ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ জেগে ওঠো মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৫ জুলাই ২০১৬

রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ জেগে ওঠো মানুষ

(বুধবারের সম্পাদকীয় পাতার পর) আজ পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছেছে এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সন্ত্রাসীদের শেকড় উপড়ে ফেলা হবে। আমরা বিশ্বাস করি এটা কেবল শেখ হাসিনাই পারবেন, অন্য কেউ নয়। তাঁর অনুুপস্থিতিতে তাঁর দলের অন্য কেউ সেটা পারবেন তা মানুষ বিশ্বাস করে না। এজন্য শেখ হাসিনা তাদের চূড়ান্ত টার্গেট। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে এখানে কথিত ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হয়ে যাবে। তাই শেখ হাসিনাকে এই মৌলবাদের শেকড় উপড়ে ফেলতেই হবে। কিন্তু সেটা কি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা বা শুধু সামরিক-বেসামরিক আমলাদের দ্বারা সম্ভব? মোটেই না। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন যে, প্রত্যেক অভিভাবক যেন তার সন্তানদের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। সন্তানরা যেন আইএসের মতো অন্ধকারে চলে না যায় সেদিকে তিনি লক্ষ্য রাখতে বলেছেন। যারা চলে গেছে অভিভাবকদের তাদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার কথাও বলেছেন। এসব আহ্বান ও উদ্যোগ সবই সময়োপযোগী। কিন্তু মূল প্রয়োজন গণউদ্যোগ বা গণজাগরণ। এই জাগরণ সৃষ্টির জন্য মূল ভূমিকা পালন করতে হবে রাজনৈতিক শক্তিকে। এজন্য রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য অত্যন্ত জরুরী। সে ঐক্যের কথা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন। কিন্তু জামায়াত বা পাকিস্তানের সঙ্গে তার যে সখ্য তাতে তাদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন। ঐ সখাদের পরিত্যাগ করতে পারলে সেই ঐক্যটি সম্ভব। আবার বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন যে, দুঃশাসনের কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে। সেজন্য নির্বাচন প্রয়োজন। কিন্তু নির্বাচন তো অনেক দূর। কথিত দুঃশাসনের কারণেই হত্যাকা-সমূহ সংঘটিত হচ্ছেÑ এ রকম বক্তব্য অনেকটা সন্ত্রাসীদের পক্ষে যাচ্ছে। সেজন্য ঐক্য চাইলে জামায়াত-শিবির, পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা তিনি অবশ্যই করতে পারেন; কিন্তু সরকারের কর্মকা-ের জন্য মৌলবাদী-জঙ্গী হামলা হচ্ছে তা বলা বোধ হয় সঙ্গত নয়। তাই এসব বক্তব্য ঐক্যের পথে বাধা তৈরি করবে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭২-এর সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাদের সঙ্গে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন। যে কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সামরিক-বেসামরিক আমলা দিয়ে জঙ্গীবাদ-মৌলবাদ প্রতিহত করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে মৌলবাদী চিন্তার অনেক মানুষ ঢুকে পড়েছে। এমনকি এই আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে চাকরি পাওয়াদের মধ্যে অনেকেই ঢুকে পড়েছে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে। অর্থের বিনিময়ে কোন কোন জনপ্রতিনিধি তাদের জন্য সুপারিশ করেছেন। এছাড়া জোট আমলে নিয়োগ পাওয়া সদস্যরা তো আছেই। এতদ্ব্যতীত অনেক ক্ষেত্রে বাহিনীগুলোর সক্ষমতাও নেই। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে মনে হয়েছে যে, তারা ইন্টারনেটে প্রদত্ত জঙ্গীবাদীদের বিভিন্ন লেখালেখি বা পোস্ট সম্পর্কে এখনও ওয়াকিবহাল নয়। অথচ জঙ্গীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে যে, নির্দিষ্ট একটা সময়ে তারা নির্দিষ্ট স্থানে হামলা করবে। কিন্তু পুলিশ এ বিষয়ে আপডেটেড নয়। এজন্য প্রয়োজনে বেসরকারী খাতে কর্মরত আইটি বিশেষজ্ঞদের অধিক বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আর বাহিনীর নিজেদের মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো প্রয়োজন। আবার গোয়েন্দারা কতটুকু খাঁটি তা দেখাও জরুরী। অসমর্থিত সূত্রের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে শিবির করতেন এ রকম ব্যক্তি এখন এসএসএফে কর্মরত আছেন। শুধু একটা বিশেষ জেলার লোক হিসেবে তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধারণ করে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয়েছে তথাকথিত ইসলামী চিন্তার অধিকারী এক ব্যক্তিকে। কোন এক সময় দেখা যাবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি জঙ্গীতে ভরপুর হয়েছে। তাই এ ধরনের সিলেকশনে মনোযোগী না হলে জঙ্গীবাদের উৎপাটন কঠিন হবে। গুলশান তা-বের পর ১৪ দলের পক্ষ থেকে পাড়ায় পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে আদৌ এই রাজনৈতিক কমিটি হয়েছে কি-না তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ অধিকাংশ নেতার এদিকে নজর নেই। