামক গল্পে ‘আমেনা’ চরিত্রটি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহিণী, যিনি শুধু সংসারের কষ্ট সহ্য করে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন, এই চরিত্র পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর মহিলার চরিত্র, যিনি সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে সব বিরূপতা ও কষ্ট সহ্য করার আত্মশক্তি অর্জন করেন। মধ্যবিত্ত গল্পে চাকরিজীবী পরিবারের চরিত্র চিত্রণ করা হয়েছে। সুখী সুন্দর সংসারে ছেলেমেয়ের আনন্দে-আহ্লাদে দিন কাটানোর প্রতিচ্ছাপ এই গল্পে খুঁজে পাই, কিন্তু গৃহিণী ‘জয়নব’ সংসারের জন্য ছেলেমেয়েদের জন্য পরিশ্রম ও দায়বন্ধতা পালনে নিবেদিত থাকার পরও অসুখে অসুস্থ হয়ে মারা যায়, সোনাদানা-অলঙ্কার বিক্রি করেও বহু চেষ্টায় তাকে বাঁচানো যায় না। এই গল্পটি ট্রাজেডির মহিমায় পরিণতি লাভ করেছে। সসাগরা গল্পে জীবন সংগ্রামের জন্য মানুষের প্রচেষ্টা, গতিশীলতা, উদ্যোগ ও স্থান থেকে আর এক স্থানে গমন, এসব তুলে ধরেছেন গল্পে। এ গল্পের চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনে পারিবারিক গ-ি থেকে বের হয়ে যাওয়াÑ নতুন অভিজ্ঞতায়, নতুন প্রণোদনায় জীবনকে সাজানোর জন্য আগ্রহী মানুষের প্রতিচিত্র, যা নতুন সময়ে তৈরি হওয়া নতুন মানুষের অবয়ব। সুফিয়া কামাল কেয়ার কাঁটা গল্পগুলো সাধু ভাষা ও চলিত ভাষায় লিখেছেন। কোন কোন গল্পে সংলাপের আধিক্য রয়েছে, কোনটাতে কম। কিছু গল্পে সংলাপ অল্প, বর্ণনা বেশি। সাধু ভাষার বর্ণনা এ রকমÑ ‘তিন মাস পরে। আজই সকাল বেলায় দানেশরা চলিয়া গিয়াছে। আজ রবিবারের দীর্ঘ অলস নিস্তব্ধ কর্মহীন দ্বিপ্রহরে এতদিনের অবিবাহিত নির্ঝঞ্ঝাট নিশ্চিত জীবন যেন হামিদের নিকট ব্যর্থ নিরর্থক বলিয়া মনে হইল। নির্লিপ্ত দিনগুলি এতদিন তাহার যে শান্তিতে কাটিয়াছে আর যেন তাহা কাটিতে চায় না। এই তিন মাসে সে যেন নতুন মানুষ হইয়া আপন বাড়িঘরে অতিথির মতো কাটাইয়াছে। দানেশের মাতার স্নেহে দানেশের প্রীতিতে মালেকার মাধুর্যে তার ঘর ও মন ভরিয়া ছিল।’ (গল্প : বিড়ম্বিত) বিজয়নী গল্প হতে চলিত ভাষার ব্যবহারের উদাহরণ এ রকমÑ ‘প্রায় দেড় মাস পরে হঠাৎ খবর পেলুম সাত দিনের টাইফয়েডে আলী মারা গেছে। এত খারাপ লাগল। ইচ্ছা হল ছুটে চলে আসি। কিন্তু কোন অসিলায়ই আমি আসতে পারলুম না। আমেনাই জোর করে আসতে দিলে না, যা ভাবলে তা ঠিকই মনের মধ্যেও সেই বাধার জন্যে হেরে গেলুম। ইচ্ছে করেই বেশি জোর দিলুম না।’ (গল্প : বিজয়নী) সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে গল্পে এভাবেÑ ‘শিরী বললে, ‘এক্ষুণি যাবে? একটু, অন্তত দুটো পর্যন্তÑ’ ‘না আর দেরি করা যায় না, আর কিইবা লাভ এতে’, আমিন বললে। শিরী বললে, ‘তো জরুরী ফোন কেন করলে? বৌ বুঝি?’ ‘হ্যাঁ’ ‘ওঃ তাই। তাকে কেন ডাকলে না? এলে দেখেই যেতাম।’ ভ্রƒ কুঞ্চিত করে আমিন বললে, ‘সে জেলপাড়ার সং নয়, দেখবার কি এমন আছে।’ (গল্প: অপমান না অভিমান) সুফিয়া কামাল তাঁর গল্পে যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, তা হয়ে উঠেছে কাব্যিক সুষমায় উজ্জ্বল, এমন উদাহরণÑ ‘জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাইয়া আমেনা দেখিয়াছেÑ মতিন মিথ্যা বলে নাই। সারাবিশ্বে ফাগুন আসিয়া আগুন জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছে। তাহার জানালার পাশের বহুদিনের ঝরা-পাতা গাছটিও বুক সকলের অজ্ঞাতে যেন কখন কচি সবুজ পাতায় ছাইয়া গিয়াছে। তাহার শাখা-প্রশাখা পুলক-বিহ্বল রং-বেরঙের অসংখ্য পাখির কল-কাকলীতে ভরিয়া উঠিয়াছে। সত্যিই তো এমন একটি দিনÑ ইহা কি অফিসে বসিয়া কালি আর কলম দিয়া কাগজের পৃষ্ঠায় আঁচড় কাটিবার জন্য! Ñমতিনের কথার আর উত্তর দিবার আবশ্যক হয় নাই। মুগ্ধ আমেনার আবেগ কম্পিত পূর্ণ সমর্পণের মাঝখানে সকল কথা কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে আর কেহ খোঁজ করিয়া দেখিবার চেষ্টা করে নাই।’(গল্প: সান্ত¡না) ‘সত্যিকার’ গল্পে লেখক ‘উপমা’ ব্যবহার করে উজ্জ্বল পংক্তি গল্পে সম্পর্কিত করেছেন, যা গল্পের ভাষায় সুষমা এনে দিয়েছেÑ ‘আমার ঘরের তিনদিনের দিন ও এসেছিল। বাইশদিন রইল আমার সংসারে রাণীর মতো আসন জুড়ে, সেবিকার মতো সেবা করে, আমাকে আরও মুগ্ধ লুব্ধ করে। লঘুচ্ছন্দা হরিণীর মতো, কলকণ্ঠী কপোতীর মতো আমার শূন্য সংসারে শান্তির বন্যা বইয়ে দিয়ে ও চিরদিনের মতো এঁকে রেখে গেল ওর সত্যিকারের পরিচয়।’ (গল্প: সত্যিকার) গল্পে শুধু উপমাই ব্যবহার করেননি লেখক, ব্যবহার করেছেন উৎপ্রেক্ষা, যেমনÑ ‘অকস্মাৎ প্রবল কান্নায় ও ভেঙ্গে পড়ল। উচ্ছ্বসিত সিন্ধু-হিল্লোলের মতো বেলাড্রাম যেন আছাড় খেয়ে পড়ল।’ (গল্প: সত্যিকার) অথবাÑ ‘ও যেন ঝর্ণা দুঃখে ওকে কাতর করেনি, বেদনা ওর কাছে সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে, আঘাত ওর পরশে অলঙ্কার হয়ে বেজেছে! ও যেন পথ ভুলা কোন ছায়া পথের নীহারিকা।’ (গল্প : কেয়ার কাঁটা) সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও, তার লেখা ‘কেয়ার কাঁটা’ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো সৃজনশীলতায় ও বিষয়বস্তুর কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে সময় গল্পগুলো লেখা হয়েছে, সেই কালের নিরিখে একজন মুসলিম নারী লেখকের জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবন আবিষ্কারের প্রণোদনা কেমন ছিল, তা আমরা এই গল্পগুলোর মধ্যে দিয়ে বিবেচনা করতে পারি। সুফিয়া কামালের সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয় আমরা পাই নারী-পুরুষ সম্পর্কের দিগন্ত উন্মোচনের ক্ষেত্রে, তেমনি মানুষের জীবন-সংগ্রাম বিশেষত নারীদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ে তাঁর গল্পগুলোর কাহিনী বিন্যাস হয়ে উঠেছে তৎকালীন সামাজিক অবস্থানে নারীর বহুরৈখিক প্রতিভাস। জীবনমুখী চেতনা, ভাষার সৌকর্য ও ব্যঞ্জনার কারণে সুফিয়া কামাল ছোটগল্পকার হিসেবে বিশিষ্ট হয়ে আছেন। গল্পগুলোতে যেসব চরিত্র অঙ্কন করা হয়েছে, সেগুলো বেশিরভাগ পারিবারিক আবহে বিকশিত, কোন কোন চরিত্র নারীপ্রেমের জন্য উদ্দীপক ও ভালবাসার বন্ধনকে জীবনের কাক্সিক্ষত বিষয় বলে বিবেচনা করেছে। নারী-পুরুষের ভালবাসা কখনও মিলনাত্মক হয়ে আনন্দময় হয়ে উঠেছে, কখনও বিরহ-বিচ্ছেদের পরিণতিতে হয়ে উঠেছে বিদীর্ণ। তবে গল্পগুলোতে হাহাকার, কষ্ট, দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও জীবনের সংঘাত ভালবাসায় অবগাহন করে ¯িœগ্ধ ও আনন্দময় হয়ে উঠতে