ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পান্থ আফজাল

রেস্টুরেন্ট ওয়েটার থেকে জনপ্রিয় শিল্পী

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১৫ জুলাই ২০১৬

রেস্টুরেন্ট ওয়েটার থেকে জনপ্রিয় শিল্পী

সে জগতদ্বিখ্যাত। তার সুরের মোহনীয় মূর্ছনায় ও দৃষ্টিনন্দন কোমর দুলানো নাচে পুরো বিশ্ব কুপোকাত। কি পাননি জীবনে? সম্মান, যশ, খ্যাতি সবকিছুই এখন তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে না চাইতেই। অথচ এই কণ্ঠশিল্পীকেই কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আজকের এই মজবুত অবস্থানে আসতে হয়েছে। নিশ্চয়ই জানার আগ্রহ জন্মেছে কে এই বিখ্যাত নারী? তার পুরো নাম শাকিরা ইসাবেল মেবারাক রিপোল। যে পৃথিবীর সবার কাছে শুধুই শাকিরা নামেই খ্যাত। ১৯৭৭ সালের ২ ফ্রেব্রুয়ারি কলম্বিয়ার বারানকুলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন শাকিরা। ছয় বছর বয়সেই কবিতা লিখে তাক লাগিয়ে দেন তার কবি বাবাকে। তারপর একে একে বেশকিছু কবিতা লিখেন শাকিরা। পরে সেগুলো গান হিসেবে বিভিন্ন এ্যালবামে ব্যবহার করা হয়। কবি বাবার প্রেরণাতেই শাকিরার মাথায় গানের পোকা ঢুকে। ব্যবসায় ধস নামলে শাকিরার বাবা অর্থাভাবে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন আর মেয়েকে জোর করে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে পাঠিয়ে দেন। শাকিরার গান-নাচ সব থেমে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু বড় হয়ে যিনি বিশ্ব মাতাবেন, তাঁর তো থেমে যাওয়া সাজে না। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নিজের আত্মবিশ্বাস অটুট রেখে সঙ্গীতচর্চা অব্যাহত রাখেন। গানের টানে শাকিরা নিজ শহর বারানকুলা থেকে চলে যায় রাজধানী শহর বোগোটায়। শুরুতে নিজের খরচ চালানোর জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। বার, রেস্টুরেন্টসহ বেশকিছু জায়গায় পার্টটাইম কাজ করেছে। পাশাপাশি ঘরে, বন্ধুদের মধ্যে অব্যাহত রেখেছে গানের চর্চা। ইউটিউবে শাকিরার ছোট্টবেলার একটি ভিডিও রয়েছে। ভিডিও টাইম স্ট্যাম্প অনুযায়ী জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দৃশ্যটি ধারণ করা হয়, তখন এই তারকা ছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সের। ভিডিওটিতে দেখা যায় দর্শক সারির সামনে দিয়ে হেঁটে স্টেজে উঠছেন ‘হিপ্স ডোন্ট লাই’খ্যাত ১২ বছরের শাকিরা। এই সময় ছোট শাকিরা গোলাপি শার্ট-সাদা প্যান্ট এবং মাথায় একটি টুপি পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। শাকিরার প্রথম দুটি এ্যালবাম ফ্লপ করে। তখন কলম্বিয়ার বাইরে কেউ শাকিরাকে চেনেন না। ১৯৯৫ সালে তাঁর এ্যালবাম ‘পিয়েস ডেসকালোস‘ খ্যাতি নিয়ে আসে কলম্বিয়ায়। এরপর ১৯৯৮ সালে আরেকটি এ্যালবাম তাঁকে জনপ্রিয় করে দক্ষিণ আমেরিকায়। এরপর ২০০১ সালে তাঁর মিউজিক ভিডিও ‘হোয়েন এভার হোয়্যার এভার’ জনপ্রিয়তা পায় গোটা বিশ্বে। বিশেষ করে শাকিরা সবাইকে নাচের জাদু দেখিয়ে মাত করে দেন। এরপরের এ্যালবাম লন্ড্রি সার্ভিস। সে এ্যালবামের জনপ্রিয় গান আন্ডারনিথ ইওর ক্লোথস। শাকিরা দুবার গ্র্যামি এওয়ার্ডস জিতেছেন, সাতবার ল্যাটিন গ্র্যামি এওয়ার্ডস এবং একবার গোল্ডেন গ্লোবের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। কলম্বিয়ায় অন্য কোন গায়িকার গান এত বিক্রি হয়নি যতটা হয়েছে শাকিরার। সারা দক্ষিণ আমেরিকায় শাকিরা হলেন দ্বিতীয় গায়িকা