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গীবাদ-মৌলবাদ-সন্ত্রাস নির্মূল অসম্ভব। স্থানীয় অনেক নেতার সঙ্গে জামায়াতের নিচু পর্যায়ের কর্মীদের যোগাযোগ রয়েছে। কোন কোন স্থানে জামায়াতীরা ঐ সব আওয়ামী লীগারের আশ্রয়-প্রশ্রয় পান বলে শোনা যায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে জামায়াত-শিবিরের এক ধরনের সামাজিকীকরণ হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের ওপরের দিকে কারও কারও আত্মীয়তা রয়েছে। আর নিচের দিকে তো কোন হিসাব নেই। এসব কারণে সমাজের সব স্তরে জামায়াত-শিবির মিশে গেছে। তবুও গণজাগরণ হলে সব অপশক্তি পরাজিত হবে, ভেসে যাবে। সেই গণজাগরণের জন্য রাজনৈতিক শক্তির মাঠে নামা প্রয়োজন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল রাজনৈতিক শক্তির উদ্যোগে; পেছনে কাজ করেছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী বা বুদ্ধিজীবীরা। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সভা-সমাবেশ করা অতীব জরুরী। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জঙ্গীবাদী-মৌলবাদীদের কর্মকা- তুলে ধরা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সব মিডিয়ার মালিক-সম্পাদকদের অনুরোধ জানানো যেতে পারে। যে সব মিডিয়া এ দায়িত্ব গ্রহণ করবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও জরুরী। মিডিয়াতে কথাবার্তা বলেন এমন জঙ্গীবাদের সমর্থকদের ওপর নজরদারি বাড়ানোও আজ সময়ের দাবি। কারও দেশবিরোধী কোন অবস্থান রাষ্ট্রের সহ্য করা কাম্য নয়। কারণ এখন একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সঙ্কট চলছে। এই সঙ্কট সৃষ্টিকারীদের সমর্থন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর তৎপরতাও লক্ষ্য করা যায় না। সব জায়গায় যেন ক্ষমতার কেমিস্ট্রি ছড়িয়ে পড়েছে। পাড়ায়-মহল্লায় নামা দরকার সমাজের গ্রহণযোগ্য মানুষের। রাজনৈতিক কমিটির পাশাপাশি এই সামাজিক শক্তির কণ্ঠ সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। কারণ আমরা কেউই নিরপাদ নই। যে কোন মানুষকে হত্যা করা বা আমাদের সন্তানদের হত্যার পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জঙ্গীরা কোন বাছ-বিচার করবে না। হত্যাকা- ঘটিয়ে মানুষকে হতোদ্যম করাই তাদের উদ্দেশ্য, আতঙ্ক ছড়িয়ে মানুষকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়াই তাদের লক্ষ্য। এছাড়াও বিশেষভাবে ঢাকায় একটি ইমাম সম্মেলন করা জরুরী বলে মনে হয়। কারণ অভিযোগ আছে কোন কোন মসজিদে ‘ইসলামের জন্য জীবন দেয়া’কে উৎসাহিত করা হয়। যে সকল ইমাম তথাকথিত ‘জেহাদ’কে উস্কে দেয় তাদের আইনের আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়। স্মর্তব্য যে, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক তথাকথিত আলেম ‘পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার অর্থ ইসলামের খেদমত করা’ এ ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও সবকিছু ভেসে গেছে গণজাগরণের কারণে। কয়েকটি দূতাবাসের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। গুলশান হত্যার পর অনলাইন মিডিয়াগুলোতে যে ধরনের সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে, তাতে পাকিস্তান ও তুর্কী দূতাবাস বা এই দুটো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত। কারণ, ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল’। বাংলাদেশে কোন অপশক্তি কোনদিন টিকে থাকেনি। সমগ্র পৃথিবীর ক্ষেত্রেই এটি বলা যায়। অশুভ শক্তি অল্পকালের জন্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে, দীর্ঘকালের জন্য নয়। পৃথিবীতে হাজার বছরের সভ্যতা টিকে আছে, অসভ্যতা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে মানুষ। তাই মানুষের ঐক্য এই মুহূর্তে জরুরী। ঘর থেকে বেরিয়ে গলা ফাটিয়ে, চিৎকার করে বলা দরকার বাংলাদেশে এই ইসলাম ও মানবতাবিরোধী শক্তির ঠাঁই হবে না। যদি অধিকাংশ মানুষ গর্জে ওঠে তাহলে বাংলাদেশ গর্জে উঠবে। পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গ তুলে বলা দরকার সবাই জেগে ওঠ, আর দেরি নয়; আমার পূর্বপুরুষের রক্তাঙ্কিত পতাকা আমি একদল শকুনকে খামচে ধরতে দিতে পারি না। (সমাপ্ত) লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
×