চেয়েছে। সুফিয়া কামাল নারী-পুরুষের ভালবাসাকে এসব গল্পে জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। কেয়ার কাঁটা নামক গল্পে নারীর সৌন্দর্য বার বার উচ্চকিত হয়েছে, ফুলের সৌরভে, কাব্যময় বর্ণনায়। যে নদী মরু পথে হারালো ধারা গল্পে নারীর অবদমিত ভালবাসা ও পুরুষের প্রতি আকাক্সক্ষা অনেকটা খোলামেলা বেদনায় জেগে উঠেছে, দেহের দাবি সরাসরি সংলাপে এসেছে। বিজয়নী গল্পে ‘আসমত আলী’ চরিত্রটি পরোপকারী একজন ‘এসডিও’ হিসেবে এসেছে। সান্ত¡না নামক গল্পে ‘আমেনা’ চরিত্রটি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহিণী, যিনি শুধু সংসারের কষ্ট সহ্য করে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন, এই চরিত্র পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর মহিলার চরিত্র, যিনি সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে সব বিরূপতা ও কষ্ট সহ্য করার আত্মশক্তি অর্জন করেন। মধ্যবিত্ত গল্পে চাকরিজীবী পরিবারের চরিত্র চিত্রণ করা হয়েছে। সুখী সুন্দর সংসারে ছেলেমেয়ের আনন্দে-আহ্লাদে দিন কাটানোর প্রতিচ্ছাপ এই গল্পে খুঁজে পাই, কিন্তু গৃহিণী ‘জয়নব’ সংসারের জন্য ছেলেমেয়েদের জন্য পরিশ্রম ও দায়বন্ধতা পালনে নিবেদিত থাকার পরও অসুখে অসুস্থ হয়ে মারা যায়, সোনাদানা-অলঙ্কার বিক্রি করেও বহু চেষ্টায় তাকে বাঁচানো যায় না। এই গল্পটি ট্রাজেডির মহিমায় পরিণতি লাভ করেছে। সসাগরা গল্পে জীবন সংগ্রামের জন্য মানুষের প্রচেষ্টা, গতিশীলতা, উদ্যোগ ও স্থান থেকে আর এক স্থানে গমন, এসব তুলে ধরেছেন গল্পে। এ গল্পের চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনে পারিবারিক গ-ি থেকে বের হয়ে যাওয়াÑ নতুন অভিজ্ঞতায়, নতুন প্রণোদনায় জীবনকে সাজানোর জন্য আগ্রহী মানুষের প্রতিচিত্র, যা নতুন সময়ে তৈরি হওয়া নতুন মানুষের অবয়ব। সুফিয়া কামাল কেয়ার কাঁটা গল্পগুলো সাধু ভাষা ও চলিত ভাষায় লিখেছেন। কোন কোন গল্পে সংলাপের আধিক্য রয়েছে, কোনটাতে কম। কিছু গল্পে সংলাপ অল্প, বর্ণনা বেশি। সাধু ভাষার বর্ণনা এ রকমÑ ‘তিন মাস পরে। আজই সকাল বেলায় দানেশরা চলিয়া গিয়াছে। আজ রবিবারের দীর্ঘ অলস নিস্তব্ধ কর্মহীন দ্বিপ্রহরে এতদিনের অবিবাহিত নির্ঝঞ্ঝাট নিশ্চিত জীবন যেন হামিদের নিকট ব্যর্থ নিরর্থক বলিয়া মনে হইল। নির্লিপ্ত দিনগুলি এতদিন তাহার যে শান্তিতে কাটিয়াছে আর যেন তাহা কাটিতে চায় না। এই তিন মাসে সে যেন নতুন মানুষ হইয়া আপন বাড়িঘরে অতিথির মতো কাটাইয়াছে। দানেশের মাতার স্নেহে দানেশের প্রীতিতে মালেকার মাধুর্যে তার ঘর ও মন ভরিয়া ছিল।’ (গল্প : বিড়ম্বিত) বিজয়নী গল্প হতে চলিত ভাষার ব্যবহারের উদাহরণ এ রকমÑ ‘প্রায় দেড় মাস পরে হঠাৎ খবর পেলুম সাত দিনের টাইফয়েডে আলী মারা গেছে। এত খারাপ লাগল। ইচ্ছা হল ছুটে চলে আসি। কিন্তু কোন অসিলায়ই আমি আসতে পারলুম না। আমেনাই জোর করে আসতে দিলে না, যা ভাবলে তা ঠিকই মনের মধ্যেও সেই বাধার জন্যে হেরে গেলুম। ইচ্ছে করেই বেশি জোর দিলুম না।’ (গল্প : বিজয়নী) সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে গল্পে এভাবেÑ ‘শিরী বললে, ‘এক্ষুণি যাবে? একটু, অন্তত দুটো পর্যন্তÑ’ ‘না আর দেরি করা যায় না, আর কিইবা লাভ এতে’, আমিন বললে। শিরী বললে, ‘তো জরুরী ফোন কেন করলে? বৌ বুঝি?’ ‘হ্যাঁ’ ‘ওঃ তাই। তাকে কেন ডাকলে না? এলে দেখেই যেতাম।’ ভ্রƒ কুঞ্চিত করে আমিন বললে, ‘সে জেলপাড়ার সং নয়, দেখবার কি এমন আছে।’ (গল্প: অপমান না অভিমান) সুফিয়া কামাল তাঁর গল্পে যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, তা হয়ে উঠেছে কাব্যিক সুষমায় উজ্জ্বল, এমন উদাহরণÑ ‘জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাইয়া আমেনা দেখিয়াছেÑ মতিন মিথ্যা বলে নাই। সারাবিশ্বে ফাগুন আসিয়া আগুন জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছে। তাহার জানালার পাশের বহুদিনের ঝরা-পাতা গাছটিও বুক সকলের অজ্ঞাতে যেন কখন কচি সবুজ পাতায় ছাইয়া গিয়াছে। তাহার শাখা-প্রশাখা পুলক-বিহ্বল রং-বেরঙের অসংখ্য পাখির কল-কাকলীতে ভরিয়া উঠিয়াছে। সত্যিই তো এমন একটি দিনÑ ইহা কি অফিসে বসিয়া কালি আর কলম দিয়া কাগজের পৃষ্ঠায় আঁচড় কাটিবার জন্য! Ñমতিনের কথার আর উত্তর দিবার আবশ্যক হয় নাই। মুগ্ধ আমেনার আবেগ কম্পিত পূর্ণ সমর্পণের মাঝখানে সকল কথা কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে আর কেহ খোঁজ করিয়া দেখিবার চেষ্টা করে নাই।’(গল্প: সান্ত¡না) ‘সত্যিকার’ গল্পে লেখক ‘উপমা’ ব্যবহার করে উজ্জ্বল পংক্তি গল্পে সম্পর্কিত করেছেন, যা গল্পের ভাষায় সুষমা এনে দিয়েছেÑ ‘আমার ঘরের তিনদিনের দিন ও এসেছিল। বাইশদিন রইল আমার সংসারে রাণীর মতো আসন জুড়ে, সেবিকার মতো সেবা করে, আমাকে আরও মুগ্ধ লুব্ধ করে। লঘুচ্ছন্দা হরিণীর মতো, কলকণ্ঠী কপোতীর মতো আমার শূন্য সংসারে শান্তির বন্যা বইয়ে দিয়ে ও চিরদিনের মতো এঁকে রেখে গেল ওর সত্যিকারের পরিচয়।’ (গল্প: সত্যিকার) গল্পে শুধু উপমাই ব্যবহার করেননি লেখক, ব্যবহার করেছেন উৎপ্রেক্ষা, যেমনÑ ‘অকস্মাৎ প্রবল কান্নায় ও ভেঙ্গে পড়ল। উচ্ছ্বসিত সিন্ধু-হিল্লোলের মতো বেলাড্রাম যেন আছাড় খেয়ে পড়ল।’ (গল্প: সত্যিকার) অথবাÑ ‘ও যেন ঝর্ণা দুঃখে ওকে কাতর করেনি, বেদনা ওর কাছে সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে, আঘাত ওর পরশে অলঙ্কার হয়ে বেজেছে! ও যেন পথ ভুলা কোন ছায়া পথের নীহারিকা।’ (গল্প : কেয়ার কাঁটা) সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও, তার লেখা ‘কেয়ার কাঁটা’ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো সৃজনশীলতায় ও বিষয়বস্তুর কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে সময় গল্পগুলো লেখা হয়েছে, সেই কালের নিরিখে একজন মুসলিম নারী লেখকের জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবন আবিষ্কারের প্রণোদনা কেমন ছিল, তা আমরা এই গল্পগুলোর মধ্যে দিয়ে বিবেচনা করতে পারি। সুফিয়া কামালের সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয় আমরা পাই নারী-পুরুষ সম্পর্কের দিগন্ত উন্মোচনের ক্ষেত্রে, তেমনি মানুষের জীবন-সংগ্রাম বিশেষত নারীদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ে তাঁর গল্পগুলোর কাহিনী বিন্যাস হয়ে উঠেছে তৎকালীন সামাজিক অবস্থানে নারীর বহুরৈখিক প্রতিভাস। জীবনমুখী চেতনা, ভাষার সৌকর্য ও ব্যঞ্জনার কারণে সুফিয়া কামাল ছোটগল্পকার হিসেবে বিশিষ্ট হয়ে আছেন।
×