ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাহবুবা সুলতানা

মহান ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৫ জুলাই ২০১৬

মহান ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ

’৪৭ এর দেশ বিভাগের সময় নারীর অধিকার, স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন কিংবা কর্তৃত্ব সেভাবে অর্জিত হয়নি। তবুও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, ৪৮ এর পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নারীরা যেভাবে সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছিল তা সত্যিই সাড়া জাগানোর মতো। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ জিন্নাহর এই বক্তব্যের জোরালো প্রতিবাদ করে সেদিন আপামর ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, সেøাগানে সোচ্চার হয়েছিল সেখানে নারীরা ছিল সহযোদ্ধা হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি সম্মুখ কাতারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীরা গভীর রাতে গোপনে ভাষার দাবি সংবলিত বিভিন্ন সেøাগানের পোস্টার আঁকত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে নারীরাই পুলিশের সম্মুুখ লড়াইয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে দেয়। পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গুলিতে আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীরা। এমনকি আহতদের চিকিৎসার সাহায্যের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েরা চাঁদাও তুলে আনে। ছাত্ররা পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েরা তাদের আশ্রয় দিত। আন্দোলনের ব্যয়ভার বহনের জন্য অনেক নারী নিজেদের অলঙ্কার পর্যন্ত খুলে দিত। অর্থাৎ ভাষা আন্দালনের মতো এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় নারীরা যেভাবে পেরেছে সেভাবেই এই সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার সব ধরনের চেষ্টায় নিজেদের সংযুক্ত করেছে। ভাষা সংগ্রামে অংশগ্রহণের কারণে অনেক নারীকে কারাবরণও করতে হয়েছে। অনেক মেয়েকে সংসার থেকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে। অনেক ছাত্রীকে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ অবধি নারীদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য এবং যুগান্তকারী। রাহেলা, রহিমা এবং রোকেয়া আন্দোলনকারীদের অনেক দিন রান্না করে খাইয়েছেন। ’৫২ এর ২৩ তারিখ ভোর ৪টার দিকে অধ্যাপক আবুল কাশেমের বাসা পুলিশ ঘিরে ফেলে তাকে আটকের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি তার স্ত্রী রাহেলা এবং বোন রহিমার সহযোগিতায় সে যাত্রায় পলিশের আটক থেকে রক্ষা পান। অন্দর মহলে নারীদের এই বিপ্লবী কর্মপ্রক্রিয়া আন্দোলনের গতিপথকে কতখানি অবারিত করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ছাত্রী প্রতিনিধিদের পক্ষে থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুনের উচ্চারণ ছিল ‘বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি স্বীকার করিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে। আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে একজন নারীর পক্ষে এমন সাহসী বক্তব্য কর্মীদের মনে উদ্দীপনা জাগাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয় কারাবন্দী নেতাদের উদ্দেশ্যে স্কুলের মেয়েদের মুক্ত কণ্ঠে সেøাগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘বন্দী ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশী জুলুম চলবে না’ আন্দোলনকে কতখানি উদ্দীপ্ত করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপর ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচীতে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙ্গার মূল কাজটা রওশন আরা বাচ্চুসহ আরও কয়েক ছাত্রী দ্বারাই সংঘটিত হয়। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ এবং টিয়ারশেলের আঘাতে কয়েক ছাত্রী আহত হন। এদের মধ্যে রওশন আরো বাচ্চু, সারা তৈফুর, বোরখা শামসুন, সুুফিয়া ইব্রাহীম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম ছিলেন। জগন্নাথ হলে চলা এক এ্যাসম্বেলিতে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ার খাতুন প্রতিবাদী বক্তব্যে বলেন, পুলিশের লাঠিচার্জে মেয়েরা আহত হয়েছে। মোট ৮ জন মেয়ে আহত হয়েছে। মন্ত্রিসভা এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করেছে যাতে মেয়েরা পর্যন্ত লাঞ্ছিত হয়েছে। ঢাকার বাইরেও নারীরা ভাষা আন্দোলনের একাত্ম হতে গিয়ে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের মমতাজ বেগমকে তার স্বামী তালাক দেন ভাষা আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য। মমতাজ বেগমের ছাত্রী ইলা বকশী, বেনু ধর এবং শাবানীর মােত কিশোরীরাও পুলিশী গ্রেফতার থেকে পার পায়নি। সিলেটের কুলাউড়ার সালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ভাষা শহীদদের স্মরণে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। এই অভিযোগে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সালেহা বেগমের পক্ষে আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম ও সিলেটের ছাত্রীরাও আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রাখেন, ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন ছাত্রী গ্রেফতার হন। তাদের মধ্যে লায়লা নূর, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, কামরুন নাহার, লাইলী, হোসনে আরা, ফরিদা আনোয়ার ও তালেয়া রহমান অন্যতম। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার আলোকে ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। সমাজ সংস্কারের সমস্ত অন্ধকারকে ভেদ কর শিক্ষাগ্রহণই শুধু নয় যে কোন ধরনের সংগ্রামে শামিল হওয়া ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পুরুষদের শুধু সহ্য করতে হয়েছে সরকার ও পুলিশী নির্যাতন আর মেয়েদের সামনে ছিল আরও ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতা যাকে উপেক্ষা করে কোন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছিল সত্যিই দুঃসাধ্য। ভাষা আন্দোলনের সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামে জোড়ালো ভূমিকা রেখে নারীরা সেই অসাধ্য সাধনে ব্রতী হয়েছিল। তাই ভাষার দাবিতে নারীদের রাজপথে নেমে আসা ছিল বঙ্গ ললনার অগ্রগতির আর এক নতুন মাত্রা সংযোজন।
×