যার ৫০ মিলিয়নেরও বেশি এ্যালবাম বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়েছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার বিলবোর্ড চার্টগুলোতে অন্য কোন দক্ষিণ আমেরিকার গায়িকা শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে পারেনি একমাত্র শাকিরা ছাড়া। ২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ফুটবল। শেষ দিন অর্থাৎ ফাইনাল খেলার দিন খেলা শুরুর ঠিক আগে শাকিরা ভিক্লিফ জনের সঙ্গে হিপ্স ডোন্ট লাই গানটি লাইভ পারফর্ম করেন। বিশ্বকাপ মাতোয়ারা দর্শক কিছু সময়ের জন্য মাতোয়ারা হন শাকিরার নাচে-গানে। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের থিম সং ‘ওয়াকা ওয়াকা’র মাধ্যমেও পুরো বিশ্ব মাত করেন শাকিরা। তাঁর গাওয়া ২০১০ বিশ্বকাপের অফিসিয়াল থিম সং ‘ওয়াকা ওয়াকা’ ছিল ইউটিউবে সর্বাধিক শোনা গানের অন্যতম। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে শাকিরা ‘লা লা’ গান দিয়ে মাতালেন পুরো বিশ্বকে। ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই এখন শাকিরা। শাকিরা অনর্গল কথা বলতে পারেন ইংরেজী, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ এবং ইতালিয়ান ভাষায়। শাকিরার প্রথম প্রেমিকের নাম এ্যান্টোনিও। এ্যান্টোনিও ছিলেন আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দো ডেলারুয়ার ছেলে। শাকিরা ও এ্যান্টোনিও দীর্ঘ ১১ বছর একসঙ্গে বাস করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের প্রেম টেকেনি। এ্যান্টোনিওর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর স্প্যানিশ ফুটবল তারকা জেরার্ড পিকেকে নতুনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন শাকিরা। জেরার্ড পিকের সঙ্গে শাকিরার পরিচয়টাও গান ও ফুটবলের মাধ্যমেই। জেরার্ড পিকে শাকিরার চেয়ে ১০ বছরের ছোট। তারপরও কোন বাধা মানেনি তাদের ভালবাসা। এখন তাদের সংসারে রয়েছে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান। ডেভিড ও ভিক্টোরিয়া বেকহ্যামকে পেছনে ফেলে এখন বিশ্ব ক্রীড়া সেরা দম্পতি জুটি জেরার পিকে ও শাকিরা। বিশ্বখ্যাত ‘ফোর্বস’ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বিশ্বের সেরা দম্পতি জুটির এক তালিকা। তাতেই সংযোজিত হয়েছে বার্সেলোনার স্টপার পিকে ও কলম্বিয়ার পপ তারকা শাকিরার নাম। তিনি ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যে কিনা ফেসবুকে ১০০ মিলিয়ন লাইক পেয়েছেন। ২০০৩ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে শাকিরা ইউনিসেফের গুডউইল এ্যাম্বাসেডর হন। এর আগে এত অল্প বয়সে কেউ এই সম্মান পায়নি। ২০০৭ সালে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে গুডউইল এ্যাম্বাসেডর হয়ে শাকিরা বাংলাদেশে আসেন। তিনি বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। শাকিরার একটি অলাভজনক ফাউন্ডেশন রয়েছে। নিজের জনপ্রিয় এ্যালবাম ‘পিয়েস ডেসক্যালজোস’-এর নামে ১৯৯৭ সালে শাকিরা তার ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন নিজ দেশে। যার অর্থায়নে তিনি মানব সেবার কাজ করে থাকেন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি আটটি বিদ্যালয় গড়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন চ্যারিটেবল কনসার্টে তিনি অংশগ্রহণ করেন, তার বিভিন্ন এ্যালবাম ও গান থেকে অর্জিত কিছু অর্থ তিনি এই ফাউন্ডেশনে দান করেন।
×